আমার মাকে আমি সহস্ররূপে সহস্র ভাবে সহস্রনয়নে, সহস্রবার দেখিতে চাই। শুধু একটী রূপের ভাতি লইয়া নয়ন-সম্মুখে দাঁড়াইলেই মাতৃ-দর্শন-পিয়াসী সন্তানের পিপাসা মিটিবে না। তাঁর জীবনে শুধু একটী ভাবের লীলা-বৈচিত্র্য দেখিলেই আমি তুষ্ট হইব না, বহু যুগ পরে পরে একটীবার করিয়া মা আবির্ভূতা হইলেই আমার আশা মিটিবে না। আমি চাই আমার নিদ্রিতা জননীর চিরজাগ্রত স্ফূর্ত্তি সর্ব্বতোমুখিনী প্রতিভার দীপ্তি লইয়া ফুটিয়া উঠুক, মুহুর্মুহু তাঁর মহিমার কেতন পত পত শব্দে উড্ডীয়মান হইতে থাকুক, মা আমার সকল কল্পনার কুয়াসা ভেদিয়া জ্যোতির্ম্ময়ী মূর্ত্তিতে অপরূপ দিব্য কান্তিতে ঝল্ঝল্ করিতে করিতে অবতীর্ণা হউন! আসুক মা তাঁর অজ্ঞানবিনাশের বেদমন্ত্র লইয়া, আসুক মা তাঁর অসুর-নিপাতের খর-করবাল ধরিয়া। আসুন মা তাঁর স্নেহ-স্নিগ্ধ অমৃতময়ী বাণী লইয়া, আসুন মা তাঁর মৃতসঞ্জীবনী সুধার অফুরন্ত উৎস লইয়া,—এই মৃত ও মুমূর্ষু জাতির দগ্ধপ্রায় ভগ্নাস্থি-পঞ্জরে তিনি তাঁর আশিসের শক্তিতে নবজীবন সঞ্চারিত করুন। আসুন মা দুর্ব্বলের উপর প্রবলের অত্যাচার নিবারণ করিতে, লাঞ্ছিত অসহায়কে ক্রোড়ে তুলিয়া লইতে, অনাথ আতুরের মুহ্যমান চেতনা বুকের স্তন্যে সঞ্জীবিত করিতে। আসুন মা আজ পরপীড়ক স্পর্দ্ধিতের উদ্ধত গর্ব্বিত শির নিজ হস্তে স্কন্ধচ্যুত করিতে, আসুন মা আজ ধরণীর বৃথা রক্তস্রোত জীবপ্রীতির বন্যার জলে ভাসাইয়া দিতে। আসুন মা আজ অন্ধের যষ্টি হইয়া, বৃদ্ধের সম্বল হইয়া, তরুণের উৎসাহ হইয়া, কর্ম্মীর বল হইয়া। সাধকের গুরু হইয়া, ক্ষুধিতের অন্ন হইয়া, হতাশের আশা হইয়া, ব্যথিতের নির্ভর হইয়া, পতিতের অভ্যুদয় হইয়া। আসুন মা আজ দিকে দিকে দেশে দেশে মা-মা ধ্বনির সিংহ-গর্জ্জন উত্থিত করাইয়া, আসুন মা আজ নিজের পূর্ণ আবির্ভাবকে সর্ব্বত্র অভ্রান্ত-ভাবে অনুভব করাইয়া।
আমার সেই মা তুমি। যেই মা আমার ব্রহ্মাণ্ড-ব্যাপিনী, সেই মা-ই তুমি। যেই মা আমার ব্রহ্মাণ্ড-পালিনী, সেই মা-ই তুমি। যেই মা দেশের দুর্ভাগ্য ঘুচাইবে, সেই মা যে তুমি! যেই মা জাতির অশ্রু মুছাইবে, সেই মা যে তুমি! ছোট বড় সকলকে যে মাতৃ-স্নেহ দান করিবে, সকলকে যে বুকের স্তন্যে জীবন্ত করিবে, সকলকে যে অফুরন্ত ভালবাসা দিয়া মানুষ করিবে, সেই মা যে তুমি। তোমারই নিকটে জাতির ভিক্ষা জ্ঞান, জাতির প্রার্থনা শক্তি, জাতির দাবী অখণ্ড-মনুষ্যত্ব।
জ্ঞানরাজ্যের অধিকার আমাদের ন্যায় তোমাদেরও অবারিত। তোমরা নারী বলিয়া জ্ঞান আহরণে বাধা দিবার অধিকার কাহারও নাই। জ্ঞানপথে তোমাদের সমক্ষে যত বাধা আসিয়া জুটিয়াছে, তোমার মা সেইগুলিকে আজ আস্বীকার কর। যত বিঘ্নই জ্ঞানার্জ্জনকে কষ্টকর করিয়া থাকুক না কেন, সিংহ-বাহিনীর বিক্রমে সব-কিছু অগ্রাহ্য কর। জ্ঞান লাভের জন্য আজ উন্মাদিনী হও, জ্ঞানের পরশমণি আজ নারী-সমাজের আমূল পরিবর্ত্তন সাধিত করুক। শিক্ষার যখন সময়, তখনই তোমরা সংসারধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া বিষয়-ব্যাপারে বিজড়িত হইয়া পড়িতেছ। ইহা তোমাদের জ্ঞান-সাধনার এক অতি প্রবল অন্তরায়।
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘নবযুগের নারী’ থেকে