পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
প্রথমে সংস্কৃত ভাষার ভৌগোলিক সীমানা ছিল কেবলমাত্র ভারতবর্ষের উত্তরাংশ। পরে তার সীমানা প্রসার লাভ করে ভারতবর্ষের পাশাপাশি থাকা জাতিগুলি যেমন দ্রাবিড়, অস্ট্রিক এদের মধ্যে। এছাড়া ভারতবর্ষের বাইরেও প্রতিবেশী দেশগুলিতে যেমন চীন, তিব্বত, সুমাত্রা, জাভা এবং ভারতের পশ্চিমের দেশগুলিতে, তাদের সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে এই সংস্কৃত। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল অংশেই কোনও না কোনও ভাবে ও রূপে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সংস্কৃতি এবং ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী, ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্যের মূল স্রোত হিসাবে সংস্কৃতের সমাদর লক্ষ করা যাচ্ছে। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বৌদ্ধিক চর্চার ধারাটিকে জানবার জন্য শুধু নয়, তার আশপাশের দেশগুলিরও কৃষ্টি ও মননের ধারাকে অনুধাবন করার জন্যও সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজন। তাছাড়া এই ভাষাতেই ব্যক্তির সকল চাওয়া-পাওয়া, ভালো থাকা ও ভালো রাখার ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষশাস্ত্র যেমন রচিত হয়েছে তেমনি বিষয়ের দিক থেকে দেখলে সেখানেও আমরা আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনুর্বেদ, দণ্ডনীতি ও আইনব্যবস্থা, বাস্তুশাস্ত্র বিষয়ক নানা গ্রন্থ পাই। যেমন— আয়ুর্বেদের উপর চরক ও সুশ্রুত সংহিতা, ধনুর্বেদ শিক্ষার জন্য ধনুর্বেদ সংহিতা, দণ্ডনীতি বিষয়ক মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশর সংহিতা, অর্থশাস্ত্র বিষয়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাস্তুশাস্ত্রের ওপরে ময়মতম্ ও সমরাঙ্গন সূত্রধার প্রভৃতি হল উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যগ্রন্থ। এছাড়াও রয়েছে চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্যশাস্ত্র বিষয়ক বহু সমৃদ্ধ গ্রন্থ। তাই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালোভাবে জানবার জন্য সংস্কৃত ভাষা শিক্ষারও প্রয়োজনীয়তা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমরা দেখি যে, অনেক সময়ই অনুবাদ সাহিত্যে মূল বিষয়টি অনেক দূরে সরে গিয়েছে! তার মূলেও থাকে ভাষাজ্ঞানের অভাব। শুধু ভাষা নয়, পরিভাষারও গুরুত্ব অনেকখানি, তা-ও কিন্তু প্রাচীন সব গ্রন্থে সংস্কৃত ভাষাতেই বলা রয়েছে। তাই পুরনো মেধার সঙ্গে পরিচিত হতে হলে কিংবা নবীনের প্রতিভার সঙ্গে প্রবীণের প্রজ্ঞার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্যও সংস্কৃত পঠনপাঠনের প্রয়োজন আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে! বিবেকানন্দও মনে করতেন— ‘‘...অবস্থা উন্নত করিবার একমাত্র উপায় সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করা।’
জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতের যোগ যেমন নিয়ত বর্তমান, তেমনই জীবিকার সঙ্গেও তার সংযোগ দাবি রাখে তার চরিষ্ণুতার, যা জীবনেরই অন্যতম ধর্ম, মৃতের নয়। ভারতের তথা বিশ্বের নানাপ্রান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রকেই তাই জীবিকা হিসেবে বেছে নিতে পারেন সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও আচার্য পাঠোত্তীর্ণগণ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—১) Manuscriptology বা পুঁথিতত্ত্ব বিজ্ঞান। পুঁথি সম্পাদনার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ও সংগ্রহশালায় রক্ষিত বিভিন্ন লিপিতে যেমন ব্রাহ্মী, শারদা, নেওয়ারি প্রভৃতিতে লেখা গ্রন্থগুলির পাঠোদ্ধারের জন্য সংস্কৃতভাষাবিদ্ ও সেইসঙ্গে লিপিবিশারদের প্রয়োজন হয়। তাই জীবিকা হিসাবে পুঁথিবিজ্ঞান ও লিপিজ্ঞান যথেষ্ট সহায়ক। ২) সংস্কৃত ভাষাতত্ত্ববিদ্— সংস্কৃত ভাষা ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বিজ্ঞানের জ্ঞান জরুরি। এক্ষেত্রে ভাষার গঠন, ব্যাকরণ ও রূপতত্ত্বের জ্ঞান আবশ্যক। ৩) যোগবিশারদ্ ও মনস্তত্ত্ববিদ্— ভারতীয় দর্শন বিশেষত যোগদর্শন বিষয়ে তত্ত্বগত ও প্রায়োগিক পারদর্শিতা আবশ্যক যার জন্য সংস্কৃত জানাটা খুব জরুরি। ৪) বাস্তুবিশারদ্— বাস্তুশাস্ত্র বিষয়ে যাঁরা আচার্য অর্থাৎ প্রাচ্যবিদ্যা পরম্পরায় সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন তাঁরা দেশ, কাল ও ক্ষেত্র বিশেষে বসবাসের অনুকূলতা ও প্রতিকূলতা বিচার করে বাস্তুনির্মাণ, রক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এঁরা Architecture/ Engineering/ Construction বা AEC স্থলেও বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ৫) ঔষধবিজ্ঞানী বা Pharmacologist— এঁরা সংস্কৃত ভাষায় লেখা ভারতীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষত ঔষধের দ্রব্যগুণশাস্ত্র বা Pharmacology বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠোত্তীর্ণগণ ভারতের সনাতন গণিতচর্চাকে আধার করে পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও সংগণক যন্ত্রে বা Computer-এর বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনেক সুযোগ পান। Indian Institute of Technology-র মতো স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাই সংস্কৃত মৌলিক বই পড়ার ক্ষমতা আছে এমন যোগ্য জনও চাকরির সুবিধা পেতে পারেন। ৭) দোভাষী ও অনুবাদক— ইতিহাসবিদ্, প্রত্নতত্ত্ববিদ্, লেখক, পুরাণতত্ত্ববিদ্ প্রমুখের কাছে সংস্কৃত ভাষায় রচিত আকর গ্রন্থসমূহের তথ্য ও তত্ত্বের অনুবাদ করতে হয়। তখন অনুবাদককে উভয় ভাষাতেই পারদর্শী হতে হয়, তাই এই বৃত্তি যাঁরা পছন্দ করবেন তাঁদেরও সংস্কৃত জ্ঞানটা জরুরি হয়। ৮) সংবাদমাধ্যম প্রভৃতি জনসংযোগ-মাধ্যমক রূপেও সংস্কৃত বিদ্যার্থীরা কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও দূরদর্শনে, বেতারে সংবাদপাঠক হিসাবে। ৯) শিক্ষকতা—সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি সকল প্রতিষ্ঠানেই সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চশিক্ষালাভের পর শিক্ষক ও অধ্যাপকরূপে কাজ করার বহু সুযোগ রয়েছে। ১০) বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালাগুলিতে পুরাতত্ত্ব, পুঁথি সংরক্ষণ ও বিভিন্ন বিষয়ে জুনিয়র ও সিনিয়র রিসার্চ স্কোলার রূপে কাজ করার সুযোগ পান সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা। ১১) Junior Commissioned Officers-এর মধ্যে ‘Religious Teacher’ রূপেও এই বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং শাস্ত্রী ও আচার্য পাঠোত্তীর্ণগণ সুযোগ পেয়ে থাকেন। ১২) এছাড়াও এই বিষয়ে পড়াশোনা করে কর্মকাণ্ড বিষয়ে এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করা থাকলে পৌরোহিত্য কার্যের সুযোগ পাওয়া যায়। ১৩) এছাড়া সংস্কৃত ও প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে উচ্চশিক্ষা লাভের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ তো থাকেই।
স্বদেশে ও বিদেশে এমনি নানাক্ষেত্রে সংস্কৃত জানা মানুষের কাজের অনেক সুযোগ আছে। বৃত্তির সুযোগ যা আছে তারপরেও কিন্তু একটা সত্য মনে রাখতে হবে যে, যাঁরা সংস্কৃত ভাষা ও একই সঙ্গে সংস্কৃতিকে বুকে করে বহন করে চলেছেন, তাঁরাই প্রবহমান ধারায় বিদ্যাবংশ রেখে যেতে পারেন। যেটা সবসময় জাতির ঐতিহ্যকেই অগ্রবর্তী করে। এখানেই আজকের জীবনেও সংস্কৃতের প্রাসঙ্গিকতা উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা—গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ তাদের জীবন-যাপন, শিক্ষা-সংস্কৃতি আলাদা হলেও মন্ত্রোচ্চারণের সূত্রে আজও সংস্কৃতের পদপ্রান্তে সমবেত হয়। সংহত হয়। তাই বলা যায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভাষা হল সংস্কৃত!
সংস্কৃতের প্রচার ও প্রসার বিষয়ে বর্তমানে নতুন উদ্যোগে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার পূর্বতন সংস্কৃত কলেজটি আজ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে বর্তমান পরীক্ষা-ব্যবস্থা ও শিক্ষা পদ্ধতির আধুনিকীকরণ মাথায় রেখে টোল বিভাগে বা প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে শাস্ত্রী ও আচার্য পাঠক্রমও আছে। এছাড়াও রয়েছে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ। যেমন এই সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরও একটি শাখা বিশ্বমানের সংস্কৃত চর্চা কেন্দ্র সংস্কৃতেরই পীঠস্থান নবদ্বীপে নির্মিত হয়েছে। তাই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সেই সংস্কৃত কলেজকে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগর, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, লক্ষ্মণশাস্ত্রিদ্রবিড় প্রমুখ মনীষীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে যে সংস্কৃত চর্চা শুরু হয়েছিল আজ সেই চর্চাকেই উৎসাহিত করে বিশ্ববিদ্যার প্রাঙ্গণে এই সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশ ঘটেছে। এই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন যেখানে হচ্ছে সেই প্রচেষ্টাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ ও প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগের নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা। বলা যায় ভরসা করার মতো একটা জায়গা তৈরি হয়েছে।
(লেখক: সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওএসডি)