ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
সৃষ্টি ও ধ্বংস, প্রকাশ ও বিনাশ, একই মহাশক্তির পরস্পর-সাপেক্ষ বিবিধ বিকাশ। বীজ-ধ্বংসে বৃক্ষের জন্ম, বাল্যের ধ্বংসে যৌবনের উদয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়া অমৃতত্বের আস্বাদন। ভারতীয় ঋষিদের ইহা অপরোক্ষ অনুভূতির বিষয়। ধ্বংসের মধ্যে তাঁহারা অনুপম সৌন্দর্য দেখিয়াছেন, অপার করুণা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।
সেই করুণাময়ী সৌন্দর্যময়ী ধ্বংসের মহাশক্তির বিগ্রহ মূর্তিই কালিকা। কেবল ধ্বংসের নহে, বিশ্বের সৃজন, পালন বিনাশকারী যাবতীয় শক্তিই কালিকাতে বিরাজিত। বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে যতগুলি ভাব অভিব্যক্ত হয় মানুষের কাছে, শ্রীকালিকাতে সে সকলই বিরাজমান। মহাপ্রকৃতির পরিপূর্ণ চিত্র কালিকা। এই স্বরূপ ভক্তের ধ্যাননেত্রে দর্শনীয়।
কালীর হস্ত চারিখানি। দুই হাতে পালন করেন, দুই হাতে নিধন করেন। বামদিকের খড়্গ এবং মুণ্ড ভীষণ ধ্বংসের চিহ্ন। দক্ষিণ দিকের দুই হস্তে বর ও অভয় মুদ্রায় পরম কল্যাণ প্রকটিত। এক হাতে আঘাত, আর এক হাতে সান্ত্বনা। এক হাতে ভীতি-প্রদর্শন, অপর হাতে সন্তানকে ক্রোড়ে ধারণ। এমন বিরুদ্ধতার অপূর্ব সমন্বয়, সামগ্রিকতার পূর্ণ অভিব্যক্তি—সমগ্র প্রাকৃতিক শক্তির এমন পূর্ণতম প্রতীক সারা বিশ্বে কুত্রাপি দৃষ্ট হয় নাই। দেবীর গলদেশ মুণ্ডমালায় বিভূষিত। মুণ্ড হইতেছে জ্ঞান-শক্তির আধার। জ্ঞানরূপ মুণ্ডমালায় মহাশক্তির কণ্ঠ বিভূষিত। মুণ্ডসংখ্যা পঞ্চাশৎ। ইহা পঞ্চাশটি সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক। বর্ণমালা শব্দ-ব্রহ্মের বহিরঙ্গ প্রকাশ। আর্যঋষি শব্দব্রহ্ম (Logos) তত্ত্বের গভীর তলদেশে বিচরণ করতঃ মহাশক্তির রত্ন উদ্ধার করিয়াছেন। কালিকার কণ্ঠে নরমুণ্ড সুগভীর মন্ত্রশক্তির প্রতীক চিহ্ন।
মায়ের পশ্চাতে আলুলায়িত কেশরাশি যেন একটি যবনিকা। পিছনটা ও মধ্যটা আমাদিগকে দেখিতে দিবেন না। “যাম্যেন চাভবৎ কেশঃ”—যমের শক্তি হইতে কেশ হইয়াছে। জীবনকে রহস্যময় করিয়া রাখিয়াছেন মৃত্যুর আবরণ দ্বারা কোন বৈচিত্র্যময় জগতের চরমতত্ত্বকে রহস্যাবৃত করিয়া রাখিয়াছেন।
কালিকাদেবীর অঙ্গবর্ণ কৃষ্ণ। সর্ব বর্ণের বিলয়-ভূমি কৃষ্ণই। অনন্ত অন্ধকারই কালীর যথার্থ রূপ। ঋগ্বেদ গাহিয়াছেন, “তম আসীৎ তমসা গূঢ়মগ্রে”, আদিতে অন্ধকার গূঢ়ভাবে লুক্কায়িত ছিল। আদিতে ছিলেন বলিয়াই তো তিনি আদ্যাশক্তি। আদ্যাশক্তি বলিয়াই তিনি অন্ধকার বর্ণা। পরমহংসদেব বলিতেন—“কালী কি কালো? দূরে তাই কালো। আকাশ দূরে তাই নীল, কাছে রং নাই।” মহাশক্তি নিরাকার তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা। কালী দিগম্বরী। দিক্-দেশ দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন বলিয়াই বিবসনা। দেশ-কালের বন্ধনে সীমাবদ্ধ নহে; অসীম তিনি, ইহা বুঝাইতেই দিগ্বসনা মূর্তি।
মৃত ব্যক্তির ছিন্ন হস্তদ্বারা একটি মেখলা। হস্ত কর্মশক্তির আধার। জীবগণের কর্মফল মহাকালের অবিদ্যার অংশে আশ্রয় লয়। ঐ কর্মফল-বশতঃই তাহাদের আবার জন্ম হইবে। জীবের অভুক্ত কর্মফল প্রলয়ে মহাপ্রকৃতির গর্ভে নিহিত থাকে। পরবর্তীকল্পে ভোগের নিমিত্ত। তাই মহামায়ার কটিতে নৃ-করমালা দোদুল্যমান।
জননী ত্রিনয়না। ত্রিনয়নে চন্দ্র, সূর্য এবং অগ্নি অন্ধকার-বিধ্বংসী এই তিন শক্তির বিকাশ। তিন নয়নে মাতা তিন কাল দেখেন। সত্য, শিব ও সুন্দরকে প্রত্যক্ষ করান। মায়ের বক্ষস্থিত উন্নত স্তন ক্ষীর-পরিপূর্ণ। এক স্তন দ্বারা জগৎ পালন করেন আর এক স্তন-ধারায় সাধকগণকে পরমা মূর্তির অমৃতাস্বাদন করান।
জননীর রক্তবর্ণ জিহ্বা রজোগুণের সূচক। শুভ্রতা সত্ত্বগুণের প্রতীক। শুভ্র-দন্তের দ্বারা রসনা দংশন করিয়া সাধকদিগকে সত্ত্বগুণের দ্বারা রজোগুণকে সংহত রাখিতে শিক্ষা দিতেছেন।
ব্রহ্মপুরুষ শিব চরণতলে থাকিয়া তিনিও যে মহাশক্তির অধীন তাহা বিজ্ঞাপিত করিতেছেন। পুরুষ শুধু অধ্যক্ষ বা দ্রষ্টা বা ঈক্ষণকারী। মহাপ্রকৃতি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডময় নিয়ত নৃত্যশীলা বা ক্রীড়া পরায়ণা। মহাশক্তির বাসস্থান শ্মশান। শ্মশান বলিতে শবের শয়ন স্থান। কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ বিশ্রাম স্থান শ্মশান। সেই শ্মশানে কালী বাস করেন। কল্পান্তে তাঁহার আশ্রয়ে সকলে বিশ্রাম পায়। আমাদের প্রাত্যহিক প্রলয়ে অর্থাৎ সুষুপ্তিকালেও আমরা যোগনিদ্রারূপিণী ঐ কালিকার স্নিগ্ধ শীতল ক্রোড়ে শান্তিলাভ করি।
ব্যাধি, সন্তাপ, বিরহ, বেদনা, উদ্বেগ সর্বতোভাবে মুছাইয়া দেন ঐ শ্মশানবাসিনী জননী কালিকা। জননীকে বলা হইয়াছে ভীষণ বদনা—“করালবদনাং ঘোরাং”—বিকট করালদংষ্ট্রা-সমন্বিতা। দেখিলেন মহাভীতির উদয় হয়।
সঙ্গে সঙ্গেই বলা হইয়াছে—“সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন-সরোরুহাম্”—সুখাতিশয্যা হেতু সুপ্রসন্ন বদনমণ্ডল। মুখপদ্মে মৃদু হাসি শোভমান।
একই কালে বিরুদ্ধতার নিরুপম সমাবেশ। আসুরিক শক্তির সহিত যুদ্ধের সময়—“চিত্তে কৃপা সময়নিষ্ঠুরতা—চ দৃষ্ট্বা”—এক অনির্বচনীয় ভাব। কালিকারূপিণী এই মহাশক্তি নিখিল বিশ্বের যাবতীয় নরনারীর পরমা জননী। ইনি প্রসবিত্রী, ধাত্রী, পালয়িত্রী।
ঈশ্বর স্রষ্টা, জীব সৃষ্ট—জীবেশ্বরের এই সম্বন্ধই পৃথিবীর সকল ধর্মশাস্ত্রে পাই। খ্রীষ্টধর্ম ঈশ্বরে পিতৃস্বরূপের ভাবও জানাইয়াছে। একমাত্র হিন্দু ঋষি ঈশ্বরে পরম মাতৃত্বের মূর্তি দর্শন করিয়াছেন। পিতা অপেক্ষা মাতার সঙ্গে পুত্রের সম্বন্ধ নিবিড়তর। মাতৃ-সম্বোধন অধিকতর প্রাণস্পর্শী এবং সান্ত্বনাদায়ক। ক্রীড়াক্লান্ত শিশু মাতৃবক্ষে আরাম ও বিশ্রান্তি লাভ করে। আর্য ঋষি পরমকারণকে কেবল মা বলিয়াই ক্ষান্ত হন নাই—বিশ্বের সর্বভূতে এ মাতৃত্বের প্রকাশ দেখিয়াছেন—“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।” মায়ের মূর্তির দিকে দৃষ্টি সম্পাত করিয়া ভক্ত সাধক দেখেন বজ্রকঠোর পুষ্পকোমল শাসন, গর্জন, পালন, পোষণ—অতি সৌম্য অতি রৌদ্র ব্রহ্মময়ী শক্তির এক করুণাস্নিগ্ধ বিরাট্ মাতৃত্ব। ইহাকেই অর্চনা করি। ইহারই চরণে ক্ষুদ্র আমিত্ব জলাঞ্জলি দিয়া, ইহারই ক্রোড়ে আরোহণ করিয়া হিন্দু ভক্ত-সাধক বিশ্বমানবকে ভাই বলিয়া সম্বোধন করে। সর্বভূতে মাতৃত্বের দর্শনে সাধক কামজিৎ হন। কামের বিনাশে প্রেমের উদয়। প্রেম আসিলে ক্ষুদ্রতা ঘুচিয়া যায়। মানব জাতির ঐক্য দৃঢ়তর হয়। আজ সমাজে সর্বধিক প্রয়োজন জাতীয় একতার। প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর তাই প্রার্থনায় কালীমাকে বলিয়াছেন—
“এস মা পাগলা কালী—
লয়ে প্রেমের ডালি—”