উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
ঘটনা যখন ঘটেছে তখন তার স্বপক্ষের অতিপরিচিত যুক্তিগুলো পেশ করে ফেলা যাক। নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, বিজেপির স্থায়ী সরকারের ডাক, প্রথম ইনিংসের কিছু সাফল্য, যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ, আরএসএস-এর বিপুল অবদান, বিরোধীদের জোট বাঁধার ব্যর্থতা, এবং বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, এই সমস্ত কারণ আগেই এসেছে। এরকম আরও একশো একটা বিষয় অল্প মাটি খুঁড়লেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভোটযন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিভিপ্যাট মিলে গেছে সাফল্যের সঙ্গে। ফলে সেখানে সাদা চোখে খুব জটিল কিছু অনুসিদ্ধান্ত আবিষ্কার করা শক্ত। আর এটা তো সত্যি যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সাংবাদিক ভোট পূর্ববর্তী খোঁজখবরে বারবার লক্ষ করেছেন বিজেপির অগ্রগতি। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় হয়তো নির্বাচনের আগে তাঁরা সে আলোচনা করেছেন চুপিসারে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও খুব পরিণত সাংবাদিকরা (এঁরা অনেকেই বিজেপির সমর্থক নন, সমালোচক) অনেকবার বলেছেন বিজেপি ক্ষমতায় আসবে দ্বিতীয়বার। দেশের সার্বিক উন্নয়ন অবশ্যই জনগণের সমর্থন অর্জন করার সবথেকে স্বাভাবিক উপায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই সোজা কারণটা মোটেও পুরোপুরি সত্য নয়। বিজেপির রাজত্বে উন্নতি হয়তো কিছু হয়েছে, কিন্তু তা তেমন কিছু চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো নয়। অর্থাৎ বাজপেয়ির বিজেপি বা মনমোহনের কংগ্রেস রাজত্বগুলোর থেকে খুব আলাদা কিছু নয় বর্তমান বিজেপির সাফল্য। তা সত্ত্বেও এই বিপুল জনমত। সেই জন্যেই মেনে নেওয়া দরকার নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের সঠিক কারণ খোঁজায় সমাজবিজ্ঞানের অসম্পূর্ণতা। যে দীর্ঘ সমীক্ষা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজেপি দ্বিতীয়বার সরকারে আসার আসল কারণ খুঁজে বার করা সম্ভব হতে পারত, তার পেছনে সময় এবং অর্থ খরচ হবে প্রচুর পরিমাণে। কোনও স্বাধীন, স্বশাসিত এবং নিরপেক্ষ সংস্থার ভোট মিটে যাওয়ার পর তাতে একগাদা টাকা ঢালার সম্ভাবনা কম। ভোটের আগে হয়তো সে সমীক্ষা করেছে বিজেপি নিজেই। সম্ভবত তাদের জানা আছে উন্নয়নের গল্প ছাড়াও বিশেষ কোন সূত্রগুলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মূল কারণ, যাকে কিনা ইংরিজিতে বলে রুট কঅস অ্যানালিসিস। কিন্তু সে খবর আমজনতা জানে না। ভোটে জিততে ঠিক কীভাবে কোন পথ নিতে হয় তা নিয়ে অবশ্যই প্রচুর গবেষণা করেছে বিজেপি, তাদের চিন্তনদল এবং সর্বোপরি আরএসএস। তবে সে বিজনেস সিক্রেট জনগণেশের সামনে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ নেই।
বিজেপি বিপুলভাবে জিতলেও, দেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত সব খবর কিন্তু ইতিবাচক নয়। এর মধ্যেই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় উঠে আসছে রেকর্ড বেকারত্বের তথ্য। শেষ পাঁচ বছরের হিসেবে দেশের আর্থিক উন্নয়নের হার নেমে এসেছে তলানিতে। সাধারণ হিসেব বলে ডানপন্থী অর্থনীতিতে এই অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু সংস্কারমূলক নীতি নির্ধারণ করা উচিত সরকারের। কিন্তু এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী আবার ঘোষণা করেছেন পনেরো কোটি কৃষকের কাছে বছরে ৬ হাজার টাকা করে পৌঁছে দেওয়ার কথা। এই নব্বই হাজার কোটি টাকা অবশ্যই দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের কাজে লাগবে। কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সব থেকে বড় কথা, বিজেপির যে বেসরকারিকরণ সংক্রান্ত ডানপন্থী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, তার সঙ্গে এই কৃষকদের খুশি করার আলগা বামপন্থী তত্ত্ব মেলে না। আর এই ঘোষণা তো নির্বাচনের আগেই হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, এপ্রিল মাসেই (আর্থিক বছরের শুরুতে) তো একদফা দুহাজার পৌঁছে যাওয়ার কথা। সে টাকা বণ্টিত হয়েছে কি? সেই বণ্টনের সাফল্য কতটা? নির্বাচনের জন্যে সে বণ্টন আটকে থাকলেও তা কবে শুরু হবে? সেই সমস্ত পরিসংখ্যান যাঁরা বিজেপিকে সমর্থন করেছেন তাঁরা পাবেন কীভাবে? আর এই নব্বই হাজার কোটি টাকা দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে চাঙ্গা করবে সেটাও খুব পরিষ্কার নয়। একদিকে পেট্রল ডিজেলের দামের ওপর কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, দাম বদলাবে যখন তখন; বিএসএনএল-এর মত রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বেসরকারিকরণের দিকে এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যে প্রচুর টাকা বিলোবে সরকার। এই ধরনের পাঁচমেশালি খিচুড়ি (মিশ্র ?) অর্থনীতিতে দেশ কতটা চাঙ্গা হবে তা বলবে ভবিষ্যৎ।
অর্থাৎ দেশের অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের মতই আপাতত বিজেপি চলছে চেনা পথে। বিশেষ নতুন কোনও খবর এখনও কানে আসে নি। তবে সবেতো দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হল। তাই অপরিচিত পিচে মোদি-শাহ জুটি শুরুতে একটু দেখেই খেলবেন। কিন্তু বারবার যে প্রশ্ন কুরে কুরে খাবে তা হল কর্ণাটকে এত তাড়াতাড়ি বিজেপি বিরোধীরা আবার জেগে উঠলেন কীভাবে? তাহলে কি বেঁচে গেল কর্ণাটকে কংগ্রেস-জেডিএসের জোট সরকার? তবে অন্য ধারার প্রশ্নকেও অস্বীকার করা শক্ত। কর্ণাটকের কংগ্রেস-জেডিএসের থেকেও বেশি পশ্চিমবঙ্গে পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের জয়জয়কার, কিন্তু লোকসভা ভোটে ফল ভিন্ন। তাহলে কি রাজ্য এবং কেন্দ্রের নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় ভোটপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ফল ভিন্ন হবে? সংসদীয় গণতন্ত্রে এর থেকে বড় বিপদ কিন্তু আর কিছু নেই। নির্বাচনী ফলের কারণ খোঁজার জন্যে সেক্ষেত্রে আর শব্দ খরচ না করলেও চলে।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত