উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
—‘নাম?’
—‘নেত্রা রেড্ডি।’
—‘মাদ্রাজি?’
—‘তেলুগু।’
—‘তামিল!’
—‘তামিল না, তেলুগু।’
—‘ওই হল, তামিল আর তেলুগুতে কী আর পার্থক্য?’
—‘যতটা পাঞ্জাবি আর বিহারির মধ্যে।’
উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণের সীমারেখা। আর তার কারিগর আমরাই। আমাদের কাছে সাউথ ইন্ডিয়ান মানে মাদ্রাজি। দক্ষিণ ভারতের লোকজন নারকেল তেল খায়, অদ্ভুত ওদের উচ্চারণ, লুঙ্গি পরে বিয়েবাড়ি যায়... হাজারো আলোচনা। উত্তর ভারত মানে বিষম একটা নাক উঁচু ব্যাপার। আর দক্ষিণ মানেই রসিকতার খোরাক। তাই ওদের একটু ‘মানুষ’ করা দরকার। কীভাবে সেটা সম্ভব? হিন্দি শেখাতে হবে। ছোটবেলা থেকেই। দক্ষিণ ভারতের লোকজন হিন্দি তখনই পড়বে, যখন সেই ভাষা স্কুলে বাধ্যতামূলক হবে। ব্যাস! হাতিয়ার—ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি, ২০১৯। খসড়ায় ঘোষণা হল, তিনটি ভাষা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়তে হবে। সেগুলির মধ্যে হিন্দি ও ইংরেজি আবশ্যিক। তিন নম্বরটি যে কোনও আঞ্চলিক ভাষা। দ্বিতীয় ইনিংসের সূচনা থেকেই খানিক চালিয়ে খেলার ভাবনা হয়তো মোদির ছিল। তাঁর স্লোগানে আবার গত ভোট থেকে একটা মডিফিকেশন এসেছে। এখন আর ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ নয়’, এই মুহূর্তে ‘সব কা সাথ, সব কা বিশ্বাস’। উন্নয়ন চাই। সংস্কার চাই। এখন প্রশ্ন হল, বলিউডের সৌজন্যে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠা হিন্দি ভাষাকে গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা আদৌ কি সংস্কারের আওতায় পড়ে? পড়লে তা কী ধরনের সংস্কার? সামাজিক? নিন্দুকে কিন্তু এর নেপথ্যে পুরোপুরি রাজনৈতিক হাওয়া দেখছে। একজন বাঙালির সঙ্গে বিহারের বাসিন্দার যা তফাৎ, একই পার্থক্য তামিলের সঙ্গে তেলুগুর বা কন্নড়ের। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরল... সব তো আলাদা রাজ্য। আমরা ঐক্যের কথা বলি, কিন্তু বৈচিত্র্যকে বা জাত্যাভিমানকে সম্মান করি না। ২০০১ সালের সেনসাস অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১৬৩৫টি মাতৃভাষা রয়েছে। ১২২টি এমন ভাষা আছে, যা লিপিবদ্ধ করা হয়। এমন এক দেশে একটি মাত্র ভাষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে গেলে সেই প্রচেষ্টা ভাবাবেগে আঘাত করতে বাধ্য। মোদি সরকারের অতীত এবং বর্তমান, দুই পাল্লায় ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসির খসড়াটিকে বসালে একটা বিষয় অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে যেত... উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলি ছাড়া অনেকেই কিন্তু এই ‘চাপিয়ে দেওয়া’ নীতি মানবে না। আর হয়েছেও তাই। শুধু একটা খসড়া, আর তাতেই বিস্ফোরণ ঘটেছে দক্ষিণ থেকে পূর্ব ভারতে। নেতৃত্ব দিয়েছে অবশ্যই দক্ষিণ। হিন্দিকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাস কিন্তু কখনও সরকারের সঙ্গ দেয়নি।
* * *
রাজাজির না হয় একটা স্পষ্ট বার্তা ছিল, হিন্দি শিখলে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। কিন্তু এখন তো আর সে সমস্যা নেই! হিন্দি না শিখলেও ভারতের বহু প্রান্তে অনায়াসে চাকরি-বাকরি জুটে যায়। তাহলে ক্ষমতায় ফেরা মাত্র এমন একটা মিসঅ্যাডভেঞ্চারের মানে কী? প্রাথমিকভাবে জানানো হল, ক্লাস এইট পর্যন্ত তিনটি ভাষা শিখতেই হবে। হিন্দি, ইংরেজি এবং অন্য যে কোনও একটি স্থানীয় ভাষা। ১৯৬৫ সালে সাংবিধানিকভাবে হিন্দিকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা যে ধাক্কা খেয়েছিল, তা তো আর বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের অজানা নয়! তখন তো তাও আবার কেন্দ্রে ছিল মহাপরাক্রমী কংগ্রেস। পরপর দু’দফায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসা নরেন্দ্র মোদি নিজেকে সর্বকালের অন্যতম সেরা অকংগ্রেসি নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন ঠিকই, তাতে কিন্তু ভারতের ‘বৈচিত্র্যে’র বাস্তবটা বদলে যায়নি। পরিস্থিতি এমন একটা দিকে গড়াল যে, নরেন্দ্র মোদিকে তাঁর দুই হাইপ্রোফাইল মন্ত্রী অর্থাৎ নির্মলা সীতারামন এবং জয়শঙ্করকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়াতে হল (দু’জনেই দক্ষিণী)। এক সুরে তাঁরা লিখলেন, সবকিছু যাচাই না করা পর্যন্ত এই খসড়া নীতি চূড়ান্ত করা হবে না। যেখানে একটু বাস্তববাদী হলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না। বাস্তববাদী অবশ্য আমরা সেই অর্থে কেউই নই। খসড়া দেখে সংশ্লিষ্ট কমিটির জন্যও তেমন কিছু বিশেষণ ব্যবহার করা যায় না। ইসরোর নামজাদা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষানীতি নির্ধারক ওই প্যানেলের চেয়ারম্যান কৃষ্ণস্বামী কস্তুরীরঙ্গন তার উপর দাবি করেছেন, হিন্দি পড়া বাধ্যতামূলক করার জন্য যে সুপারিশ, সে ব্যাপারে কোনও চাপ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। এমনকী তাঁর কমিটির বানানো খসড়া নীতি নিয়ে দিকে দিকে এমন হইচই শুরু হয়েছে, সেটাও নাকি কেউ ফোন করে তাঁকে জানায়নি। খবর দেখে তিনি জানতে পারেন, বিষয়টাকে অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছে না। তাই তড়িঘড়ি বৈঠক করে একটা বিকল্প ভার্সান দেওয়া হয়েছে। তাতে হিন্দি শব্দটিকে তুলে দিয়ে শুধু ভাষার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দি শিখতেই হবে, এমনটা আর নেই।
নরেন্দ্র মোদি গত পাঁচ বছরে একবারও কিন্তু হিন্দুধর্ম বা আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে মুখ খোলেননি! কারণটা স্পষ্ট। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তিনি বিলক্ষণ জানেন, হিন্দুত্ব তাঁকে সরকারে টিকিয়ে রাখবে না। এটা তাঁর দলের আদর্শ হতে পারে, কিন্তু সরকার চালানোর ক্ষেত্রে এর কোনও বাড়তি ডিভিডেন্ড নেই। বরং অর্থনৈতিক এবং সংস্কারী পদক্ষেপ তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। তাহলে নতুন সরকার গঠন হতে না হতেই ‘হিন্দিস্তান’ জিগির উঠল কেন? তাহলে কি আরএসএস এবং বিজেপির একাংশ অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে? মোদির প্রথম জমানাতেও লাভ জিহাদ, গো রক্ষার নামে হিংসা, ঘর ওয়াপসি হয়েছে। সে সব নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তা সত্ত্বেও তিনি শুধু প্রশাসনিক আঙ্গিকেই বিষয়গুলিকে সামাল দিয়েছেন। দলীয় নেতা হিসেবে নয়। এটাই মোদির সাফল্য ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে কিন্তু বিজেপি বদলে গিয়েছে মোদি জনতা পার্টিতে। অর্থাৎ, হাওয়ায় পাতা নড়লেও তার দায় মোদিকে নিতে হবে। কেউ দেখবে না, বিজেপির কোনও অংশ বা তাদের চালিকাশক্তি আরএসএস তাঁর কোনও সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রয়েছে কি না। কাজেই হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার মতো মিসঅ্যাডভেঞ্চার আর না হলেই ভালো। হিন্দির যদি শ’দুয়েক বছরের ইতিহাস থাকে, তামিলের অতীত কিন্তু চার হাজার বছরের। তার গুরুত্ব খাটো করা যায় না। প্রধানমন্ত্রীকে আরও একটা বিষয়ে নজর দিতে হবে। তাঁর সৈনিক এবং সেনাপতিদের বক্তব্যে। রাজ্যপাল হওয়া সত্ত্বেও তথাগত রায় বলেছেন, বাঙালি মেয়েরা যদি মুম্বইতে গিয়ে ডান্স বারে নাচতে পারে, তাহলে হিন্দি শিখতে সমস্যা কোথায়? হিন্দি ভাষা কিন্তু হিন্দুত্বের প্রতীক নয়। সনাতন ধর্মের ধারক-বাহক নয়। যুগের পর যুগ ধরে ভারতের নানা প্রান্তে সনাতন ধর্ম এক এক রূপে মানুষের আত্মায় জায়গা করে রয়েছে। তার কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই। ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিতেই একটা দৃশ্য ছিল, যেখানে সব হকি খেলোয়াড় নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। বাকিরা সবাই নিজেদের রাজ্যের নাম বললেও শুধুমাত্র একজন এগিয়ে এসে বলেছিলেন, তিনি ভারতীয়। এটাই শেষ কথা। কোনও ধর্ম বা রাজ্য বা ভাষার নয়, সরকার ভারতের। আপামর ভারতবাসী নরেন্দ্র মোদিকে মাথায় তুলে ফের দিল্লির মসনদে বসিয়েছে। কোনও ভাষার জন্য নয়। ধর্মের জন্য নয়। তাঁরও পরিচয় একটাই হওয়া উচিত... ভারতবাসী।