উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ১৮টি আসন নিয়ে আশাতীত উত্থানের পর কোন প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার মানুষ মমতার উপর আস্থা রেখেছে? ক্ষমতা দখলের রাজনীতির কিছু ধূসর প্রেক্ষাপট আছে। যা সাদা চোখে দেখা যায় না। আমরা বুঝি শুধু কিছু সমীকরণ। রাজনীতির সোজা-সাপটা অঙ্ক। সেই অঙ্কে মমতার ভরাডুবিটাই আজ সামনে আসছে। ধূসর অংশে ঢাকা পড়ে রয়েছে অগ্নিকন্যা বিশেষণে ভূষিত বাংলার নেত্রীর প্রবল জনপ্রিয়তা। মানুষের মধ্যে কি ক্ষোভ নেই? আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। একটা সরকার যদি আট বছর রাজত্ব করে, তাহলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া তার গায়ে লাগতে বাধ্য। একজন কখনও সবার কাছে সমানভাবে প্রিয় হতে পারে না। আমাদের সমাজটাই হল দাঁড়িপাল্লার মতো। একজনের কাছে ভালো হতে গেলে অন্যজনের গোঁসা হবে। তৃণমূল সরকারের ক্ষেত্রেও হয়েছে। কিন্তু ৩৪ থেকে ২২টি আসনে নেমে যাওয়ার পর কয়েকটা বিষয় আমরা বিবেচনায় আনতে ভুলে যাচ্ছি। প্রথমত, গণিতের যে কোনও প্যাটার্নে ২২ সংখ্যাটি ১৮’র থেকে বেশি। তৃণমূল ২২টি আসন পেয়েছে। একটি-দু’টি নয়! দ্বিতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয়ের নেপথ্যে এখনও কিন্তু রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা। আজ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চাদরে ঢাকা পড়ে তৃণমূল দল কিংবা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও রাজ্যের সব প্রান্তে গ্রহণযোগ্য। যে তৃণমূল সমর্থকরা সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অভিমান থাকতে পারে নেত্রীর প্রতি। তা এখনও ক্ষোভের রূপ নেয়নি। তৃতীয়ত, এটা ছিল লোকসভা ভোট। দেশের সরকার গড়ার পরীক্ষা। কোনও একটা রাজ্যের নয়! রাহুল গান্ধী ভোটের বছর খানেক আগে থেকে যতই সিংহবিক্রমে বিজেপির বিরোধিতা করুন না কেন, ভারতবাসী দেখিয়ে দিয়েছে এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির কোনও বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী পদে এখনও কোনও নেতা বা নেত্রী তেমন জায়গা তৈরি করে উঠতে পারেননি। যদি বিরোধী মহাজোট বাস্তব রূপ পেত, তাহলে অবশ্যই একটা বিকল্প ভাবনা আসার সম্ভাবনা ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক আঞ্চলিক দলেরই নিজস্ব এজেন্ডা আছে। এ বলেন আমি প্রধানমন্ত্রী হব, তো সেটা শুনে আর একজন মাথা তোলেন... আমিও যোগ্য! পরিস্থিতি এমন হলে আর যাই হোক, জোটের স্বপ্ন সফল হওয়া সম্ভব নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের বিরুদ্ধে একের ফর্মুলাও তাই দিনের আলো দেখল না! উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি জোট গড়ল। কংগ্রেসকে নিল না। ফলে কংগ্রেস আলাদা প্রার্থী দিল। ভোট কাটাকাটি করে বিজেপির ঝুলিতে একগাদা আসন তুলে দেওয়ার রাস্তাও প্রশস্ত হয়ে গেল।
মোদি-ঝড়। ২০১৪ সালে যা ছিল স্বতঃপ্রণোদিত। ২০১৯ সালে পৌঁছে যা হয়েছে অনেক বেশি অর্গানাইজড। বছর খানেকের বেশি সময় ধরে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি এই ঝড়ের পথ বানিয়েছে। বাস্তবিকই এটা ছিল সোশ্যাল মিডিয়া নির্বাচন। বিজেপি অত্যন্ত কৌশলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং আর্থিক সঙ্গতির মানুষের জন্য আলাদা আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়েছে। তাতে চালানো হয়েছে নিঃশব্দ প্রচার। সরাসরি প্রশ্ন করলে অবশ্য বিজেপির পক্ষ থেকে সবটাই অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, গোটাটাই দলের রঙের বাইরে গিয়ে। আলাদা সংস্থা বা সংগঠন বানিয়ে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর দিয়েছিল। কিন্তু তারা বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। এবং অবশ্যই, মোদি ছাড়া অন্য কেউ স্থিতিশীল সরকার দেবে বলে দেশবাসীর মনে হয়নি। সেটাই এবারের মোদি-ঝড়ের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তার উপর, ইন্দিরা গান্ধীর মতো মুক্তিযুদ্ধ না থাকলেও মোদির সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং বালাকোট রয়েছে। পাকিস্তান বা জাতীয়তাবাদী ইস্যু চিরকাল ভারতের ভোটারদের ভালো খাদ্য। খুড়োর কলে জাতীয়দাবাদ ঝুলিয়ে বিজেপি প্রচার চালিয়ে গিয়েছে। আর এই বিপুল জয়।
নরেন্দ্র মোদি আর যাই হোন, ইন্দিরা গান্ধী নন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাংলায় জরুরি অবস্থা জারি করা তাঁর পক্ষে একটু মুশকিল। রাজ্যসভার যে সমর্থন এক্ষেত্রে তাঁর প্রয়োজন হবে, তা মোদি পাবেন না। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে সরকার ভেঙে দিলে ক্ষমতায় আসার মতো আত্মবিশ্বাস এবং বিধায়ক সংখ্যা প্রয়োজন। যার কোনও দিশা এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। শাসক দলের ১০০ বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন বলে যত ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তেমন বাজনাও আর কানে আসছে না। কারণ, সরকার ভেঙে বিধানসভায় অনাস্থা আনতে গেলে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন তৃণমূল বিধায়ককে বিজেপিতে যেতে হবে। সেটা এই মুহূর্তে খুব সম্ভব কি? দু’বছর বাকি বিধানসভা নির্বাচনের। ধরে নেওয়া যাক, পশ্চিমবঙ্গের বহু এমএলএ গেরুয়া শিবিরের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরা যদি এখনই দল বদল করেন, তাহলে আগামী দু’বছর করেকম্মে খাওয়ার সুযোগ হারাবেন। আর তাঁদের দ্বিতীয় আশঙ্কার কারণ অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি প্রকল্প থেকে কাটমানি খাওয়া বা তোলাবাজি ঠেকানোর ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন তিনি। এভাবে যদি মমতা দলের ক্ষয়ে যাওয়া অংশগুলিকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন, মানুষ আবার তাঁকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।
সবচেয়ে বড় কথা, বিধানসভা ভোটটা হবে কিন্তু মমতাকে দেখে। সেখানে নরেন্দ্র মোদি নগণ্য। কেন্দ্রে সরকার নির্বাচনের সময় ভোটারদের মনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হয়তো কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি তো আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্বের জন্য লড়াই করবেন না! তাহলে বিজেপির মুখ কে? তিনি যেই হোন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে বেশি শক্তিশালী হবেন না। তাঁর জনপ্রিয়তাও মমতার মতো হবে না। এক বন্ধুর থেকে শোনা... ফাঁসিদেওয়ার একটি ভাতের হোটেলে বসে খাচ্ছিলেন। বাইরে বিজেপির পতাকা দেখে হোটেল মালিককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা এখানে কি সবাই বিজেপি হয়ে গিয়েছেন?’ ভদ্রলোক কিছু না বলে শুধু একটু হাসলেন। ডাকলেন তাঁর বউদিকে... ‘দেখুন, আমার বউদি, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যা। বিজেপির পতাকা যা দেখছেন, সব এই লোকসভা ভোটে। বিধানসভায় আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন।’
রাজ্যের বাস্তব চিত্র কিন্তু এখনও এটাই। এখন হাতি কাদায় পড়েছে। সময় ভালো যাচ্ছে না... বিরুদ্ধ ইস্যু তৈরি হচ্ছে, যা করতে যাচ্ছেন সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। আর সেই সুযোগে মাছিও তাকে লাথি মেরে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি দু’বছর পরও থাকবে তো? একটা সময় লোকসভা নির্বাচনে দলের মাত্র একটি আসন পেয়েও হারিয়ে যাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফিরে এসেছিলেন সসম্মানে। মহা পরাক্রমে। এবারও যদি তিনি ঘুরে দাঁড়ান, তাঁর বিরুদ্ধে খোল-করতাল বাজানেওয়ালাদের খুঁজে পাওয়া যাবে তো?