এমনিতে যত অবাধ্যই হোক, তাঁর হাতে বশ মানে সব শাড়ি। তাঁর শাড়ি পরা কিংবা শাড়ি পরানোর কায়দা নিয়ে রীতিমতো চর্চা চলে গোটা দেশে। জনপ্রিয় শাড়ি ড্রেপার ডলি জৈন-র সঙ্গে আলাপচারিতায় অন্বেষা দত্ত।
শাড়ি ড্রেপার— সোজা বাংলায় শাড়ি পরানো। এই পেশা নিয়ে এখন আকছার আলোচনা হয়। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি, তিনি কলকাতার বধূ ডলি জৈন। গোটা বলিউড তাঁকে এখন একডাকে চেনে। যদিও কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। শ্রীদেবী থেকে হাল আমলের সারা আলি খান— ডলি বলতে অজ্ঞান সব নায়িকা। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সারা আলি খান বা ‘রকি অউর রানি’-তে আলিয়া ভাট, সকলকেই সাজিয়েছেন ডলি। নায়িকাদের মুখে একটাই কথা, ডলির হাতে জাদু আছে। আঙুলের অনায়াস চলাফেরায় সিল্ক শিফন জর্জেট থেকে বেনারসি কাঞ্জিভরম গাদোয়াল, সব শাড়ি ভারি সুন্দরভাবে ছড়িয়ে পড়ে অঙ্গে। একটা শাড়িকে যে এতরকমভাবে পরানো যায়, এবং তার মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের একটা নতুন দিক খুলে দেওয়া যায়, ডলি না বোঝালে কে বুঝত! তিনি এখন বহু ছেলেমেয়ের অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে এই প্রজন্মের অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন শাড়ি ড্রেপিং। শাড়ি নিয়ে অনেক কথাই হল তাঁর সঙ্গে।
শাড়ির প্রতি ভালোলাগা কবে থেকে?
(একটু ভেবে) এমন একটা পরিবারে আমার বিয়ে হয়েছিল, যেখানে শুধু শাড়িই পরতে হতো। তার আগে কিন্তু কোনওদিন শাড়ি পছন্দ করতাম না। বলা ভালো, শাড়ি দেখলে রাগ হতো!
কলেজবেলার শাড়ি নিয়ে স্মৃতি?
আমি তো কোনওদিন কলেজে যাইনি! আমার স্কুলের পড়া শেষ হয়েছিল ক্লাস সেভেনেই। প্রথাগত পড়াশোনার ওখানেই শেষ। আজ কথাটা এত সহজে বলতে পারছি। একটা সময় পারতাম না। অনেক কিছু মাথায় কাজ করত। অনেক হীনম্মন্যতা। এখন মনে হয় পড়াশোনা, শিক্ষা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তার সঙ্গেই জরুরি নিজের গুণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিজেকে সেইভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, উত্তীর্ণ করা।
শাড়ি প্রিয় হল কবে থেকে?
বিয়ের পরে শাড়ি পরতে বাধ্য হলাম, কারণ শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছিলেন খুব কড়া। পরতে পরতেই ধীরে ধীরে ভালোলাগা এবং ভালোবাসা তৈরি হল। এভাবে দীর্ঘ ২৮ বছর শাড়ির এই ভালোবাসায় কাটিয়ে ফেললাম। এখন আমার মনে হয়, শাড়িই একমাত্র নির্ভরযোগ্য পোশাক। কোনও একটা বিশেষ লুক যদি কেউ তৈরি করতে চায়, তার জন্য শাড়িই বেস্ট। কথায় বলে না, শাড়ি হল বারো হাতের আভিজাত্য..., এটা ষোলো আনা খাঁটি। শাড়ি পরলে নিজেকে যেভাবে দেখতে চাই, সেই লুকটা তৈরি করে নিতে পারি আমি। শাড়ি বিষয়টাই মনে মনে একটা খুশির ভাব তৈরি করে। যে কোনও পার্টি বা উৎসবে আমাকে আলাদা করে চেনায় শাড়ি।
কোন ধরনের শাড়ি মনের বেশি কাছাকাছি?
কাঞ্জিভরম, ওপারা, অরগ্যাঞ্জা, হাতে বোনা পিওর সব ধরনের শাড়িই মনের খুব কাছের। চান্দেরিও বেশ ভালো লাগে। কারণ হাতের ছোঁয়া থাকে। তবে শিফন, স্যাটিন বা জর্জেট অতটা পছন্দের নয় আমার। কারণ ফ্যাব্রিকটাই ভালো লাগে না।
কলকাতায় যাঁর শ্বশুরবাড়ি, তার ফেভারিট লিস্টে বাংলার শাড়ি নেই?
অবশ্যই আছে। ঢাকাই জামদানি প্রচুর পরি। তাঁতের শাড়িও। এছাড়া কাঁথাকাজের শাড়িও ভীষণ প্রিয়। কলকাতায় বসে এখানকার শাড়ি, এখানকার ফ্যাব্রিক মনে ধরবে না, তা কি হয়! আর শুধু আমি কেন? বাংলার শাড়ি গোটা দেশ, এমনকী বিদেশেও প্রসিদ্ধ। শাড়িপ্রেমী নারীর আলমারিতে একটা কাঁথাকাজের শাড়ি আর ঢাকাই থাকবেই থাকবে।
শাড়িতে কোন রং পছন্দ?
আমি আইভরি পার্সন। অফ হোয়াইটের সঙ্গে একটা অদ্ভুত সংযোগ আছে আমার। ভীষণ ভালো লাগে।
পেশা হিসেবে শাড়ি ড্রেপিং এখন খুবই ইন। আপনার সূত্রেই এ পেশা এত জনপ্রিয় হয়েছে। কী মনে হয় এর ভবিষ্যৎ কতদূর?
ড্রেপিং খুবই ভালো পেশা। অন্যরকম কাজ। তবে যে কোনও পেশার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে যেমন সে কাজটা করা যায় না, এটাও তেমনই। আমি কোনওদিন ভাবিনি শাড়ি ড্রেপিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেব। কিন্তু যে কাজটা আমি করছিলাম, তার প্রতি আমার অসম্ভব ভালোলাগা এবং ভালোবাসা দুটোই ছিল। আমার মতে, এই পেশায় দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আজকাল বেশিরভাগ মেয়ে উৎসবে বা বিশেষ কোনও কারণেই শাড়ি পরে। অনভ্যাসবশত নিজেরা ঠিকভাবে শাড়ি পরতে পারে না। কারও না কারও সাহায্য লাগে। তা সেটা যদি পেশাদার কারও থেকে পাওয়া যায়, ভালো হয়। এটা এখনকার মেয়েদের কাছে আশীর্বাদের মতো। আর যারা পেশা হিসেবে এটা বেছে নিচ্ছে বা নিতে চাইছে তাদের বলব, আগে কাজটা ভালো করে শিখে নাও। তারপর কাজে নামো।
আপনার ড্রেপিং-এর সঙ্গে বলিউডের অনেক গল্প জড়িয়ে...
আমার কাজে বলিউডের প্রভাব নিয়ে অনেক মাতামাতি হয় এখন। আমি বলব কেউ যদি কোনও একটা কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারে, তা সে পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই হোক, বলিউড ঠিক তাকে খুঁজে পায়। এটা আমার অভিজ্ঞতা। কারণ বলিউড সবসময়েই ট্যালেন্ট খোঁজে। আমি শুধু আমার কাজটা করে যাচ্ছিলাম মন দিয়ে। বলিউড আমায় খুঁজে নিয়েছে।
বলিউড নিয়ে বিশেষ কোনও অভিজ্ঞতা?
শ্রীদেবীকে শাড়ি পরানোর গল্পটা এখন সবাই জানে। উনিই আমায় প্রথম বলেছিলেন, ‘তোমার আঙুলে জাদু আছে! এত সুন্দর করে আর কাউকে শাড়ি পরাতে দেখিনি...।’ এটা আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি ছিল। এই একটা মন্তব্য আমার সব ভাবনা পাল্টে দিয়েছিল। যেভাবে পেশাটাকে দেখতাম, তার থেকে আরও বেশি সিরিয়াস হয়েছি। নীতা আম্বানি বলেছিলেন, ‘ডলি কাউকে দেখিনি এত সুন্দর করে শাড়ি প্লিট করতে পারে!’ এত বড় বড় ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে শোনা কথাগুলোই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
সামনেই পুজো। বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরার জন্য কোনও টিপস?
আমার সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ফলো করলেই প্রচুর টিপস পেয়ে যাবে সবাই। শাড়ি পরার অনেক ভিডিও রিলস আছে। দুর্গাপুজোর আগে আগে আরও কিছু পোস্ট করব।
.
সুন্দর করে শাড়ি পরার ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু নিয়ম?
কিছু নিয়ম তো আছেই। যেমন, শাড়ি কিন্তু হিল ছাড়া পরলে ভালো লাগে না। আপনি লম্বা হলেও হিলস পরলে শাড়ির ফল খুব ভালো বোঝা যায়। এছাড়া যেসব পিন লাগাচ্ছেন শাড়িতে, সেটাও ভেবেচিন্তে বেছে রাখুন আগে থেকে। শাড়ির যত্নের কথা মাথায় রাখবেন। যদি হাইনেক ব্লাউজ পরেন, চুল উঁচু করে তুলে বেঁধে নিন। একইভাবে লো নেক ব্লাউজ হলে চুল খোলা রাখুন বা নিচু করে বাঁধুন। আর বলব পেটিকোটও বুঝেশুনে বাছুন। খুব ঠিকঠাক ফিটিং পেটিকোট না হলে শাড়ির লুকটাই মাটি। খুব হেভি এমব্রয়ডারি করা ব্লাউজের সঙ্গে ভারী নকশার শাড়ি পরবেন না। এতে আরও মোটা লাগে। যে কোনও একটা হালকা রাখুন। ব্লাউজ ভারী কাজের হলে শাড়ি হবে একদম সাদামাঠা। আর শাড়ি গর্জিয়াস হলে নকশাদার ব্লাউজ এড়িয়ে চলুন।