বৈষ্ণোদেবী  পর্ব-৭    

এবারে যাওয়া যাক মাতা বৈষ্ণোদেবীর দরবারে। ইনি হলেন হিমালয়ের প্রসিদ্ধ নয় দেবীর অন্যতমা। হাওড়া শিয়ালদহ বা কলকাতা স্টেশন থেকে জম্মু যাওয়ার ট্রেনের অভাব নেই। জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস বা হিমগিরি এক্সপ্রেস অনেকেরই খুব পছন্দের ট্রেন। কিন্তু আমি বৈষ্ণোদেবী গেলে হরিদ্বার হয়ে যাই। হরিদ্বারে দু’চারদিন বিশ্রাম নিয়ে ঋষিকেশ থেকে আসা সন্ধ্যার হেমকুণ্ড এক্সপ্রেসে রওনা দিলে পরদিন খুব ভোরে জম্মুতে পৌঁছনো যায়।
এই ট্রেনটির জন্য কাটরাগামী একটি ডিলাক্স বাস ওই সময় স্টেশন চত্বরে অপেক্ষা করে। তবে কোনও কারণে সেই বাস না পেলে যে কোনও লোকাল বাসে চেপে বড় বাস আড্ডায় গেলে অনেক বাসের দেখা মিলবে। জম্মু থেকে কাটরার দূরত্ব বাহান্ন কিলোমিটার। সমুদ্রতল থেকে কাটরার উচ্চতা ২ হাজার ৯১৮ ফুট।
কাটরাতেও অনেক মন্দির মঠ ইত্যাদি আছে। আছে হোটেল লজ ও উত্তম যাত্রীনিবাস। তবে আমার মতো একক যাত্রীদের অবশ্য কাটরায় থাকার প্রয়োজন হয় না। বৈষ্ণোদেবী যাত্রীদের উচিত বাস থেকে নেমে প্রথমেই বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে ট্যুরিস্ট সেন্টারে গিয়ে পুর্চি সংগ্রহ করে নেওয়া। এতে সময়সীমা দেওয়া থাকে। এর জন্য কোনও টাকা পয়সা লাগে না। এই পুর্চি (যাত্রীর পরিচয়পত্র) না থাকলে বৈষ্ণোদেবী তীর্থে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না। বাণগঙ্গা চেকপোস্টেই সেনাবাহিনীর লোকেরা আটকে দেবে। সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় পাহাড়ে কত যাত্রী গিয়েছে তার ওপর নির্ভর করে। এখানকার ট্যুরিস্ট সেন্টারেই যাত্রীদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা ও ক্লক রুম আছে। সেখানে মাল রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ‘জয় মাতাদি’ ধ্বনি তুলে যাত্রা শুরু করতে হয়।
কাটরা থেকে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের দূরত্ব ১৪ কিমি। আর বাণগঙ্গা গেট ২ কিমি। এ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য পাঁচ টাকা শেয়ারে অটোও পাওয়া যায়। তবে আমি প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে হেঁটেই গিয়েছিলাম। বৈষ্ণোদেবী যাত্রায় কোনও সময়-অসময় নেই। মন হলেই যাওয়া যেতে পারে। এখানে সকাল সন্ধ্যা দুপুর রাত্রি সব সময়েই যাত্রীর আনাগোনা। তবে গরমের দিনে এলে পর্বতারোহণ সন্ধ্যার পরই করা উচিত। আমি একবারই মাত্র রাতে দর্শনে গিয়েছিলাম। তারপরে গিয়েছি নভেম্বরে। প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় দেবীদর্শন।
যাই হোক, কাটরা থেকে বাণগঙ্গায় এসে পুর্চি দেখিয়ে দর্শনী দরওয়াজা পার হতে হয়। এখানে বৈষ্ণোদেবীর চরণগঙ্গার (বাণগঙ্গা) করুণাবারি মাথায় নিয়ে লাঙ্গুরবীর ও শেরোবালী মাতার (দুর্গা) দর্শন সেরে বৈষ্ণোদেবীর পথে রওনা দিতে হয়।
এই জায়গা থেকেই অনেকে ডাণ্ডি, কাণ্ডি অথবা ঘোড়ার ব্যবস্থা করেন। আমার অবশ্য ওসবের প্রয়োজন হয় না। এরপর দ্বিতীয় দর্শনী দরওয়াজা পার হয়ে একেবারে চরণ-পাদুকায়। এই স্থানটি দারুণ মাহাত্ম্যপূর্ণ। এখানে বৈষ্ণোদেবীর চরণচিহ্ন আছে। এই স্থানটির উচ্চতা ৩ হাজার ৩৮০ ফুট। এইভাবে এক সময় যাত্রীরা এসে পৌঁছন আদিকুমারীতে। এখানেও পুর্চি দেখিয়ে নম্বর নিতে হয়। কেউ যাত্রাপথে প্রথমেই দর্শন করেন আদিকুমারীকে। কেউ বা বৈষ্ণোদেবী ও ভৈরোবাবাকে দর্শনের পর ফেরার পথে আদিকুমারী দর্শন করেন। আমি ফেরার পথেই করেছিলাম।
আদিকুমারীর পর বেশ খানিকটা চড়াই পেরোলে যাত্রীরা এসে পৌঁছন হাতি মত্যায় (৬ হাজার ৫০০ ফুট)। হাতির পিঠের মতো উচ্চতা ও মাথার মতো সমতলের কারণে স্থানটির নাম হাতি মত্যা বা হাতি মাথা।
এরপর সঞ্জীছত। এর উচ্চতা ৭ হাজার ২০০ ফুট। এক সময় এই সঞ্জীছত খুবই দুর্গম ছিল। বৈষ্ণোদেবী তীর্থযাত্রায় এসে কোন বছরে কত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এখানে তার একটা তালিকাও রয়েছে সরকারি ফলকে। এখন অবশ্য ভয়ের কোনও ব্যাপার নেই। সঞ্জীছতের পরই বৈষ্ণোদেবীর গুহামন্দির। এখানেও পুর্চি দেখিয়ে নম্বর নিতে হয়। ক্লক রুমে ব্যাগ জুতো ইত্যাদি রেখে দর্শনের লাইনে দাঁড়ালেই অভীষ্ট পূরণ। বৈষ্ণোদেবীর গুহাটি লম্বায় ৩৬.৩১ মিটার। চওড়ায় ১.৮২ মিটার। উচ্চতায় ২.২১ মিটার।
বৈষ্ণোদেবীর এই মন্দিরে পিণ্ডিরূপ দর্শন। গুহার শেষ প্রান্তে যেখানে দেবীর স্থান সেখানে আছেন মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। গুহার এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে অত্যন্ত বেগবতী চরণগঙ্গার ধারা। এখানে চলমান অবস্থাতেই দর্শন করতে করতে চলে যেতে হয়। কেননা উদয়াস্ত দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই আছে এখানে। আমিও এই ভাবেই দু’দুবার বৈষ্ণোদেবীকে দর্শন করেছিলাম। দর্শন শেষে প্রসাদের প্যাকেটও পেয়েছি। তাতে বৈষ্ণোদেবীর একটি কয়েনও ছিল। এ জীবনে এও আমার এক পরমপ্রাপ্তি।
আদিকুমারী এবং বৈষ্ণোদেবী উভয় স্থানেই থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে।
বৈষ্ণোদেবী দর্শনের পর ভৈরোবাবাকে দর্শন করতে হয়। মন্দির থেকে প্রায় তিন কিমি উচ্চতায় ভৈরোবাবা। সেখান থেকে সর্পিল পথে নেমে আদিকুমারীতে। এ ব্যাপারে বিশদ জানতে আমারই লেখা ‘হিমালয়ের নয় দেবী’ পড়ে দেখতে পারেন।
দর্শন শেষে কাটরায় নেমে জম্মুতে গিয়ে বিশ্রাম। সেখানেও রঘুনাথ মন্দির, হরি সিং মিউজিয়াম ও আরও অনেক কিছু দেখার আছে। হাতে সময় থাকলে শ্রীনগর ও পহেলগাঁও থেকেও ঘুরে আসা যায়। না হলে প্রত্যাবর্তন।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল