বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
চারুপমা
 

মডেল: কৌশাম্বী চক্রবর্তী, দিয়া মুখোপাধ্যায় ও ইন্দ্রাণী পাল, ছবি: অরিজিৎ দত্ত, শুভাশিস পাচাল, পোশাক: রাহুল সর্দার, আয়োজক: মধুরিসা শীল, ব্যবস্থাপনা: রাজ বন্ধন, মেকআপ: মল্লিকা দাস, সুপ্রভা দাস, পম্পা, গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল

কাজের মাঝে সাজ 

নিজ কর্মক্ষমতায় তাঁরা সুপরিচিত। বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অধিকর্তা ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজের মাঝে কীভাবে নিজেকে সুন্দর রাখেন তাঁরা? কথা বললেন  অন্বেষা দত্ত। 
 
দু’জনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্যা। কাজের পরিধির বাইরেও তাঁদের দেখলে মন ভালো করা ইতিবাচক অনুভূতি যেন ঘিরে ধরে। চোখে পড়ে তাঁদের স্নিগ্ধ সাজগোজ। যা ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যায় না। কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও কীভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করার কাজটি সুচারুভাবে সামলান তাঁরা, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। 

মার্জিত রুচিবোধ
প্রাথমিক রুচিবোধ সাধারণত গড়ে ওঠে বাড়ির শিক্ষা এবং সংস্কৃতি মেনে। নিজেকে পাঁচজনের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যেটা খুব জরুরি। ব্রততীও বললেন, তাঁর যে শিল্পবোধ তৈরি হয়েছে, সেটা বাড়ি থেকেই। শৈশবে তিনি দেখেছেন মায়ের পরিপাটি সাজ। সেই রুচিই মনে গেঁথে গিয়েছে। এতে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলা সাহিত্যও। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বঙ্কিম পড়তে শেখা। সঙ্গে সংস্কৃত এবং ইংরেজি শিক্ষা। যদিও পরবর্তীকালে পড়াশোনার বিষয় হয়েছে অর্থনীতি, কিন্তু সাহিত্য-শিল্প-লেখালেখি-আবৃত্তি বরাবর তাঁর রক্তে ছিল, বলেন ব্রততী। পারিবারিক চৌহদ্দির মেলামেশা— সেখান থেকেও রুচি গড়ে ওঠে। কোন পরিস্থিতিতে কী পোশাক পরা উচিত, তা নিয়ে তাঁর বাবা-মা যথেষ্ট ভাবতেন, সেটা তিনি দেখে এসেছেন। তাই স্মরণসভার পোশাকের সঙ্গে উৎসবের পোশাক যে গুলিয়ে ফেলা যায় না, এই বোধটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল আগেই।
পরবর্তীকালে তাঁর সাজের আভিজাত্যে ভূমিকা ছিল দূরদর্শনের, জানালেন শিল্পী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সাজ নিয়ে মাথাব্যথা তাঁর ছিল না। একফোঁটা কাজলও দেওয়া হয়নি। লিপস্টিক তো নয়ই। দুই বিনুনি আর শাড়ি। খুব বেশি হলে ছোট টিপ। আজকাল যেটা ভাবাই যায় না, বলছিলেন তিনি। পোশাক বলতে ছিল শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ। প্যান্ট শার্ট পরার চল ততটা শুরু হয়নি। ফিরে গেলেন দূরদর্শনের কথায়। ব্রততী সেখানে দেখেছেন চৈতালি দাশগুপ্ত, শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, ছন্দা সেনের মতো ব্যক্তিত্বকে। মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের সুন্দর শাড়ি, পরিমিত মার্জিত সাজ দেখে। সেগুলো মনে দাগ কেটেছিল। সঙ্গে ছিল শান্তিনিকেতনের প্রভাব। । ঐতিহ্যবাহী সাজ এভাবেই ব্রততীর মননে জায়গা করে নিয়েছে। 

সাজ ভাবনা
আলাদা করে সাজ নিয়ে ভাবার শুরু কখন? ‘যখন দূরদর্শনে ঢুকেছি, তখনও আমি ছাত্রী। দেখতাম সবাই মেকআপ করছেন। তখন থেকে বুঝলাম সচেতন সাজ কাকে বলে। কোন খবরের সঙ্গে কোন সাজটা মানানসই হবে, এই চিন্তাগুলো এল। চোখে কাজল, লিপ লাইন এসব জানলাম! অন্যদের কীভাবে সাজানো হচ্ছে খেয়াল করতাম। একদিন বুঝে গিয়েছিলাম, ঠিক কতটা সাজ আমাকে মানায়। সেই অনুযায়ী, মেকআপ করানোর সময়ে বলে দিতাম বেশি না সাজাতে। সাজ যেন ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে না যায়।’ তাঁর মতে, মাত্রাবোধ না থাকলে সব আরোপিত মনে হয়। সেই ভাবনাটা আজীবন মাথায় রেখেছেন এবং তার সঙ্গে মিশেছে নিজস্ব রুচিবোধ। 
এই মরশুমে যেমন বসন্তোৎসব আর নারী দিবসে অনুষ্ঠানের সাজ কখনও এক হবে না, জানালেন শিল্পী। তিনি নারী দিবসকে নারীর ক্ষমতায়নের জায়গা হিসেবে দেখতে চান। তাই পোশাকে এমন কিছু রাখতে চান, যা সেটারই দ্যোতক। হয়তো শাড়ির আঁচলে মা দুর্গার মোটিফ। কবিতার মতোই শাড়ি বেছে নিতে চান তিনি। শাড়ির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গয়না, জুতো, ব্যাগ। সাজ মানে তাঁর কাছে সবটাই। 

ফ্যাশন না স্টাইল 
আরোপিত সাজ যে চোখে লাগে, সেটা বাকিরা বুঝবেন কীভাবে? ব্রততী বলেন, ‘এটা একেবারেই নিজস্ব ভাবনার উপরে নির্ভর করে। কেউ আবৃত্তি বা গান করতে এসে যদি ভাবেন মডেলিং করার মতো সাজ লাগবে, সেটা তো তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এটা বুঝতে হবে নিজেকেই।’ কাজের মাধ্যমে একটা স্তরে পৌঁছতে পৌঁছতে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। আর সেটাই সকলের থেকে আমাদের আলাদা করে। ব্রততীর মতে, ‘এই প্রজন্মের স্টাইল আর ফ্যাশন নিয়ে ধারণাটা স্পষ্ট নয়। সেই ‘শেষের কবিতা’ থেকেই বলি, স্টাইল তো মুখশ্রী। ফ্যাশন হল মুখোশ। নিজস্ব স্টাইল গড়ে তোলার তাগিদ নেই, মুখোশ পরে কী করে আলাদা হব? একবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। ওঁর গাড়িতে, উনি ড্রাইভ করছিলেন। সম্ভবত যাদবপুরের কাছে সিগন্যালে দাঁড়াতে হয়েছিল আমাদের। এক ঝাঁক তরুণী যাচ্ছে সামনে দিয়ে। অধিকাংশের পরনে জিনস টি-শার্ট। সৌমিত্রদা বললেন, আচ্ছা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের দেখো...সবাইকে একরকম লাগছে না? কাউকে কি আলাদা করে চোখে পড়ে? সবাই একইরকম। আমাদের কত সুন্দর পোশাক আছে, সবাই কেন একই পোশাক পরবে?’ কথাটা তাঁকে ভাবিয়েছিল। ব্রততী জানালেন যাতায়াতের সুবিধায় এধরনের পোশাক লাগে ঠিকই। কিন্তু নিজেদের ঐতিহ্যটা একেবারে ভুলে যাওয়া বোধহয় উচিত নয়। আবৃত্তিকারের ভালোলাগার শাড়ি? ‘রঙের কম্বিনেশনের দিকে খুব খেয়াল রাখি। পাড়ে গাঢ় রং থাকলে শাড়ির জমিতে হালকা রং। বাংলার তাঁত ঢাকাই খুব প্রিয়। দক্ষিণের শাড়িও ভালো লাগে। সরু পাড়ের শাড়ি বেশি পছন্দ। জবরজং রং বা কাজ ভালো লাগে না।’        

মায়ের থেকে শেখা
ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়ও সাজগোজের ক্ষেত্রে মায়ের কথা বললেন সবার আগে। নিজের খেয়াল রাখতে শেখা তাঁর মায়ের কাছে। তাঁর কথায়, ‘ছোটবেলায় মসুর ডাল বাটা বা কাঁচা হলুদ বাটা, নিমপাতা, দুধের সর, ময়দা, বেসন এসব দিতেন মা। চুলেরও যত্ন চলত।’ কলেজবেলায় পৌঁছনোর পর ভাবার সময় ছিল না। পড়ার চাপ তো বটেই, এমনিতেও যুগের ধর্ম মেনে মুখে ক্রিম, চোখে কাজল দিয়ে সাজ শেষ। তখনও মেকআপ খুবই অপরিচিত শব্দ তাঁর জগতে। ধৃতি বলছিলেন, ‘অন্তত কলেজ যাওয়ার জন্য মেকআপের ভাবনা ছিল বিলাসিতা। পরবর্তীতে মেকআপ মানে ক্রিমের উপরে ফাউন্ডেশন, সঙ্গে গাঢ় লাল লিপস্টিক ও বাড়িতে পাতা কাজল। কখনও সাজার জন্য মায়ের থেকেই ধার করতে হতো লিপস্টিক! সেটা ছিল নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সময় পরিচয় সানস্ক্রিনের সঙ্গে।’

মেকআপ শেখা
বিয়ের পর ধৃতি সামান্য বুঝলেন মেকআপ কাকে বলে! বিয়েতে প্রথামাফিক মেকআপ সামগ্রী কেনা হয়। সেগুলো পরে স্রেফ পড়ে থেকে নষ্ট হবে? তাঁর কথায়, ‘বিয়ের পরপর চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে কিছুটা সময় হাতে ছিল। নতুন বৌ হিসেবে কোথাও যেতে হলে সাজগোজও করতে হতো। সেই থেকেই মেকআপ-এর চর্চা শুরু। আমার স্বামী ডাক্তার। কাজের সুবাদে তাঁকে যেতে হয়েছিল ইংল্যান্ড। মেকআপ নিয়ে কতটা মাথা ঘামাতে পারে কেউ, বিদেশে গিয়ে বুঝলাম।’    
বিভিন্ন সুপারমার্কেট ব্র্যান্ড ঘুরে বুঝেছিলেন মেকআপ-এর বিস্তার। তাঁর নিজের আঁকার হাত ছিল তুখড়। সেই দক্ষতা কাজে লাগল মেকআপ-এ। ‘জানেন তো আইলাইনার লাগাতে একফোঁটা হাত কাঁপত না। ক্রমে ক্রমে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে মেকআপ করতে করতে ‘প্রো’ হয়ে গেলাম!’ ইংল্যান্ড থেকে তিনি আর একটা জিনিস শিখেছিলেন— প্রত্যেকে নিজেকে উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে ঠিক কতটা সচেতন। তাঁর মন্তব্য, ‘নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করার মধ্যে যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই, এই শিক্ষাটা হয়ে গিয়েছিল মনে মনে।’ সময়ের গতিতে তাঁর পদের ভার বেড়েছে। সেই শিক্ষাটা রয়ে গিয়েছে মনে। ‘তাই একটা যেমন-তেমন পোশাক পরে বেরিয়ে গেলাম, এই অভ্যাস কখনও ছিল না আমার।’ তাঁর ব্যস্ততার মধ্যে এভাবেই ঢুকে পড়ল মুখসজ্জায় ব্যয় করার ১০-১৫ মিনিট। সঙ্গে শাড়ি, ব্যাগ, সানগ্লাসেস, জুতো বেছে নেওয়ার সময়টাও।  

হাতে সময় 
বিজ্ঞানে নিমগ্ন মাথা সাজগোজে এত সময় দেয়? এ প্রশ্ন কখনও শুনতে হয়নি? ধৃতি বলেন, ‘এই ভাবনার মধ্যেই তো গলদ আছে। ইন্দ্রা নুয়ির কথা ভাবুন। কমলা হ্যারিসের কথা ভাবুন। জিল বাইডেন ভাবুন। অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ভাবুন। আরও পিছিয়ে মার্গারেট থ্যাচার। আমাদের আরও আপন ইন্দিরা গান্ধী। মহিলা ক্ষমতায়নের প্রতীক বলতে তো এঁদের কথাই মনে পড়ে। ইন্দিরার কালো সাদা চুলের দ্যুতি, শাড়ির মার্জিত উপস্থিতি, কোনও তুলনা হয়?’ 
যুগের তালে তালে নিজের সাজ-ভাবনা এগিয়েছে ধৃতির। তিনি বললেন, ‘জেডএসআই-এর প্রধানের পদে বসার পরে প্রচারের আলো এতটাই এসে পড়েছে যে ভাবতে বাধ্য হয়েছি সাজপোশাক নিয়ে। আগে নিজের মতো কাজের জগৎ গোছানো ছিল। লোকজন একই সার্কেলের। কিন্তু জেডএসআই-এর প্রধানের পদে আসার পরে ছবিটা বদলেছে।’ তাঁর কাজের দাবি এখন ‘অভিজাত উপস্থাপনা’। পদের ভার সামলাতে একটা ভারসাম্য রাখতেই হয়। কারণ তিনি জানেন, এমন শীর্ষ পদে ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।   
বিজ্ঞানী যখন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ান ফ্লোরা-ফনা খুঁজতে তখন সাজগোজ তো মাথায় ওঠে? ‘তখন শুধু সাবধানতা। চুল উঁচু করে বাঁধা। মুখে গাদা গাদা ওয়াটাপ্রুফ সানস্ক্রিন। সারা দিন ঘুরে এসে মুখটা দেখলে নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয়!’ ভালোলাগার কোন কোন শাড়ি? ‘প্রিন্টেড সিল্ক, তসর, কাঁথাকাজের শাড়ি অসম্ভব প্রিয়। হ্যান্ডলুমও বেশ ভালো। সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী কাঞ্জিভরম, বেনারসি। বেশি জরি বা চওড়া পাড়ের শাড়ি নয়।’
তাহলে কাজের মাঝে সাজের সময় বের করাই যায়। অন্তত ততটুকু, যতটুকু আপনার ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতা দেয়। 

4th     March,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ