উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
১) ট্রাম্পের আমলে নতুন করে ভারত অসম বাণিজ্যিক যুদ্ধের মুখোমুখি। এর প্রধান কারণ অবশ্যই সদ্য ঘোষিত জেনারেল সিস্টেম অব প্রেফারেন্স থেকে ভারতকে বাদ দেওয়া। এর ফলে কমবেশি আরও দু’হাজারটি পণ্য রপ্তানি বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মোদিজি প্রতিক্রিয়া কী—তা এখনও স্পষ্ট নয়। ভিসা-বিতর্ক, ইরান থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার পর জিএসপি—একের পর এক মার্কিন আঘাত হজম করেও মার্কিন তোষণ-নীতি থেকে ভারত বেরিয়ে আসতে পারেনি।
২) চলতি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ধোনির গ্লাভসে ভারতীয় প্যারা স্পেশ্যাল ফোর্সের চিহ্ন—বিতর্ক নিয়ে যখন ভারত-পাক তরজা উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তখন পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর পরই মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি অনেকটা যেন আত্মবিশ্বাসী মহারাজের মতো দুপা বাড়িয়ে মৃদু ব্যাকলিফ্ট থেকে হাফ ভলিতে বাউন্ডারি হাঁকালেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এতে আমরা ভারতের নতুন কৌশলী চালের ইঙ্গিত পাচ্ছি।
প্রথমত, আমেরিকা যখন ভারতের ওপর খানিকটা আক্রোশবশত চাপ বাড়াতে চাইছে, যার অন্যতম কারণ হল যাতে ভারত মস্কো থেকে সফিসটিকেটেড মিসাইল প্রতিরক্ষা—প্রযুক্তি এস৪০০ না কেনে, তখন সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে আমরা দেখলাম মোদিজি নেতৃত্বে ভারতের বিদেশমন্ত্রক তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিল দক্ষিণ এশিয়ায় তার একান্ত নিজস্ব প্রতিবেশী এলাকায়।
দ্বিতীয়ত, মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের অভিনব দিকের সূচনার দিক থেকেও মোদিজির এই সফরকে দেখা যেতে পারে, তা হল বিশ্বকাপের আবহে এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রিকেটীয় যোগসূত্র স্থাপন, যা নিয়ে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে সফল কূটনীতির জায়গাটা হল ক্রিকেটীয় সম্পর্ক। কারণ, আফগানিস্তানের কয়েকজন প্লেয়ার আইপিএল-এ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তা ছাড়া তাঁরা গ্রেটার নয়ডা ও দেরাদুনে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাচ্ছেন। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের পারসেপশনস হল—ভারতের জন্যই তাঁরা আইসিসি থেকে টেস্ট খেলার ছাড়পত্র পেয়েছেন। কৌটিল্যের মণ্ডল তত্ত্ব অনুযায়ী, পাকিস্তানকে চাপে রাখতে ভারতের আফগান যোগসূত্র বিশেষ করে ক্রিকেট কূটনীতি দারুণ কাজ করেছে। এখন প্রশ্ন হল, মালদ্বীপের অবস্থান, বিশেষত বিরূপ জলবায়ুর কারণে যখন দ্বীপরাষ্ট্রের অনেকটা জমি ক্রমশ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে তখন নতুন করে ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসির ভবিষ্যৎ কী—বলা বেশ কঠিন। তবে, মোদি-সোলি যোগাযোগ যে এই জনপ্রিয় ক্রিয়ার আস্বাদনকে আরও প্রসারিত করার অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে তা বলাই বাহুল্য। উপদেশীয় ক্রিকেট উত্তেজনার ইমপালস মোদিজি ভালোই বোঝেন। তবে, মালদ্বীপে ক্রিকেট কূটনীতি হয়তো পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়ানোর জন্য ততটা নয়, যতটা-না শ্রীলঙ্কাকে বার্তা দেওয়া।
তৃতীয়ত, মালদ্বীপ মানেই আমরা ইতিমধ্যে যা দেখেছি তা হল রাজনৈতিক জমি দখলের জন্য চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব। এর কারণ অবশ্যই মালদ্বীপের অবস্থানগত গুরুত্ব। তবে শুধু মালদ্বীপই নয়, ভারতের পাখির চোখ রয়েছে মরিশাস ও সিসেলসকে কেন্দ্র করে, কারণ চীনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নৌ-সংঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে তার নিজস্ব উপকূল থেকে এই প্রসারিত ক্ষেত্র তার প্রতিরক্ষাকে মজবুত করবে। রাষ্ট্রদূত ভদ্রকুমার মেল কুলানাগারার মতে, ভারতের বিদেশ নীতি একদিকে যেমন বহুদিন পর্যন্ত ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের তাৎপর্যকে গুরুত্ব দেয়নি, তেমনি পরের দিকে ভারত-মহাসাগরের যে বৃত্ত—তার উপরিভাগের ভূ-মণ্ডলকে সে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। মালদ্বীপ কিন্তু এই বৃত্তের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে অবস্থান করছে। সুতরাং ভিয়েতনাম যেমন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ঠিক তেমনি ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে মালদ্বীপ হয়ে উঠতে চলেছে ভারতের ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এ প্রসঙ্গে এ-কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে মোদি ২০১৫ সালে উচ্চাভিলাষী ‘সাগর ডকট্রিন’ ঘোষণা করেছিলেন। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল চীনকে আটকানো। কারণ, দক্ষিণ চীন সাগরে কিছুটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে চীন চাইছে ভারত মহাসাগরে প্রভাবের ক্ষেত্র বাড়াতে।
সুতরাং মোদিজির এই দ্বীপপুঞ্জ-সফর কেবলমাত্র হাসি বিনিময় ও করমর্দনের রাজনীতি হবে না, বরং এর প্রধান অ্যাজেন্ডাই হল প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মজবুত করা। তবে সেটা করতে গিয়ে ভারত যেন দ্বীপপুঞ্জের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযথা হস্তক্ষেপ না করে বসে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ভারত মালদ্বীপকে সন্ত্রাসবাদের নয়া ‘আঁতুড়ঘর’ হতে দেবে। কারণ ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকী মধ্যপ্রাচ্য থেকেও জেহাদি নেটওয়ার্কের কারবার মালদ্বীপেও পৌঁছে গিয়েছে। এই র্যাডিক্যালিজমের একমাত্র দাওয়াই হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তার সহায়ক শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক স্থিরতা। তবে ঘরে-বাইরে উপর্যুপরি চাপের মুখে দাঁড়িয়ে মোদি সরকার কি পারবে দক্ষিণ এশিয়ার সুদূর বিস্তৃত অঞ্চলে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আবহাওয়া তৈরি করতে? সার্কের ভবিষ্যৎ কিন্তু বিশবাঁও জলে। আবার মালদ্বীপের দিকে দৃষ্টি ঘোরানোর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে উত্তেজনার পারদ চড়বে না তো? এর উত্তর হয়তো দিতে পারবে একমাত্র ‘মোদি-ম্যাজিক’।