প্রচ্ছদ নিবন্ধ

উত্তমপুরুষ: সিঁড়ি থেকে নামার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন উত্তমদা
রঞ্জিত মল্লিক

উত্তম কুমারের সঙ্গে আমার গোটা পাঁচেক ছবি করার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথম ছবি ছিল ‘মৌচাক’। আর শেষ ছবি ‘ওগো বধু সুন্দরী’। প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি এরকম সারা ভারতে দেখিনি। পৃথিবীতেও আর কোথাও আছে কিনা জানি না। একজন নায়কের মৃত্যুর ৪৪ বছর পরেও তাঁকে নিয়ে কত আলোচনা, কত ভাবনা। এটা ভাবা যায় না। বলতে গেলে, অভাবনীয়, অকল্পনিয়। কিন্তু উত্তম কুমার এমনি এমনি উত্তম কুমার হয়ে ওঠেননি। এর পিছনে অসম্ভব নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অধ্যবসায়ের ইতিহাস রয়েছে। একটা কথা, উনি অভিনেতা হিসেবে যতখানি বড় মাপের ছিলেন, ততখানিই বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন। 
কেন বলছি? আমি দেখেছি, উনি টেকনিশিয়ানদের অভাব-অভিযোগ বুঝতে পারতেন। সেগুলো নিয়ে রীতিমতো ভাবতেন। নিজের মতো করে তাঁদের সাহায্য করতেন। মজার কথা হল, উনি সাহায্য করে সেটা কাউকে জানতে দিতেন না। কত সুন্দর তাঁর ব্যাপার। এই হল আমাদের উত্তমদা। কীভাবে তিনি উত্তম কুমার হয়ে উঠলেন, অনেকবার ভেবেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, একমাত্র কারণ, উনি অদ্ভুত রকমের খুঁতখুঁতে মানুষ। সাংঘাতিকভাবে সিরিয়াস। কোনও অবস্থাতেই সন্তুষ্ট হতেন না। সারাক্ষণ ওঁর মধ্যে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ওঁর শুধু মনে হতো, আরও একটু ভালো করা যেত। এরকম নিষ্ঠা সত্যিই ভাবা যায় না। আমি ওঁর সঙ্গে প্রথম ছবি করতে এলাম ‘মৌচাক’-এ। উনি আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, আমি এখানে নতুন কাজ করতে এসেছি। আর উনি তখন মধ্যগগনে। আমাকে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, ওঁর সামনে দাঁড়াতে আমার কোথাও একটা জড়তা কাজ করছে। যাতে ওই জড়তাটা কেটে যায়, দেখলাম উনিই নিজেই সেই চেষ্টা শুরু করেছেন। কীভাবে? আমার সঙ্গে গল্প-হাসি-ঠাট্টা শুরু করলেন। আমি বুঝতে পারলাম, যাতে আমি সহজ হয়ে যাই, ভয় না পাই, জড়তাটা কেটে যায়, সেই চেষ্টা করছেন উনি। আমার শ্যুট করতে গিয়ে, যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেই চেষ্টা করছিলেন। উত্তমদা আসলে কিন্তু গম্ভীর ধরনের মানুষ। এগুলো ওঁর করার নয়। আমি দেখেছি, শ্যুটিং ফ্লোরে এসে উনি সারাক্ষণই পাঠ নিয়ে ভাবেন। তার মধ্যেই হাসি-ঠাট্টা করলেন, একটু অবাকই হলাম। বুঝতে পারলাম, সামগ্রিক আবহাওয়াটা ঠিক করার চেষ্টা করছেন। ‘মৌচাকে’-এর পরিচালক ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। উনিও খুব গুনি লোক, রসিক মানুষ। উত্তমদার এই অবদানগুলো ভুলতে পারি না। ওরকম লোক খুব কমই আছেন। মানে বড় ভাই ঠিক যেভাবে ছোট ভাইকে আগলে রাখেন, সেই কাজটা উনি আমার সঙ্গে করলেন। নিঃসন্দেহে আমি ওঁর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। 
যখন ওঁর শট থাকত, আমি কিন্তু ফ্লোরে বসে থাকতাম। কোথাও যেতাম না। মুগ্ধ হয়ে ওঁর শট দেওয়া দেখতাম। আসলে আমার যা কিছু সবটাই দেখে দেখে শেখা। অন্যরা অনেকে অভিনয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমার সবটাই দেখে দেখে শেখা। কিছুটা বাড়ির ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। সেটা কাজে লেগেছিল ঠিকই। উত্তমদার কথা বলি। দেখলাম, কিছুদিন আগেও টেলিভিশনে ‘মৌচাক’ দেখাল। এই ছবিটা নিয়ে আমি একটা কথা বলব, ভেবে দেখুন এই ছবি আজ থেকে ৫০ বছর আগে তৈরি। অতদিন আগের এই ছবিটা দেখে মানুষ যেভাবে আনন্দ পেয়েছিলেন, আজও একইভাবে আনন্দ পান। এটা ভেবেই অবাক লাগে। আজকের প্রজন্মও এই ছবি দেখে একই রকমের উত্সাহ পান। ছবিটার এমনই মজা। ছবিটার মধ্যে অদ্ভুত বাঙালিয়ানা আছে। সারা পৃথিবীর বাঙালি এটা আজও সমান আনন্দে দেখেন। আহা! উত্তমদার সেই অভিনয় ভোলার নয়। বলা হয়নি, আমি ওঁকে উত্তমদা বলেই ডাকতাম। উনি আমাকে রঞ্জিত্ বলে ডাকতেন। যদি অন্যান্য অভিনেতার সঙ্গে উত্তম কুমারের তুলনা করি, তাহলে বলব, অনেকেই শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ঠাট্টা-রসিকতা করতেন। কিন্তু উত্তম কুমার একেবারেই আলাদা মানুষ। উনি কিন্তু শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বেশি কথাবার্তা বলতেন না। কাজের সময় কোনও হাসিঠাট্টা নেই। অনেককে দেখেছি, যখন হয়তো লাইট করা হচ্ছে, অন্যান্য সহ অভিনেতাদের সঙ্গে গল্প-রসিকতা করেন। আবার কাজের সময় সকলে কাজের মধ্যে ঢুকে যান। কিন্তু উত্তমদা এসবের মধ্যে থাকতেন না। মেকআপের সময় থেকেই উনি একদম চরিত্রে ঢুকে যেতেন। যেটাকে আমরা ক্যারেক্টারে ঢুকে যাওয়া বলি। একটা চরিত্রকে নিয়ে যতখানি একাত্ব হয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করতেন। 
শ্যুটিংয়ের কথা বলতে গিয়ে, একদিনের কথা হঠাত্ মনে পড়ে গেল। খুব সম্ভবত ‘শ্রীকান্তের উইল’ নামের একটা ছবির শ্যুটিং ফ্লোরের কথা। আমি তো সবসময়ই ওঁর শ্যুটিং দেখার জন্য সেটে বসে থাকতাম। ওই ছবির একটা দৃশ্য ছিল, উনি সিঁড়ি থেকে নেমে আসছেন। তখন মাথা ঘুরে তিনি সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবেন। আমি তো সেটা দেখার জন্য বসে আছি। অবাক হয়ে ভাবছি, কীভাবে করবেন। ঠিক দেখলাম, দোতলা থেকে নামলেন। আধাআধি জায়গায় এসে চোখটা বোজালেন। মনে হল, মাথাটা ঘুরছে। তারপর দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমি তো ভেবেছি, খুব লেগেছে বোধ হয়। পরিচালক কাট বললেন। দেখালাম, উত্তমদা উঠে দাঁড়ালেন। যখন শট দেওয়া হয়ে গিয়েছে, আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা করলেন কীভাবে? আমার তো বুক ধরফর করে উঠল। ভাবলাম, সাংঘাতিক লেগেছে হয়তো। প্রথমে বলতে চাইছিলেন না। সেরকম কিছু নয়, বলে চলে যাচ্ছিলেন। তারপর বললেন, এসব করতে গেলে, হাঁটুটা স্টিফ করে রাখতে হয়। তারপর রিলিজ করলেই নিজের থেকেই ব্যালান্স থাকে না। আর পড়ার সময় খুব খেয়াল রাখতে হবে কোমড়ে যেন না লেগে যায়। হাতটা ঠিক জায়গায় ফেলতে হবে। লোকে তো আর পর্দায় দেখে বুঝতে পারবে না। কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে এমনভাবে পড়তে হবে, যেন নিজের না লেগে যায়। এরকম বহু জায়গায় ওঁর শট দেওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এটাও বলতে হবে, ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলে, উনি সবটা বুঝিয়ে বলে দিতেন। কিন্তু কখনওই নিজে যেচে কিছু বলতেন না। গায়ে পড়ে এটা এভাবে করো, কিংবা ওটা ওভাবে করো, এইসব উনি জীবনে করেননি। এটাই ওঁর নিয়ম। মানে, আপনি কীভাবে ভেবেছেন, আমি জানি না। সেটা আমি আপনার উপর চাপিয়ে দেব কেন? এইরকম মানুষ ছিলেন উত্তমদা।          
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল 
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মরশুমি রোগের ভোগান্তিতে স্বাস্থ্যহানির যোগ প্রবল। কাজকর্মে কিছুটা আলস্য ভাব আসতে পারে। বিদ্যায় উন্নতির যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.৮৮ টাকা৮৫.৬২ টাকা
পাউন্ড১০৫.৩৯ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৭.২৫ টাকা৯০.৬০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     December,   2024
দিন পঞ্জিকা