ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা জুঁই ফুলের মতো সাদা ধবধবে ভাত। পাশে গোল করে সাজানো বাটিতে হরেক কিসিমের সুস্বাদু পদ। কী নেই তাতে। সোনা মুগের ডাল, আলু পটলের ডালনা, ইচর চিংড়ি, মোচাঘণ্ট, পাঁচমিশেলি তরকারি, ঝুরো পোস্ত, ধোকার ডালনা, পাকা রুইয়ের কালিয়া, ভেটকির পাতুরি, আড় মাছের রসা, লইট্যার ঝুরি, পার্শের ঝাল, ধনেপাতার সবুজ ট্যাংরা, কই মাছের হর-গৌরী, ভাপা চিংড়ি, কচি পাঁঠার ঝোল, কচি আমের চাটনি। আলাদা থালায় উঁকি মারছে ঝুরি আলু ভাজা, বেগুনি সহ বেশে কিছু ভাজাভুজি। পাশ থেকে আরও একটা থালায় সুচারুভাবে সাজানো রসগোল্লা, সন্দেশ, পান্তুয়া, রাবড়ি আর মিষ্টি দই।
জামাই ষষ্ঠী মানেই প্রচণ্ড আয়োজন। এ দিনটা পুরোপুরি জামাই আদরের দিন। সঙ্গে থাকে জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় শাশুড়ি মায়ের ষষ্ঠীর ব্রত। মা ষষ্ঠী মাতৃত্বের প্রতীক। যদিও এই ষষ্ঠী পুজোর সঙ্গে রয়েছে লোকাচারের কাহিনী। কাহিনীটি হল একটি যৌথ পরিবারের ছোট বউ রোজ খাবার চুরি করত আর একটা কালো বিড়ালের নামে দোষ দিত। বিড়ালটা এর প্রতিশোধ নিতে বউটির বাচ্চা হলেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে রেখে আসত। পরে বউটি সব জানতে পেরে দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মা ষষ্ঠী তাঁকে ক্ষমা করেন এবং বলেন, এইদিন তার পুজো করতে হবে। শুধু তাই নয় কালো বিড়ালকে তাঁর বাহন হিসেবে সম্মান করতে হবে।
কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার পরে কন্যার সন্তান প্রাপ্তির আশায় মা ষষ্ঠীকে খুশি করে পুজো দেওয়ার প্রথা যেমন প্রচলিত তেমনি জামাইকে আদর করে খাওয়ানো, যত্ন, ভালোবাসায় সম্মান জানিয়ে তুষ্ট করা। এই বিশ্বাস থেকে যে, জামাই যেমন আদর পাবে, মেয়ে ততটাই সুখী হবে। সেই কারণেই বোধহয় রক্ষণশীল পরিবারে শাশুড়ির নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানোটা একদম জরুরি।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠীর তিথিতে মেয়েদের বাবার বাড়ি জামাই আপ্যায়নে সরগরম। কী শহর, কী গ্রাম জামাই ষষ্ঠী প্রথাটা সামাজিক বন্ধন এবং লোক সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের মেজাজেই পালিত হয়। সদ্য বিবাহিত থেকে আশি পেরনো জামাই রীতিমতো সেজেগুজে ধুতি অথবা পাজামা, পাঞ্জাবি পরে গায়ে এসেন্স ছড়িয়ে দিব্য হাজির হন শ্বশুরবাড়িতে।
তবে যুগ বদলেছে। তাই মেয়ের সুখের জন্য জামাইকে খুশি করার পাশাপাশি কেমন হয় যদি বাড়ির বউদের জন্য পালিত হয় বউমাষ্টমী বা বউমাষষ্ঠী। মেয়ের মা যদি জামাই মেয়েকে সুখে, শ্যামশীতলে রাখবে ভেবে জামাই পার্বণে মাতেন তাহলে ছেলের পরিবারের লোকজনও তো ভাবতে পারেন যে নিজের ছেলেটাকে এই বউমা‌‌ই তো রেঁধে-বেড়ে খাইয়ে সোহাগে রাখেন। অতএব এই সংখ্যালঘু বউমাদের জন্য একটা দিন বরাদ্দ হলে ক্ষতি কোথায়।
তরুণ চিত্রপরিচালক সায়ন বসুর কথায় আমাদের দেশে জামাইষষ্ঠীই তো শুধু নয়। ভাইফোঁটা, কড়োয়াচৌথ, ষষ্ঠী পুজো এই সমস্ত কিছুতেই মেয়েদেরকেই যাবতীয় নিয়ম পালন করতে হয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো নেই। এটা ভারতীয় তথা হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি। আমরা যদি ওয়েস্টার্ন কালচারের দিকে তাকাই তাতেও নানান উৎসব আছে উদযাপন আছে। যেমন, খ্রিসমাস, ইস্টার, থ্যাঙ্কস গিভিং তাতে কিন্তু এইরকম একপেশে নিয়ম কিছু নেই। ওখানে সমানভাবে সবাই উপভোগ করে সবকিছু।
সেই জিনিসটা এখানে হওয়া খুব দরকার। তাই ষষ্ঠী হতে পারে কিন্তু সেটা শুধু জামাইকেন্দ্রিক কেন? বউদের নিয়েও হতে পারে এবং হওয়া দরকার।
অভিনেত্রী বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ের মতে, জামাইষষ্ঠী বা বউমাষষ্ঠী এসবের কোনও প্রয়োজনই নেই। আমি মনে করি প্রত্যেকদিন যদি ছেলের পরিবারের লোকেরা বউমাকে আর মেয়ের পরিবারের সবাই জামাইকে সম্মান করে ভালোবাসে তাহলে আলাদা দিনের খাতির-যত্নের মাধ্যমে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কোন দরকার পড়ে না। এমনিতেই তা বজায় থাকবে। জামাইষষ্ঠী বা বউমাষষ্ঠীর জন্য কোনও বিশেষ দিন, আপ্যায়ন এসব কিছুই বাহুল্য হয়ে দাঁড়ায়।
বহুজাতিক সংস্থায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদে কর্মরত তরুণ আকাশদীপ দত্তের মতে— এই প্রজন্মের মানুষ হিসেবে আমি নারীপুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী। তাই চাই যে সবকিছু সমান সমান হোক। যেমন আমি কখনই আমার উডবিকে বলব না যে সে তার পদবি বদল করুক। বরং উল্টোটাই বলব। আমার পদবি আমার কাছে থাক তার পদবি তার কাছে থাক।’ সেই দিক থেকেই বলব জামাইষষ্ঠী হলে বউমাষষ্ঠীও হোক। যে আদরটা বছরে একবার জামাইরা পাচ্ছে সেই আদর, তোয়াজ সম্মান, সম্ভ্রম, রসেবসে খাওয়া সবটাই বউমারাও পাক। আজকের এই উত্তর আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে যে কোনও আনন্দ উদযাপন ছেলেমেয়ে অথবা নারী-পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হওয়াটাই খুব জরুরি বলে আমি মনে করি।
অ্যামিটি ইউনিভার্সিটির আকাদেমিক কাউন্সিলর সদ্য বিবাহিতা ত্রিজিতা চক্রবর্তীর কথায়— যে কোনও প্রথা একটা সংস্কৃতিকে বহন করে। এবং সেটা যদি ক্ষতিকারক না হয় সেটা উঠে যাওয়ার বা বন্ধ হওয়ার কোনও মানে নেই। অনেকেই জামাইষষ্ঠীর সঙ্গে নারীর সাম্যের কথা তুলে বউমাষষ্ঠীর কথা বলেন। আমার মনে হয় সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা প্রথা বন্ধ করে বা পাশাপাশি বউমাষষ্ঠী শুরু করলেই নারীরা সমান হবে বা একধাপ ওপরে উঠল এমন হয়ও না, হতেও পারে না। বরং জামাইষষ্ঠী যেমন চলছে তেমন চলুক। জামাইষষ্ঠী আমার কাছে নিখাদ আনন্দের একটা উৎসব, উদযাপন। কর্মব্যস্ত সবাই এই উপলক্ষে একসঙ্গে হওয়া। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া, ঘোরা-ফেরা, কেনাকাটা নিয়ে নির্ভেজাল হুল্লোড়ে মেতে ওঠা। তবে এর সঙ্গে কমন ও যদি বউমাষষ্ঠী সামাজিকভাবে চালু হয় তাহলে আর একটা আনন্দের দিন বেড়ে যায় এই আর কি। তবে বউমাষষ্ঠী পালন করতেই হবে বা পালন না হলে গেল গেল ব্যাপার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
এতো গেল জেনারেশন ওয়াই-এর মতামত। কীভাবে তারা দেখছে এই নতুন বিষয়টিকে। তবে ইতিহাস পরিবর্তনের পথে চলে। আর ইতিহাসে আমরা বার বার দেখেছি যুগের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে সমাজ কীভাবে পুরনো আচার অনুষ্ঠানগুলোর সংশোধন করে নেয়। ষষ্ঠী সন্তানের কল্যাণের জন্য পালনীয় একটি ব্রত, কন্যার ভবিষ্যৎ জীবনের ভালো থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন মা, ষষ্ঠী ব্রতের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন জামাইয়ের আদর, আপ্যায়ন আর ভুরিভোজনের আয়োজন দিয়ে তেমনি ছেলের ভালোথাকা নিশ্চিত করতে আগামীদিনে সচেতন ছেলের পরিবার ও যদি আয়োজনে, আপ্যায়ন আর আদরে সাড়ম্বরে শুরু করেন বউমাষষ্ঠী বা বউমাষ্টমী তাহলে এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। তাই না? কী বলেন আপনারা?
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক