প্রচ্ছদ নিবন্ধ

বেগম, কন্যা ও রবীন্দ্রনাথ
সমৃদ্ধ দত্ত

বেগম বনাম কন্যা
‘ম্যাডাম, আমাদের সোর্স খুব কিন্তু কনফার্মড! খুব ডেলিকেটও। বাইরে এই খবরটা চলে গেলে সমস্যা হবে।’ বললেন আর এন কাও। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র)-এর প্রধান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কী করা উচিত? 
ম্যাডাম হলেন প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধী চিন্তিত মুখে বললেন, ‘তাহলে আমাদের কোনও অফিসারকে এর মধ্যে ইনভলভ করার দরকার নেই। আপনি নিজেই যান।’ 
১৯৭৪ সাল। কাও গেলেন ঢাকায়। শেখ মুজিবুর রহমান একটি মিটিং করছিলেন। চিরকুট দেখে তিনি বিস্মিত। এই ভদ্রলোক এখানে? এই লোকটা ইন্ডিয়ার সাংঘাতিক এক স্পাই মাস্টার! একাত্তরে একাই প্ল্যান করে বহু অপারেশন করিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধদের অপারেশনাল মুভমেন্ট নিজেই করেছেন। এমনকী বাংলাদেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি তৈরিতে এই মানুষটির কৃতিত্ব সর্বাধিক। 
মুজিব বেরিয়ে এলেন। নিজের চেম্বারের দিকে হাঁটছেন। আর এন কাও এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যর, একটু বাইরে আসুন। বাগানে।’ মুজিব বিস্মিত। কী ব্যাপার? কাও তাঁকে যে কথা বললেন, সেটা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল বঙ্গবন্ধুর। তারপর হেসে বললেন, ‘এ আপনি কী বলছেন? না না এসব সম্ভবত ঠিক নয়। যাদের কথা আপনি বলছেন, তারা সব আমার খুব কাছের মানুষ। এরা এরকম করবে কেন?’ কাও ফিরে এলেন। আবার ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে পাঠালেন এক অফিসারকে। আবার একটি ইনপুট পাওয়া যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে সেই একই উদ্দেশ্য। এবারও মুজিব সেরকম গুরুত্ব দেননি।
হ্যাঁ। দু’বার ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা মুজিবকে সতর্ক করেছিল যে, তাঁর আশেপাশেই একটি চক্রান্ত চলছে। তৈরি হচ্ছে তাঁকে হত্যার প্লট। তিনি যেন সতর্ক থাকেন। আর প্রশাসন তথা আর্মিতে সবাইকে বদলে দেন! মুজিব হয়তো কিছুদিন পর সেকথা মেনে কিছু রদবদল করতেন। কিন্তু ভারতের গুপ্তচর সংস্থার সোর্স ইনপুটকে সত্য করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবুর রহমানকে বাসভবনে ঢুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবারে। শুধু দুই কন্যা ছিলেন না অভিশপ্ত সেই বাসভবনে! হাসিনা এবং রেহানা। দু’জনেই ছিলেন জার্মানিতে। আর তাই প্রাণে রক্ষা পেলেন। দু’জনেই গোপনে ফিরলেন। কোথায়? দিল্লিতে। ইন্ডিয়া গেটের কাছেই পান্ডারা রোড। সেখানে সরকারের এক গেস্ট হাউসে শেখ হাসিনার গোপনে থাকার ব্যবস্থা হল। কে করে দিলেন এই ব্যবস্থা? প্রণব মুখোপাধ্যায়।
ঠিক ৪৯ বছর পর আবার হাসিনা প্রাণরক্ষা করতে পালিয়ে এলেন গোপনে সেই একই শহরে। দিল্লি। এবারও ভারত সরকার তাঁকে ভারতীয় বায়ুসেনার এক অতিথিশালায় আশ্রয় দিয়েছে। এবারও সেই আগস্ট!
১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর ক্ষমতাসীন হওয়া মোশতাক আহমেদকে সরিয়ে ১৯৭৭ সালে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন। এসেই মুজিব হত্যার অপরাধীদের মুক্তি দিতে শুরু করেন। তৈরি করেন নিজের একটি দল। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। বিএনপি।
জিয়াউর রহমান কিন্তু হত্যার রাজনীতির কাছে নিজেও আত্মসমর্পণ করলেন একদিন। ১৯৮১ সালে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে তাঁকেও হত্যা করল আর্মির এক বাহিনী।
তারপর কেটে যায় ১০ বছর। ১৯৯১ সালে হঠাৎ একটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বাংলাদেশের আকাশে মোকাবিলায় অবতীর্ণ হন দুই নারী। একজনের পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা। অন্যজনের স্বামী নিহত হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া। দুই নারীর সেই রাজনৈতিক যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে আর বেরতে পারেনি বাংলাদেশ। আজও বাংলাদেশের জনমনের দুই-ই চালিকাশক্তি। বেগম এবং কন্যা। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪। ৩৩ বছর ধরে দু’জনে বলে এসেছেন, তাঁরাই আনবেন গণতন্ত্র! কেউ কথা রাখেনি! 
অলৌকিক রবীন্দ্রনাথ
সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে একটি কারখানা নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৭৮ সাল। সেই অর্থেই জি এম প্লান্ট উদ্বোধন করলেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এসেছেন তিনি। কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট অধিবেশনে কোরান তেলাওয়াতের আগে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা নিয়ে প্রতিবাদ হ঩য়েছে। একাংশের বক্তব্য, কোরান তেলাওয়াতের আগে কীভাবে জাতীয় সঙ্গীত স্থান পায়? সবার উপরে কোরান। অন্য পক্ষের বক্তব্য, জাতীয় সঙ্গীত দিয়েই তো অনুষ্ঠানের সূত্রপাত। দোষের কী আছে?
সেই প্রসঙ্গ টেনে সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা চৌধুরী ইউসুফ বললেন, ‘স্যর, আমাদের পতাকায় ইসলামিক রং নাই। এটা আমাদের ভালো লাগে না।’ জিয়াউর হাত তুলে বললেন, ‘সবকিছু হবে। তার আগে জাতীয় সঙ্গীতটা পাল্টানো দরকার। তারপর জাতীয় পতাকা।’
জিয়ার ওই আশ্বাস নিছক কথার কথা ছিল না। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান একটি গোপন চিঠিতে সেই প্রস্তাব দিলেন সরকারকে। লিখলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী। উনি একজন হিন্দু কবি। তাই আমাদের নিজেদের কবির লেখা জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত। জাতীয় সঙ্গীত হোক ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’।’ চিঠি পেয়েই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দিকে অগ্রসর হয় মন্ত্রিপরিষদ। তবে জাতীয় সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই আর্মির হাতে প্রাণ হারান রাষ্ট্রপতি।
সেই প্রথম নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবকে হত্যার পরই প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্থির করলেন, জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে হবে। গঠন করা হল কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীপ মহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রাথমিক বৈঠকে স্থির হয়, রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ বদলে দু’টি গানের মধ্যে থেকে একটিকে বাছা হবে নতুন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ অথবা ফারুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ নামক কবিতা। কিন্তু মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় থাকতেই পারলেন না। হয়ে গেল আবার অভ্যুত্থান। আবার ধামাচাপা পড়ল উদ্যোগ। 
২০০২ সালের ১৯ মার্চ। বিএনপি-জামাত জোটের সরকারের দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামি ও আলি আহসান মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে উদ্যোগী হন। খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেওয়া সেই সুপারিশপত্রের ভাষ্য ছিল, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সঙ্গীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী তা অগ্রাহ্য করেননি। তিনি চিঠি পাঠিয়ে দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। আলোচনা শুরু হয়। প্রতিবাদও ওঠে। ঠান্ডাঘরে পাঠানো হয় প্রস্তাব। স্থির হয়, সুযোগ বুঝে মন্ত্রিসভায় পাশ করিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু সেই সময় আর আসেনি। ২০০৪ সালে ওই সময়েই শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড অ্যাটাক হয়।
বিএনপি এবং জামাত ক্ষমতাসীন হলেই এই উদ্যোগ বারংবার দেখা গিয়েছে। সুতরাং ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করার প্লট সফল হওয়ার পর, এরপর কী কী বদল হতে চলেছে বাংলাদেশে? জাতীয় সঙ্গীতে কি রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ থাকবে?  
এ ব্যাপারে সতর্ক থাকাই শ্রেয়। দু’টি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে চলেছে এই উপমহাদেশে। বহুকাল ধরে। মোট সাতবার ভাঙা হয়েছে এবং গড়া হয়েছে দিল্লি নামক একটি নগরী। যতবার সেই নগরীকে কেউ বদলাতে চেয়েছে, ততবারই সে ধাক্কা খেয়েছে। কখনও সিংহাসনচ্যুত হয়ে। কখনও পরাস্ত হয়ে পলায়ন বা রণাঙ্গণে নিহত হয়েছে সেই শাসক। আবার পাশাপাশি এটাও কি অলৌকিক এক সমাপতন নয় যে, ঢাকা নামক অন্য একটি নগরীর ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে বসে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত যখনই যে সরকার অথবা শাসক বিগত ৫৩ বছরে বদলাতে চেয়েছে, ঠিক তারপরই দেখা দিয়েছে সেই শাসকের বিদায়ধ্বনি! অতএব ভুল যেন না করে নতুন সরকার! না হলেই উল্টে যাবে ক্ষমতা!
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বহু প্রচেষ্টার পর আটকে থাকা কাজের জটিলতা মুক্তি। কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় বিশেষ উন্নতি। আয় বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৭.৭৯ টাকা১১১.৩৩ টাকা
ইউরো৯০.৯৫ টাকা৯৪.১৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা