খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
জ্যোতিষবিদ্যায় একদমই বিশ্বাস ছিল না জহর রায়ের। কিন্তু এজি বেঙ্গলের কর্মী, অবসর সময় হাত দেখে সময় অতিবাহিত করা নরেনবাবুই তাঁর ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠলেন। একদিন মির্জাপুর স্ট্রিটের এক চায়ের দোকানে মনমরা হয়ে বসে আছেন জহর রায়। মনে মনে ভাবছেন এত চেষ্টা করছেন, তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এমনসময় নরেনবাবু নিজে যেচে আলাপ করে তাঁর হাত দেখতে চাইলেন।
প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না জহর। পরে ভাবলেন, লোকটা যখন নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে এসে হাত দেখতে চাইছে, দেখাই যাক না একবার। ক্ষতি কী!
অনেকক্ষণ ধরে খুব মনযোগ দিয়ে জহরের হাত দেখে নরেবাবু বললেন, আপনার তো সাংঘাতিক হাত মশাই। ঠিকুজি কোষ্ঠী কিছু আছে আপনার? সেসব নেই শুনেও দমলেন না ভদ্রলোক। হাতিবাগানের এক জায়গার ঠিকানা দিলেন। সেখান থেকে একটা কোষ্ঠী তৈরি করিয়ে নিয়ে জহরকে তাঁর সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে বললেন।
জহর রায়ের কী হল কে জানে, নগদ টাকা দিয়ে কোষ্ঠী তৈরি করে একদিন সাতসকালে হাজির হলেন নরেনবাবুর বাড়ি। অনেকক্ষণ ধরে কোষ্ঠীবিচার করে নরেনবাবু মন্তব্য করেছিলেন,‘ পাটনা ফিরে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দাও ভায়া। এই কলকাতা শহরেই একদিন তোমাকে নিয়ে এমন মাতামাতি হবে যে টাকা রাখবার জায়গা পাবে না।’
ভদ্রলোকের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছিল বিলক্ষণ। মাস ছয়েকের মধ্যেই দু-তিনটে ছবিতে সই করে ফেললেন জহর। হাতে কিছু নগদও চলে এল। একদিন মিষ্টি কিনে জহর হাজির হলেন তাঁর বাড়ি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আর দেখা হল না। গিয়ে শুনলেন, মাস দু’য়েক আগে ধর্মতলায় ট্রামের নীচে চাপা পড়েছেন জহর রায়ের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নরেন।
তবে জহর রায়ের জ্যোতিষচর্চায় আগ্রহ না থাকলেও তিনি যে ঈশ্বরভক্ত ছিলেন, একথা অনেকেরই অজানা। জহরের ঈশ্বরপ্রীতির কথা বলতে গিয়ে তাঁর ছোট মেয়ে কল্যাণী বলছিলেন, ‘বাবাকে নিয়ে কথা উঠলেই সকলে তাঁর মদ্যপানের কথা বলেন। কিন্তু বিখ্যাত মানুষদের মতো সাধারণ মানুষরাও তো অনেকে পানাসক্ত থাকেন। বাবা মদ্যপান করলেও কখনও আমাদের প্রতি অবহেলা করতেন না। সবসময় চাইতেন তাঁর পরিবার যেন ভালো থাকে। তাই নিজের হাতে সব কিছু তদারক করতেন। তেমনই তাঁর ঈশ্বরভক্তিও ছিল প্রবল। বাবার উপাসনার কথা অনেকেই জানেন না। শ্যুটিংই হোক বা ফাংশন বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে বাইরে যাওয়াই হোক, তিনি কিন্তু সবসময় ঠাকুরের ছবি কিনে আনতেন। ঘরে কোনও ঠাকুরের ছবি বাদ ছিল না। তবে বাবা ছিলেন একনিষ্ঠ কালীভক্ত।’
ঈশ্বরপ্রীতির জন্যই হয়তো জহর রায়ের জীবনে সবসময় কোনও না কোনও মানুষ এসেছেন পথপ্রদর্শক হয়ে। নরেনবাবুর মতোই তাঁর জীবনে এরকম আর একজন হলেন রঙ্গশ্রীর সাধন সরকার। ‘সাহারা’ ছায়াছবির সংলাপ লিখছেন সাহিত্যক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ছবির নায়ক ছিলেন সাধন সরকার। তাই নারায়ণবাবুর বাড়িতে তাঁর যাতায়াত লেগেই থাকত। এছাড়া নতুন নাটকের ব্যাপার তো ছিলই। একদিন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে সাধন দেখেন জহর তাঁর ঘরে বসে রয়েছেন। জহরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়ে নারায়ণবাবু বলেন, ‘ খুব হাসাতে পারে জহর। মনে হয় কমেডিয়ান হিসেবে খুব নাম করবে একদিন।’
তখন সাধন সরকার বলেন, ‘সাধনা করতে করতেই তো মানুষ সিদ্ধ হয়। আবার সিদ্ধ হওয়ার পরও সাধনা করতে করতে কোনও ফাঁকে একটা ‘প্র’ এসে ওই সিদ্ধর ঠিক আগে জুড়ে বসলে মানুষটা হয়ে যায় প্রসিদ্ধ।’ কথাটা শুনে জহর হো হো করে হাসতে লাগলেন। তখন নারায়ণবাবু জহরকে বলেন, কী হে তোমার সেই চার্লির ‘গ্রেট ডিক্টেটরটা সাধনকে একবার দেখিয়ে দাও তো।’ জহর কোনও ইতঃস্তত না করেই উঠে দাঁড়িয়ে চার্লি হয়ে গেলেন।
মুগ্ধ সাধন সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণবাবুকে বলেন, ‘নারাণদা সম্ভব হলে জহরবাবুর এই গ্রেট ডিক্টেটর সাহারায় পার্টির দৃশ্যে ফিট করে দিন না।’ হয়েছিলও তাই।
জহর রঙ্গশ্রীর সভ্য হওয়ার পর একদিন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়েরই লেখা ‘রামমোহন’ নাটকের মহলা চলছে। রামমোহনের জীবন নিয়ে নাটক ভারতবর্ষে সেটাই প্রথম। জহর পেয়েছিলেন ডেভিড হেয়ারের চরিত্র। ছোট্ট রোল। কিন্তু ওইটুকু পার্ট কী যত্ন করেই না করতেন জহর! পারফেক্ট করার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন। পার্টের একটা জায়গায় ঠিক সাধন সরকারের মতো করে বলতে চাইতেন তিনি। আর সেটা শেখার জন্য রোজ সকালে এক ঠোঙা জিলিপি হাতে সাধনের বাড়ি পৌঁছে যেতেন জহর। তাঁকে ডেকে এনে ক্লাব খুলিয়ে চলত ডেভিড হেয়ার হয়ে ওঠা আর জিলিপি খাওয়া।
রামমোহনের মহলা শেষে সাধন একদিন জহরকে ডেকে বলেন, ‘জহর তোমার কপালটা আর একটু চওড়া হলে ডেভিড হেয়ার ভালো মানাতো।’ সেই কথার কোনও উত্তর দেননি জহর। অভিনয়ের দিন মাথায় একটা ওস্তাদি টুপি পরে শ্রীরঙ্গমে এসে হাজি হলেন। সাধনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে টুপিটা খুললেন। জহরকে সেইরূপে দেখে সাধন তো অবাক! কপালের ওপরে অনেকটা অংশ কামিয়ে ফেলেছেন তিনি। সাধন কিছু বলার আগেই জহর বলে ওঠেন, ‘কপালকে চওড়া করে ফেলেছি। কী এবার ডেভিড হেয়ার লাগছে তো!’
আমাদের অনেকেরই ধারণা হাসি আমাদের জীবনে খানিকটা অতিরঞ্জিত বস্তু। যেন পানপাত্রে উপচে পড়া ফেনা। দেখতেই ভালো লাগে, কিন্তু ঠোঁটে তেমন প্রয়োজন নেই। একবার ভাবুন, ‘সুবর্ণরেখার’ মতো গম্ভীর ও বিষণ্ণ ছবিতে জহর রায় যদি নিয়তিতাড়িত হয়ে মুখুজ্জেবাবু রূপে ধরা না দিতেন, তাহলে ঋত্বিক ঘটকের মহাপ্রস্থানের পথ সুগম হতো কী! জহর রায় রূপী ওই মুখুজ্জেমশাই হলেন নরকের দেবদূত। তিনি না থাকলে যে বাংলা সিনেমার অনেক রান্নাই পানসে হয়ে যেত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
(ক্রমশ)