খুব কম লোকই এই ভগবৎ-রাজ্যে প্রবেশ করে, কারণ সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে খুব কম লোক। তাই গীতায় বলা হয়েছে: “কে আর পূর্ণ মুক্তি চায়?—মানুষের মধ্যে বোধহয় দু’একজন চায়।” অবশ্য আজও লক্ষ লক্ষ খ্রীস্টান নিয়মিত গীর্জাতে যান এবং লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে ও প্যাগোডাতে পূজা করতে যান। কিন্তু এদের খুব অল্প লোকই ভগবানের কাছে মুক্তি চায়। অধিকাংশ মানুষ বর্তমান জীবন নিয়েই খুশী; কেউ কেউ এ জগতে একটু নৈতিক জীবন যাপন করে এই আশায় যে, তাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মের ফলস্বরূপ পরজীবনে পুরস্কার পাবে। খ্রীস্টের পূর্ণতার আদর্শ হয়তো মানুষ ভুলে গেছে অথবা ভুল বুঝেছে। একথা সত্য, বহুলোক খ্রীস্টের শৈলোপদেশ পাঠ করে, কিন্তু খুব কম লোকই তা পালন করে। ভগবানকে দর্শন করা যায় কি না, পূর্ণতা লাভ সম্ভব কি না, অথবা সত্যকে জানার ব্যাপারে খ্রীস্টের কি অভিমত—এসব নিয়ে অধিকাংশ মানুষ তর্ক করে। কিন্তু আমি এটুকু বলতে পারি যে যখন খ্রীস্ট তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছিলেন তখন আক্ষরিক অর্থেই বলেছিলেন যে ইহজীবনেই ভগবদ্‌দর্শন সম্ভব। শিষ্যেরা ছিলেন তখন সত্যকে পাবার জন্য ক্ষুধার্ত, ভগবদ্‌দর্শনের জন্য ব্যাকুল এবং স্বর্গীয় পিতার ন্যায় পূর্ণত্বে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এহেন অধ্যাত্মপিপাসু সাধক কি করে ধর্ম তত্ত্ব, দর্শনশাস্ত্র, মতবাদ বা নীতিগত বিশ্বাসে সন্তুষ্ট থাকবেন? শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের বলতেন: তোমরা আম খেতে এসেছ; কি হবে আমগাছের ডাল পাতা গুণে? আম খাও এবং খিদে মেটাও। ঠিক একই ভাবে খ্রীস্ট তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন কি করে ভগবান লাভ করতে হয়, কি করে জীবন্মুক্ত হতে হয়। তিনি কখনও একথা বলেননি যে কেবল শরীরিত্যাগের পর মুক্তি লাভ সম্ভব। আমরা যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মসমূহের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাদের জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব যে তাঁরা সকলেই একই বাণী বিঘোষিত করেছেন: এখানে এবং এখনই ভগবান লাভ কর। ভগবান লাভের প্রধান বিঘ্ন মানুষের অলসতা ও অনুৎসাহ। বুদ্ধ বলেছিলেন যে বোধি লাভের মহা শত্রু হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। এবং খ্রীস্ট একই ভাবে বলেছেন: “লাঙ্গলে হাত রেখে যে পিছু ফিরে চায়, সে ঈশ্বরের রাজ্যের যোগ্য নয়।” ভগবান লাভের বিভিন্ন পথ আছে। যখন মানুষ পূর্ণতা লাভ করে তখন তার সমগ্র সত্তা আলোকিত হয়। মানুষের চরিত্রের প্রবণতা অনুযায়ী সাধন-পথ পৃথক পৃথক হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। যেমন মানুষ কেউ বিচারশীল, কেউ ভাবুক, কেউ কর্মে তৎপর এবং কেউবা ধ্যানপরায়ণ। এদের সাধন প্রণালী এদের চরিত্রকে প্রকাশ করে। বেদান্তে ভগবান লাভের চারটি প্রধান পথ বা যোগের উল্লেখ আছে। যীশুনির্দেশিত মুক্তির উপায় বুঝতে গেলে এই যোগচতুষ্টয়ের আলোচনার প্রয়োজন আছে। কর্মযোগ—নিষ্কাম কর্মের পথ। এ পথে প্রত্যেক কর্ম ভগবানের প্রীত্যর্থে অনুষ্ঠিত হয়। কর্মফল ভগবানের উদ্দেশ্য নিবেদন করে কর্মযোগী কালে শুদ্ধমনা হয় এবং ভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়। জ্ঞানযোগ—বিচারের পথ, কোন্‌টা নিত্য কোন্‌টা অনিত্য বিচার করে তা জানার পথ। এভাবে অস্থায়ী জাগতিক বস্তু ‘নেতি নেতি’ বিচারের দ্বারা ত্যাগ করে জ্ঞানযোগী অনুভব করেন যে ব্রহ্মই একমাত্র শাশ্বত বস্তু। তারপর ধ্যানের দ্বারা তিনি ঈশ্বরের নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় মিলিত হন।
স্বামী প্রভবানন্দের ‘বেদান্তের আলোকে খ্রীস্টের শৈলোপদেশ’ থেকে