পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
ভি আই পি রোডে জোড়ামন্দিরের শাস্ত্রীবাগানের গৃহবধূ স্নিগ্ধা সাহা যখনই কোনও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তখনই তাঁর মাথায় উঠেছে বিজয়িনীর শিরোপা। ফ্যাশন শোয়ের র্যাম্প থেকে রিয়ালিটি শো, সর্বত্রই অন্যদের পিছনে ফেলে তিনি এগিয়ে, সবার আগে।
এখন অবশ্য তাঁর প্রতিযোগিতা তাঁর নিজের সঙ্গেই। রিয়ালিটি শোয়ের মঞ্চ নয়, এবার তিনি লড়াইয়ের জন্য নেমেছেন জীবনের মঞ্চে। শুরু করেছেন এমন একটা ব্যবসা, যে তল্লাটে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে হয় মহিলাদের। পুরুষদের দাপট সেখানে প্রবল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘At Your Service’। ট্যাগলাইন যার ‘আ হাউস অব সাপোর্টিভ ইন্সট্রুমেন্টস’। কী কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি?
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের জন্য সরবরাহ করে প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক অ্যাপ্লায়েন্স।
এমন জিনিস সরবরাহ তো অনেক প্রতিষ্ঠানই করে, তাহলে স্নিগ্ধা সাহার সংস্থার বিশেষত্বটা কী?
এই প্রশ্নে স্নিগ্ধার উত্তর, ‘ছোটবেলা থেকে নিজের পরিচিত এবং আশপাশে অনেক মানুষকে দেখেছি যাঁদের অস্থিক্ষয়জনিত সমস্যা এবং স্নায়ুর সমস্যা রয়েছে। শুধুমাত্র সাপোর্টিভ ইন্সট্রুমেন্টের অভাবে তাঁরা গৃহবন্দি হয়ে পঙ্গুর মতো জীবনযাপন করেন। ছেলে-মেয়েরা হয়তো বিদেশে থাকেন। তাই একলা নিঃসঙ্গ বয়স্ক বাবা-মায়েদের পক্ষে প্রয়োজনীয় হুইল চেয়ার, নানারকমের নি-ক্যাপ, বেল্ট, ওয়াকার, কমোড চেয়ার ইত্যাদি বাজার থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় অন্যের ওপর। তাই আমার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওই সমস্ত জিনিসগুলি একেবারে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া হয় অসুস্থ মানুষদের বাড়িতে।’
বোঝাই যাচ্ছে, অক্ষম অসুস্থ মানুষদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা আরাম দিতেই স্নিগ্ধার এই অভিনব উদ্যোগ।
আর সেই উদ্যোগের কথা মানুষের কানে পৌঁছে দিতে স্নিগ্ধার প্রচারপত্রে স্পষ্ট লেখা— ‘অ্যাট ডিফিকাল্ট টাইমস ইউ নিড আ স্পেশ্যাল সার্ভিস।’
পরের লাইনে আবার উল্লেখ করা হয়েছে— ‘উই ডেলিভার অর্থোপেডিক অ্যান্ড রিহ্যাব আইটেমস অ্যাট ইওর ডোরস্টেপ।’
বিপদের দিনে শারীরিক বাধাকে অতিক্রম করে নিজেদের জীবনযাত্রাকে মসৃণ করতে স্নিগ্ধার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মিলছে সমাধান।
তবে ইন্সট্রুমেন্ট কিনলেই যে স্নিগ্ধার পরামর্শ বা পরিষেবা মেলে তা নয়। বহু সমস্যার সমাধানে করণীয় কর্তব্য জানতে চাইলে, তাঁদের ব্যবহার্য উপযোগী জিনিসটি কী হতে পারে সেই পরামর্শ, সেই পথও বাতলে দেন এই মহিলা উদ্যোগী।
ঠিক যেমন কিছুদিন আগে উত্তর ভারত থেকে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন এক শিখ মহিলা। তাঁর স্বামী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সেই সেনাকর্মীর কর্মজীবনে পায়ে গুলি লেগেছিল। সমস্যার সূত্রপাত সেখান থেকেই। আজও তাঁর পা মাটিতে ফেলতে কষ্টবোধ হয়। পায়ের পাতাতে, গোড়ালিতে চাপ লাগলে যন্ত্রণা হয়। ভদ্রমহিলা জানতে চেয়েছিলেন এই অবস্থায় তাঁর স্বামীর উপশমের উপায় কী?
স্নিগ্ধা তাঁকে পরামর্শ দেন, গোড়ালিতে যদি তাঁর স্বামীর ব্যথাবোধ হয় তাহলে তিনি যেন হিল কুশান সিলিকন ব্যবহার করেন। আর যদি ব্যথা পায়ের পাতাতে ছড়ায়, তাহলে তাঁর দরকার ইনসোল ফুল সিলিকন।
সব শুনে ওই ভদ্রমহিলা স্নিগ্ধাকে বলেছিলেন, সমস্যা মিটলে তিনি আর ফোন করে বিরক্ত করবেন না। কিন্তু না মিটলে তিনি আবার ফোন করবেন। হাসতে হাসতে স্নিগ্ধা সেদিন তাঁর নিজের বাড়িতে বসে বলছিলেন, অনেকদিন হয়ে গিয়েছে ওই শিখ মহিলার ফোন আর পাইনি। ধরে নিতে পারি পরামর্শ বৃথা যায়নি।
আবার কলকাতার কাছেই ব্যারাকপুর অঞ্চলের একটি বাচ্চার ঘাড়-মাথা ঝুঁকে থাকত কাঁধের উপরে। মাথা সোজা রেখে সে চলতে পারত না। স্নিগ্ধা তাঁকে দিয়েছিলেন সারভিকাল কলার সাপোর্ট। এখন সে ঠিকভাবেই চলাফেরা করতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বলরাম সরকার ও মালবিকা সরকারের মেয়ে স্নিগ্ধার কৈশোর কেটেছে হালিশহরে। অন্নপূর্ণা বালিকা বিদ্যালয়, হালিশহর হাইস্কুল এবং তার পরে কাঁচরাপাড়া কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর বিয়ে হয় একটি নামী ওষুধ কোম্পানির ব্র্যান্ড ম্যানেজার মনোজ সাহার সঙ্গে। ব্যবসাতে স্নিগ্ধার মূল পরামর্শদাতা মনোজবাবুই। স্ত্রীকে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির অর্থোপেডিক যন্ত্রাংশ বিষয়ে সুলুকসন্ধান দেন মনোজ সাহা।
মাত্র এক বছর অতিক্রম করা স্নিগ্ধা সাহার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করার পর কলেজ স্ট্রিট পাড়ার অর্থোপেডিক অ্যাপলায়েন্সের অনেক পুরনো ব্যবসায়ীরা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। একজন মহিলা এই ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি না সেই নিয়ে নানারকমের মন্তব্য ছিল তাঁদের মুখে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী স্নিগ্ধার মনোবল তাতে কমেনি। আদ্যন্ত গৃহবধূ তাঁর দুই সহকারী অর্পিতা রায়চৌধুরী আর কৃশানু ঘোষ-এর সহযোগিতায় সংসারের নানা ঝক্কি সামলে ফোন পেলেই কড়া নাড়ছেন ক্রেতাদের বাড়ির দরজায়। বাড়িতে বসেই প্রয়োজনীয় অর্থোপেডিক ইন্সট্রুমেন্ট নাগালের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছেন অসুস্থ অক্ষম বয়স্ক মানুষরা।