সেই কবে মুকুল দত্ত লিখেছিলেন, ‘চোখের জলের হয় না কোনও রং, তবু কত রঙের ছবি আছে আঁকার...’। সত্যি, মনের কত ক্যানভাস ভিজেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর। টিভির পর্দায় তাঁর কান্না দেখে চোখ ছলছল করে ওঠে ফুটবলপ্রিয় বাঙালির। এ তো সিআরসেভেনের নয়, মহামানবের কান্না। তিনিও আমাদের মতো। আনন্দে শিশুর মতো হেসে ওঠেন। আবার না পারার ব্যর্থতা তাঁকে ভাবায়। আমরা না হয় অনেক দূরে থাকি। কিন্তু গ্যালারিতে হাজির পঞ্চাশ হাজার দর্শক। তাঁদের কথা কি একবারের জন্য মনের কোণে এল না রোনাল্ডোর?
অস্তরাগ এমনই। পারফরম্যান্সের সূর্য মধ্যাহ্ন পেরলেই অ্যালার্মের মতো বাজে। কানের সামনে অস্ফুটে কে বলে ওঠে, ওরে এবার থাম। কিন্তু মহামানবীয় পরিধি তা শুনবে কেন? সে তো সাফল্যের এক মিনার থেকে অপর মিনারে পৌঁছনোর স্বপ্ন দ্যাখে। আর যা নিষ্ঠুর বাস্তবের কাছে অধিকাংশ সময়েই ভেঙে খানখান হয়। ক’জনই বা চুনী গোস্বামী কিংবা সুনীল মনোহর গাভাসকর হতে পারেন? ১৯৬৭’তে চুনী ফুটবল ছাড়ার পর বছর তিনেক মোহন বাগান তাঁবুর আনাচেকানাচে অনেকেই আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘আহা, ও যদি থাকত!’ আর সুনীল গাভাসকরের শেষ টেস্ট ইনিংসটা মনে করুন। সালটা ১৯৮৭। বেঙ্গালুরুর ভাঙা পিচে কপিবুক ৯৬ রান। সানির অবসরের পর ক্রিকেটপ্রেমীরা বলতেন, ‘আরও কিছুদিন আরামসে খেলতে পারত ও।’
কাতার বিশ্বকাপেই সেই বিদায়ঘণ্টা শুনতে পেয়েছিলেন রোনাল্ডো। পর্তুগালের প্রথম একাদশে তিনি অটোমেটিক চয়েস নন, বুঝতে পেরে কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোসের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। অজানা-অচেনা গনসালো র্যামোস হ্যাটট্রিক করে প্রচারের আলো শুষে নিয়ে চলে যাবেন আর তাঁকে থাকতে হবে রিজার্ভ বেঞ্চের আড়ালে, এ কি মেনে নেওয়া সম্ভব? কিন্তু কিছু করারও নেই। অনুশীলনে সময় বাড়ালেও বয়স তো আর থেমে নেই। ভাঁটা পড়েছে রিফ্লেক্সে। কোমরের দোলায় তাই নেই অতীতের ছন্দ। ফ্রি-কিকও কেমন যেন আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত। তাই বুটজোড়া তুলে রাখার ফিসফাস চারদিকে। এই আবহেই জার্মানিতে পা রাখেন পর্তুগিজ মহাতারকা। তাঁর সৌজন্যেই এবার কোচের দায়িত্বে রবার্তো মার্তিনেজ। প্রতিটি ম্যাচে তাই প্রথম একাদশে তিনি নিশ্চিত। রোনাল্ডো ভেবেছিলেন, চেষ্টায় তো কোনও ত্রুটি নেই। একটা ফিল্ড গোলই তাঁকে ফিরিয়ে দেবে যাবতীয় আত্মবিশ্বাস। কিন্তু না! ৩৯ বছরে ফিট থাকার রসায়ন রোনাল্ডোকে পুরনো ফর্মে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এখন বল ধরলে বিপক্ষ ডিফেন্ডাররা তাঁর চোখে চোখ রাখতে পারেন। কেড়ে নেন অবলীলায়। আর এখানেই নিজের উপর রাগ হয় রোনাল্ডোর। জীবনের পটচিত্রে তাই তাঁর কান্না দুর্বলতার নয়, অতীতকে ছুঁতে না পাওয়ার প্রতীক।
জুভেন্তাস ছেড়ে সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়ার সময় বোঝা গিয়েছিল, বুটজোড়া তুলে রাখার ডাক পেয়েছেন সিআরসেভেন। ইউরোপিয়ান লিগে না থাকলে কৌলিন্য ভেসে যায় নদীর জলে। কিন্তু তিনি তো হারতে শেখেননি। শোনেননি রবীন্দ্রনাথের সেই গান, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার’।
শুধু রোনাল্ডোই নন, আমরা প্রত্যেকে জীবনের আলোর দিকগুলি দেখতে ভালোবাসি। অন্ধকারকে তখন মনে হয় অন্য গ্রহের প্রাণী। কিন্তু এ জীবন তো শুধুই প্রাপ্তির নয়, কিছু হারানোরও বটে। রোনাল্ডো চিরকালই এক্সটোভার্ট। ফুটবল মাঠে তাঁর অভিব্যক্তির মধ্যে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বলতে পারেন, ‘আয়াম দ্য বেস্ট’। কিন্তু বেস্টকেও তো রেস্ট নিতে হয়। আমরা তো মানুষ। ভগবান নই। মনে কি পড়ে, অমিতাভ বচ্চনের সেই ডায়লগ, ‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা’। কিন্তু সে তো সিনেমা। বাস্তবের সঙ্গে যার মিল নেই। তাই ‘কুলি’ শুটিংয়ের চোটের ব্যথা এখনও ভুলতে পারেননি বিগ বি।
মোদ্দা কথা হল, রোনাল্ডো চলে এসেছেন তাঁর কেরিয়ারের সায়াহ্নে। অতীতের সঙ্গে এখনও নিজেকে মেলাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু জীবন খাতার হিসেবনিকেশ সবসময় মেলে না।
জাতীয় সঙ্গীতের সময় নাকি তাঁর ঠোঁট নড়ে না। সেরা পারফরম্যান্স তুলে রাখেন যৌবনের উপবন বার্সেলোনার জন্য। পান থেকে চুন খসলেই লিও মেসির দিকে ধেয়ে আসত এরকম সমালোচনা। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের পর সবাই চুপ। কিন্তু মেসি বুঝেছেন, কেরিয়ারে ইতি টানার সময় এসেছে। তাহলে এখনও খেলছেন কেন? প্রশ্নটা সহজ আর উত্তর ও তো জানা। ২০২২ বিশ্বকাপের আগে আকাশছোঁয়া চাপ নিয়ে মাঠে নেমেছেন বাঁ পায়ের জাদুকর। ডিয়েগো মারাদোনার উত্তরসূরির কাছে সবাই বিশ্বসেরা হওয়ার আব্দার করেছেন। ২০১৪’য় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলে তা প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছিলেন লিও। কিন্তু গঞ্জালো ইগুয়েনের জন্য তা হয়নি। দোহায় তাই ট্রফি তোলার পর মেসিকে বলতে শুনেছি, ‘এবার তো ফুটবল উপভোগ করব। বিশ্বসেরা হয়ে মাঠে নামার আনন্দই আলাদা।’
তাহলে কি মেসির কেরিয়ারে শুধুই আলো? একেবারেই নয়। টাইম মেশিনে পিছিয়ে যান বছর আটেক। ২০১৬ সাল। কোপা আমেরিকার ফাইনালে ক্লদিও ব্র্যাভোর চিলির কাছে হারের পর তাঁকে কাদতে দেখেছিল গোটা বিশ্ব। দুম করে নিয়েছিলেন অবসরের সিদ্ধান্তও। হতাশ হয়েছিল আর্জেন্তিনাবাসী। অনেক দূরে থাকা বাঙালিরাও। কিন্তু এএফএ’র প্রেসিডেন্ট ক্লদিও তাপিয়ার পরামর্শে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন মেসি। ভাগ্যিস। না হলে তাঁর হাতে বিশ্বকাপ দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থাকতে হতো আমাদের।
রোনাল্ডোর জীবনে অন্তর্মুখী শব্দটাই নেই। বিশ্বকাপে প্র্যাকটিস সেশনেও টিমবাস থেকে নামার মুহূর্তে প্রসারিত থাকে তাঁর দু’কাধ। ব্যতিব্যস্ত নিরাপত্তারক্ষীরা। একঝাঁক স্নিফার ডগের চিৎকার। সেসব চিরেই এগিয়ে চলেন মহাতারকা। বান্ধবীর সঙ্গে নিভৃতেও একইরকম থাকে তাঁর শরীরীভাষা। মেসির আবার অনাড়ম্বর জীবনযাপনই পছন্দ। আবেগ থাকলেও তা বাঁধনহীন নয়। বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজি’তে গিয়ে ফুল ফুটিয়েছেন তিনি। কিন্তু অন্তরের সেই ডাক শুনতে পেয়েই প্যারিসে বেশিদিন থাকলেন না। মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত লোভনীয় অফার ছেড়ে যোগ দিলেন ইন্তার মায়ামিতে। বাকিটা সবারই জানা!
চলতি কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্তিনা। ভারতীয় সময় সোমবার সকালে খেতাবি লড়াইয়ে স্কালোনি-ব্রিগেডের মুখোমুখি কলম্বিয়া। এই ম্যাচ মুক্তমনেই খেলবেন মেসি। জিতলে ভালো। আর উল্টোটা হলেও ক্ষতি কিছু নেই। অবসর নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিকবার মুখ খুলেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট নয়। ইচ্ছে করেই বজায় রাখছেন ধোঁয়াশা। আসলে খেলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সহজ নয়। মেসি এখনও দ্বিধায়। ফুটবল থেকে তাঁর আর কিছুই পাওয়ার নেই। তা সত্ত্বেও প্রচারের আলো সরে যাওয়ার ভয় বাকিদের মতো লিওর’ও আছে।
রোনাল্ডোর সঙ্গে এই ব্যাপারে মেসির অমিল প্রচুর। দু’টি বিশ্বকাপ কভার করার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি বলছে, পর্তুগাল দলে রোনাল্ডো অজাতশত্রু নন। আড়ালে-আবডালে তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। নেতৃত্বে ব্রুনো ফার্নান্ডেজ। কিন্তু আর্জেন্তিনায় মেসি একেবারে আদর্শ নেতা। লাওতারো মার্তিনেজ-এমিলিয়ানো মার্তিনেজরা তাঁর জন্য মাঠে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পারেন। লিও মেসি এরকমই। মাঠে নামলেই তিনি মহাতারকা। কিন্তু বাকি সময়ে নিতান্ত সাদামাটা একজন মানুষ।
এলএমটেনের বয়স এখন ৩৭। আগামী বিশ্বকাপ এখনও বছর দুয়েক দূরে। ছেলেবেলার বন্ধু তথা স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জোর সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনাও হয়েছে একান্তে। কিন্তু আরও একটু ভাবনাচিন্তা করতে চান মেসি। এটা ঠিক যে, বয়সের ভার তাঁর পারফরম্যান্সেও থাবা বসিয়েছে। কমেছে গতি, স্কিল। না হলে ইউরোপিয়ান সার্কিটে এখনও দেখা যেত তাঁকে।
মেসির অন্তরঙ্গ বন্ধু সের্গিও আগুয়েরো মাসখানেক আগে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগামী বিশ্বকাপে ও নামতে পারে। শুধু প্রয়োজন ক্লাব স্তরে বেছে বেছে ম্যাচ খেলা। কেন জানি না, রোনাল্ডোর পাশাপাশি লিওর অবসর নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দু’জনের খেলার ধরন তো আলাদা। ফিটনেস ও রিফ্লেক্সে সামান্য ঘাটতি থাকলেই রোনাল্ডোর পারফরম্যান্সের গ্রাফ পড়বে। তাছাড়া ও এখন ৩৯। এটা ঠিক যে, মেসি এখন কেরিয়ারের সায়াহ্নে। তবে নিজের দিনে বিপক্ষকে শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা ওর রয়েছে। তাই আশা করব, ফুটবলপ্রেমীদের জন্যই আগামী বিশ্বকাপে খেলবে লিও।’
তাঁর অবসর নিয়ে অপেক্ষা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় নেই। কারণ, কোথায় থামতে হয় তা নিশ্চয়ই মেসি জানেন। এখন দেখার, তাঁর কেরিয়ারের গোধূলি কতটা দীর্ঘায়িত হয়?
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র