পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
ইতুপূজা: বাংলার ব্রাহ্মণ্য সমাজে প্রচলিত লোকায়ত সূর্যোপাসনার মধ্যে ইতুপূজা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। হিন্দু শাস্ত্রবিধি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা কার্তিক মাসের শেষ দিন থেকে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে প্রতি রবিবার ইতুপূজার অনুষ্ঠান করে থাকেন। মাটি ভরা একটি সরাতে চারটি ছোট ছোট মাটির পাত্র রাখা হয় এবং মাটিতে ধান, যব, গম প্রভৃতি শস্যের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে তাতে জলের ছিটে দেওয়া হয়। প্রতি রবিবার ওই মাটিতে সামান্য জল দেওয়া হয়। পরে দেখা যায় বীজগুলি থেকে অল্প অল্প অঙ্কুর বের হচ্ছে। চারটি মাটির পাত্র সূর্যসৃষ্ট চার ঋতু ও মৃত্তিকাপূর্ণ বৃহৎ পাত্রটি সূর্যশাসিত পৃথিবীর প্রতীক।
অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ পূজার মাধ্যমে ইতুপূজার সমাপ্তি হয়। এদিন ব্রতীরা মাছ-মাংস খায় না, মাথার চুলে তেল দেয় না।
পুজোপকরণ হিসেবে দেওয়া হয় ফুল, দূর্বা, চন্দন, তিল, রোদে শুকনো ধান, হরীতকী প্রভৃতি। জলপূর্ণ মাটির পাত্রে ধানের শীষের গুচ্ছ ও কয়েকটি গোলাকৃতি মূল। ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো শুরু করে আগের পাত্রের উদ্দেশে পূজা-সামগ্রী অর্পণ করলে বিবাহিত ও কুমারী মেয়েরা সূর্যদেব সম্পর্কিত ছন্দোবদ্ধ স্তবক ও লৌকিক উপাখ্যান আবৃত্তি করে। এগুলির মাধ্যমে নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্ত লোকের ইতুপূজা সম্পাদনের প্রেক্ষাপট এবং পূজার ফলস্বরূপ সুখ-সমৃদ্ধি লাভের কাহিনী বর্ণিত হয়।
উপাখ্যান ও আবৃত্তির শেষে ব্রতীরা কবিতার মতো করে কতকগুলো কথা বলেন। তাতে বলা হয় এই কবিতা শ্রবণে নির্ধনের ধন হয়, অপুত্রের পুত্র হয়, কুমারীর স্বামী হয়, অল্প দৃষ্টিশক্তি পায়, নিঃসহায় ভগবৎ সাহায্য পায় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হয়।
এই ব্রতের একটি বিশেষত্ব হল, এই ব্রততে শিশুকন্যা ও মহিলারাই ব্রতী হয়, পুরুষরা অংশগ্রহণ করে না। একমাত্র মূল পুজোতেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত ধরা হয়।
মাঘমণ্ডল ব্রত: সূর্যদেবের উপাসনার মধ্য দিয়েই মাঘমণ্ডল ব্রত পালিত হয়। ঐহট্ট, পূর্ববঙ্গ, কাছাড় প্রভৃতি অঞ্চলের মেয়েরা মাঘ মাসে মাঘমণ্ডল ব্রত পালন করে। সারা মাঘ মাস ধরে পরপর পাঁচ মাস তারা এই ব্রত পালন করে। তিন-চার বছর বয়স থেকেই মেয়েরা এই ব্রত পালন শুরু করে। সূর্যোদয়ের আগেই মেয়েরা একটা পুকুরপাড়ে জমা হয় এবং একজন বয়স্কা মহিলার তত্ত্বাবধানে সূর্যস্তব করে। এই স্তবে তারা সূর্যের শৈশব, বয়ঃপ্রাপ্তি, বিয়ে ও পুত্রের জন্ম ইত্যাদি বর্ণনা করে এবং এর মধ্যে নিহিত থাকে ভবিষ্যতে বিয়ে হওয়া ও শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা। এই ব্রত পালনের সময়ে বাড়ির অন্তরে পূর্ব-গগন সূর্যের প্রতীকরূপে একটি ছোট বৃত্ত খনন করা হয় এবং পশ্চিমাকাশী চন্দের প্রতীকরূপে একটি অর্ধবৃত্তও থাকে। সূর্যের স্তব শেষে মেয়েরা বাড়ি ফিরে বৃত্তের ধারে বসে সংক্ষিপ্ত একটি মন্ত্রোচ্চারণ করে অনুষ্ঠান শেষ করে। প্রতিবছর একটি নতুন বৃত্ত সংযোজন করতে হয় এবং ভিন্ন রঙের চূর্ণ দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে রং করতে হয়। পাঁচটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হলে বৃত্তসমূহের পাশে বসে বিশেষ ধরনের মিষ্টদ্রব্য খেয়ে ব্রতী-কুমারী চূড়ান্ত অনুষ্ঠান শেষ করে। মিষ্টদ্রব্যের অধিকাংশ মাথার উপর ছুঁড়ে দেওয়া হলে উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে তা সংগ্রহের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এই ভাবেই পাঁচ বছরের মাথায় মাঘমণ্ডল ব্রতের পালন শেষ হয়।
মাঘমণ্ডল ব্রত আসলে আগেকার দিনের সূর্য আরাধনার এক জনপ্রিয় নারী-সংস্করণ মন্ত্র বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। হিমেল আবহাওয়া, বিশেষত মাঘ মাসের হাড় কনকনে ঠান্ডাকে অগ্রাহ্য করে কাকভোরে ওঠার মানসিক অভ্যাস গঠনই এই ব্রতের মুখ্য উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয়।
চুঙ্গীর ব্রত: অগ্রহায়ণ মাসের রবিবারে পূর্ববঙ্গের গৃহলক্ষ্মীরা এই ব্রত পালন করেন। এই ব্রতে নলের চোঙায় একুশটি দূর্বাঘাস ভরে এবং দুধ দিয়ে তা স্নান করিয়ে সূর্যদেবকে নিবেদন করা হয়। এই ব্রতে যে লৌকিক উপাখ্যান গাওয়া হয় তা ইতুপূজার উপাখ্যানের অনুরূপ।
‘সিং বোঙা’ ও ‘ধরম’: আদিবাসীদের মধ্যেও সূর্যদেবের আরাধনার প্রচলন আছে। তাঁরা ‘সিং বোঙা’ ও ‘ধরম’ ব্রতের মাধ্যমে সূর্যদেবের উপাসনা করে থাকেন। তবে তাঁদের বিশ্বাস সূর্যদেব কল্যাণকারী হলেও কিছু অনিষ্টকর দেবসমূহের কাছে একেবারে অসহায়। সম্পূর্ণ খোলা জায়গায় সূর্য-পুজোর আয়োজন আদিবাসীদের সূর্যপুজোর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আদিবাসীদের সূর্য-পুজোয় শ্বেতবর্ণের পশুবলি দেওয়া একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকালের জনপ্রিয় দেবতা সূর্যদেবের একক পুজো, মূর্তি বা মন্দির নির্মাণ আজকাল আর নেই বললেই চলে, তবে সগৌরবে সূর্য প্রণাম ও লৌকিক ব্রত বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সূর্যদেবের আরাধনায় আজও ছেদ পড়েনি। এক্ষেত্রে নারীরাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে।