পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
‘একা! একা কেন হব? মা তো থাকবে আমার সঙ্গে।’ টিউশন ক্লাস থেকে রাত করে ফেরার পথে কিশোরী কন্যার রক্ষাকবচ হিসেবে মধ্য যৌবনা মায়ের উপস্থিতি কি যথেষ্ট? প্রশ্নটা সেখানেই। বহু যুগ ধরেই ঘরে ও বাইরে নারীর নিরাপত্তা ঘিরে এমন প্রশ্ন উঠছে। আর এই নিরাপত্তাহীনতার ফাঁক গলে নারীর শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা কোনওটাই প্রবেশ করতে পারছে না। শিক্ষিত ও স্বনির্ভর নারী তবু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এই চিত্রটা শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই মোটামুটি একইরকম।
নারী নিরাপত্তার উপায় সেক্ষেত্রে কীরকম হতে পারে? এই বিষয়ে ইউনিসেফের উইমেন’স সেলের আধিকারিকের বক্তব্য, প্রথমত নারীর কণ্ঠস্বরকে জোরদার করতে হবে। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েদের উপস্থিতি গৌণ। তাই তাদের কথার ততটা গুরুত্ব নেই। যতদিন মেয়েদের কথা পুরুষের সমান গুরুত্ব না পাবে ততদিন নারী নিরাপত্তার ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্নটা ঝুলেই থাকবে। মেয়েদের কথা না শোনার প্রবণতাটা সেই ছোটবেলা থেকে শুরু হয়। প্রথম যখন বাচ্চা মেয়েটার গায়ে কাকা বা মামা স্থানীয় পুরুষটির অবাঞ্ছিত আদুরে হাত পড়ে এবং সেই কথা মাকে বললে মা ধমক দিয়ে মেয়েকে বলেন, ‘ছিঃ তোমার কাকু...কত ভালোবাসে তোমায়...।’ তখনই নারী নিরাপত্তার গায়ে প্রথম আঁচড় লাগে। ছোট্ট মেয়েটি হয়তো মায়ের বকুনি বা বাবার অবিশ্বাসের চাউনির ভয়ে নীরবে মেনে নেয় কাকা বা মামার অবাঞ্ছিত আদর। এরপর রাস্তাঘাটে নির্যাতনের মুখে পড়েও অনেক সময় মেয়েরা সামাজিক কটাক্ষের লজ্জায় সরব হওয়ার সাহস পায় না। সাধারণত নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হলে মেয়েটির দিকেই সমাজের আঙুল ওঠে। ক্রমশ নির্যাতন সহ্য করতে করতে মেয়েটি বড় হয়ে যায়। বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে। তারপর কখনও স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার অসহ্য হলে সে বিষয়ে বাপের বাড়িতে বলতে এসেও ফল পায় না। অনেক মা বাবাই মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন নিজের কন্যাটিকেই। কারণ সমাজের চোখে আজও মেয়ের বাড়ির তুলনায় ছেলের বাড়ির জোর বেশি। বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধে যতই কড়া আইন আনা হোক না কেন, সমাজ আজও স্ত্রীর থেকে স্বামীর কথার গুরুত্ব দেয় বেশি।
তাহলে কি নারীর এই নিরাপত্তাহীনতা কোনওদিনই কাটবে না? সামাজিক অগ্রগতি সত্ত্বেও ঘরে বাইরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে মেয়েরা? ইউনিসেফের আধিকারিকের বক্তব্য, নারী জীবনে নিরাপত্তা আনার জন্য আমাদের সমাজকে একটু ভাবতে হবে। কোনও মেয়ে যখন নির্যাতনের নালিশ নিয়ে পুলিসের কাছে যায় তখন সেই নালিশের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সঠিক পদক্ষেপ তো নেওয়া হয়ই না, উল্টে মেয়েটিকে বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। সমাজের এই মনোভাব যতদিন না বদলাবে ততদিনই নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।
মেয়েদের বিরুদ্ধে এই যে কটাক্ষ বা বিদ্রুপ তার কারণ বেশিরভাগ পুলিস থানা বা অন্যান্য আবেদনকেন্দ্রই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। ফলে মেয়েদের কথা, তাদের অভিযোগ সবসময়ই পুরুষের কাছে গিয়ে পড়ে। আর তখনই পক্ষপাত বা কটাক্ষের প্রশ্ন ওঠে। তাই এই পক্ষপাত এড়াতে মহিলাদের শীর্ষে রেখে যদি কিছু অভিযোগকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় তাহলে নারী নিরাপত্তা বিষয়টি সমাজের চোখে বেশি গুরুত্ব পাবে। শহরে ও গ্রামে বা মফস্সলে যত তাড়াতাড়ি এমন নারী কেন্দ্রিক অভিযোগকেন্দ্র গড়ে তোলা যাবে ততই নারী নিরাপত্তা বিষয়টি সমাজের চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকাও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন কিছু প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার যেখানে নারী নিরাপত্তার বিভিন্ন প্রসঙ্গ বারে বারে তুলে ধরা যায়। নারী নিরাপত্তার নানা দিক যত বেশি সমাজের সামনে উত্থাপিত হবে ততই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমন বিভিন্ন এনজিও রয়েছে যারা মহিলাদের নিয়ে কাজ করে, সেইসব এনজিওগুলোকেও আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। লাঞ্ছিত মহিলাদের কথা তাদের মারফতও উঠে আসতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ার আয়নায়। মোটমাট নারীকে বোঝাতে হবে তারাও এই সমাজের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে। মেয়েদের সসম্মানে বাঁচার অধিকার না থাকলে তা সমাজেরই ব্যর্থতা। তবে ঘরে ও বাইরে নারী নিরাপত্তা আরও দৃঢ় করার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার নারীর সচেতনতাবোধ। মেয়েদের বুঝতে হবে লাঞ্ছিত হয়ে মাথা নিচু করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। বরং মাথা উঁচু করে নির্যাতনের প্রতিবাদ করাই এ যুগের মেয়েদের ধর্ম।
তাই নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হন। অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এভাবে নিজেই হয়ে উঠুন নিজের রক্ষাকবচ। আর দোহাই মায়েদের, ছোট থেকে কন্যাসন্তানটিকে মানিয়ে নিতে শেখাবেন না।