সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
বারাণসীর পর বৃন্দাবন। আমি বারাণসীতে এলে এখান থেকে মরুধর এক্সপ্রেসে বৃন্দাবনে যাই। গাড়িটি বিকেল তিনটে নাগাদ ছাড়ে এবং পরদিন সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে মথুরায় পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে অটো অথবা ট্রেকারে বৃন্দাবন।
হাওড়া থেকে যাঁরা যান তাঁরা লেট লতিফ তুফান এক্সপ্রেসেই যান। তবে এই ট্রেনের অত্যধিক ভিড়ের কারণে অনেকে পূর্বা এক্সপ্রেসে আলিগড়ে নেমে বাসে অথবা প্রাইভেট গাড়িতে বৃন্দাবনে যাত্রা করেন।
‘আমি বৃন্দাবনে বনে বনে ধেনু চরাবো’— সেই কৃষ্ণ বৃন্দাবনে এখন বন নেই। যা আছে তা কংক্রিটের বন। তবুও শ্রীরাধাগোবিন্দের সেই লীলাভূমি ধর্মপ্রাণ নরনারীর কাছে আজও অতি প্রিয় স্থান।
বৃন্দাবনে এসেছি আমি বারে বারে। আমার লেখা ‘রাধা বৃন্দাবনে বনে’ বইতে তার বিশদ বিবরণও আছে। এখানে এলে থাকার জায়গারও অভাব নেই। ভারত সেবাশ্রম সংঘ ও শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠ অনেকেরই অত্যন্ত প্রিয়। আমি অবশ্য বৃন্দাবনে এলে আদ্যাপীঠ রামকৃষ্ণ সংঘের রাধাকান্ত মন্দিরে উঠি। এখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে অক্ষয় তৃতীয়া ও দোলের দিন থেকে পঞ্চমদোল পর্যন্ত সময়টা আমার খুবই পছন্দের।
এখানে একটি প্রবাদ আছে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে এখানকার প্রাণপুরুষ গোবিন্দ-গোপীনাথ ও মদনমোহনকে দর্শন করলে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণের দর্শন হয়। বৃন্দাবনে দেখার মতো অনেক মঠ ও মন্দির আছে। এগুলো সবই হাঁটা পথের দূরত্বে। ভারত সেবাশ্রম ও গৌড়ীয় মঠের যাত্রীরা কোনও যানবাহন না নিয়েই অল্পদূরত্বের রঙ্গজির মন্দিরে এসে ধন্য হতে পারেন বিগ্রহ দর্শনে। এই মন্দিরেই আছে সেই বিখ্যাত সোনার তালগাছ। এরপর রম্য মন্দিরের পিছনদিকে কিছুটা পথ গেলেই পড়বে লালাবাবুর প্রতিষ্ঠা করা ‘কৃষ্ণচন্দ্রমার’ মন্দির। তারও পরে গোপেশ্বর দর্শন করে আবার রঙ্গজির মন্দিরের সামনে জনবহুল রাস্তায়।
এবার যেতে হবে গোবিন্দজির দর্শনে। পাথরপুরার গলির (রঙ্গজির মন্দিরের সামনে)। মধ্যে সিংহপৌড়ি হনুমান দর্শনের পর গোবিন্দজির মন্দিরে। প্রথমেই পুরাতন মন্দির। তার পিছনেই নতুন মন্দির। বৃন্দাবনে গোবিন্দজি হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ। তবে শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভর তৈরি মূল মূর্তিটি এখন জয়পুরে। গোপীনাথ এবং মদনমোহনের মূর্তিও এখন জয়পুরে। বর্তমানে যা, তা পরবর্তীকালের প্রতিষ্ঠা করা মূর্তি। বৃন্দাবন মাহাত্ম্যে বলা আছে গোবিন্দজি হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখারবিন্দ। গোপীনাথ হলেন বক্ষ। মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণের চরণযুগল। এক সূর্যে তাই শ্রীকৃষ্ণদর্শন।
গোবিন্দমন্দির থেকে হাঁটাপথে অথবা অটো বা রিকশয় যেতে হবে বাঁকেবিহারীর মন্দিরে। গোবিন্দজির মন্দির ও বাঁকেবিহারী মন্দিরের আরতি দর্শন মনকে মাতিয়ে দেয়।
বৃন্দাবনের এলে নিধুবন ও নিকুঞ্জবন দর্শন আর এক প্রাপ্তি। নিধুবনের পাশ দিয়েই যমুনার পথ। তবে কৃষ্ণলীলাকালের সেই যমুনা এখন জলদূষণে কর্দমাক্ত। তাই নৌকাযোগে ওপারে গিয়েই স্নান করেন সবাই।
নিধুবনের পথেই বাঁদিকের গলিতে শ্রীরাধা দামোদর, রাধা শ্যামসুন্দর ও শালগ্রাম মন্দির না দেখলে বৃন্দাবন দর্শন অসম্পূর্ণ হয়। তাছাড়া গোপীনাথ বাজারের কাছে ভজনাশ্রম দেখে বড় মহাপ্রভুর দর্শনেও এক অপার্থিব শান্তি লাভ করা যায়। এরপর যমুনার তীর ধরে চীরঘাট থেকে কেশীঘাট অথবা কালীয় দমন ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার আনন্দই আলাদা। এ পথেই পড়ে কৃষ্ণলীলাকালের সেই বিখ্যাত ইমলিতলা। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যেখানে বসে রাধাভাব কান্তি ধরে নদীয়ানগরে আবির্ভাব হবার বাসনা করেছিলেন।
আসলে বৃন্দাবনে এত মঠ মন্দির ও দর্শনীয় স্থান আছে তা খুঁটিয়ে দেখতে গেলে বেশ কয়েকটা দিন থাকতে হয় এখানে। আর বৃন্দাবন পরিক্রম করলে তো মানসিক শান্তি ও আনন্দের অবধি থাকে না। কেশীঘাট থেকে পদব্রজে দু’তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বৃন্দাবন পরিক্রমা করে আবার কেশীঘাটে ফিরে আসা যায়। অবশ্যই খালি পায়ে ঘুরতে হয়। তবে ব্রজ চৌরাশী ক্রোশ পরিক্রমা সময়ের ব্যাপার এবং এটি দলবদ্ধ হয়েই ঘোরা উচিত।
বৃন্দাবনে বর্তমানকালের দুটি মন্দির হল ইসকন মন্দির ও কৃপালু মহারাজের মন্দির। এই দুই মন্দিরও দর্শনীয়।
বৃন্দাবন থেকে গাড়ি নিয়ে শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, গিরিগোবর্ধন বর্ষানা ও নন্দগাঁও দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়। তবে গিরিগোবর্ধন পরিক্রমা করতে গেলে রাধাকুণ্ডের ধারে ‘মীরা মনোরঞ্জন’ ধর্মশালায় এক রাত অন্তত থাকা উচিত।
এরপর আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরা। এখানে থাকার দরকার হয় না। বৃন্দাবন থেকে অটো ট্রেকার ইত্যাদি নিয়ে একবেলায় কংসের কারাগার (শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান) ও বিশ্রাম ঘাট দেখে ফিরে আসা যায়।
শ্রীকৃষ্ণ বারে বারেই বলেছেন, ‘বৃন্দাবনং পরিত্যজ্যং পাদমেকং ন গচ্ছামি।’ তবুও তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় গিয়ে সেখান থেকে দ্বারকায় স্থিতি হওয়ায় ব্রজবাসীরা কৃষ্ণের চেয়ে রাধারানিকেই মান্যতা দেন বেশি। তাই পথে ঘাটে সর্বত্র একটাই নাম শোনা যায় ‘রাধে রাধে’। আর আমরা অভিমান ভুলে বলি ‘জয় রাধে গোবিন্দ শ্রীরাধে গোবিন্দ।’ (চলবে)