পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
‘একটাই সমস্যা বুঝলেন তো! ভালো কারিগর পাওয়া যায় না। আসে, আবার চলে যায়। অথচ মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কারণ বাঙালি মিষ্টির খ্যাতি তো দেশজুড়ে।’ চিন্তিত সুফলচন্দ্র কৈরী। সিনেমার চিত্রনাট্যের চিরাচরিত একটি জনপ্রিয় ফর্মুলা হল, নিরন্ন গরিব থেকে জীবনসংগ্রাম করে সমাজে উচ্চতম আসনে স্থান পাওয়া। সুফলচন্দ্র কৈরীর কাহিনিটা অনেকটাই ওরকম। পুরুলিয়ার পুকুরবেড়িয়া গ্রাম থেকে ১৪ বছর বয়সে বেরিয়ে গেলেন সুফল। কারণ সংসারের দারিদ্র। এক গ্রামবাসী বলেছিলেন ধানবাদে নাকি কাজ পাওয়া যায়। সোজা ধানবাদ। একটি বাড়িতে পরিচারকের কাজ দিয়ে শুরু হল সুফলচন্দ্রের লড়াই। একদিন এক কোলিয়ারির ম্যানেজার ঢুকিয়ে দিলেন কয়লা খনিতে। দিনের পর পর মাসের পর মাস ১০ হাজার ফুট নীচে কয়লা সাম্রাজ্যে অন্য জীবনে ঢুকে পড়লেন সুফল। ছেলেটির মধ্যে খারাপ অভ্যাস নেই। চুরি চামারি করে না, খারাপ নেশা নেই, ভদ্র ব্যবহার। অতএব শুধুই কোলিয়ারিতে জীবন কাটিয়ে দেবে? ম্যানেজারের দয়া হল। তিনি একদিন বললেন, ‘লখনউতে আমাদের একটা প্রেস আছে। ওখানে চলে যাও। প্রেসের কাজ করবে। এর থেকে ভালো।’ চলেই গেলেন সুফল লখনউ।
একটানা ৯ বছর। কিন্তু আবার তাঁর পায়ের সরষে বলল ঠাঁই পাল্টাও। কোথায়? এবার ফৈজাবাদ। একটা বইয়ের দোকানে কাজ পাওয়া গেল। মাত্র সাত আট কিলোমিটার দূরেই অযোধ্যা। তাই ঘনঘন অযোধ্যায় যাতায়াতের সেই শুরু। ‘গোকুলভবনে এসে থাকতে পারো।’ বলেছিলেন এক আশ্রমিক। অযোধ্যায় ঘোর লেগে গেল সুফলের। চলে এলেন। কিন্তু কাজ কোথায়? ফুচকা, আলু কাবলি আর ছোলামটর নিয়ে ভ্যানে করে সারাদিন ধরে বিক্রি করা শুরু হল। সুফলচন্দ্রকে এক দোকানি বললেন, ‘সবাই শুধু লাড্ডু বিক্রি করে। তুমি বাঙালি, একটা অন্য মিষ্টির দোকান দাও। চলবে।’ মনে ধরল সেই পরামর্শ। আর ভাগ্যের চাকা এমনই যে, ভাড়ার দোকানটা পাওয়া গেল একেবারে রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদের গেটের সামনেই। সবেমাত্র একটু একটু করে থিতু হচ্ছে ব্যবসাটা। ঠিক তখনই এল সেই দিনটি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। মসজিদটা ভাঙলই। একদিনের মধ্যেই সুফল চন্দ্রের দোকানও চলে গেল ইতিহাসের অভ্যন্তরে। সব হারিয়ে সুফলচন্দ্র আবার রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। তারপর ফের শূন্য থেকে লড়াই শুরু। আর আজ অযোধ্যায় যে কোনও প্রান্তে বাঙালির দোকান কোথায় জানতে চাওয়া হলে, সকলে একবাক্যে চিনিয়ে দেবে সুফলচন্দ্র কৈরীর দোকান। একমাত্র বাঙালি দোকান গোটা অযোধ্যায়। হনুমান গড়হির পাশেই। যে ছেলেটি পুরুলিয়ার গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে ধানবাদে বাড়ির কাজের লোক হিসেবে জীবন শুরু করেছিল, সেই ছেলেটির পরিচয় কী হল পরবর্তীকালে? সেই কাজের ছেলে, সেই কোলিয়ারির শ্রমিক অযোধ্যা সিটি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হলেন একদিন। এই অবিশ্বাস্য জার্নির মালিক সুফলচন্দ্র কৈরী ওই যে বসে আছেন দোকানে দিনভর। সেই কবে ছেড়েছেন ঘর। ছেড়েছেন বাংলা। রামজন্মভূমি, বাবরি মসজিদ, হিন্দু, মুসলিম বিতর্কের এপিসেন্টারে বসে ওই যে দোকানের দেওয়াল ভর্তি অরবিন্দ ঘোষ থেকে স্বামী বিবেকান্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বসে আছেন সুফল।
রামচন্দ্র নয়। সীতা মাঈয়া নয়। হনুমানজি নয়। তাঁরা তো আছেনই। কিন্তু লক্ষ্মীকান্ত মিশ্রের প্রত্যক্ষ ভগবান দু’জন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং স্বামী বিবেকানন্দ। অযোধ্যা মার্কেটের থেকে রামবল্লভ কুঞ্জ আর জানকী ঘাটের দিকে যাওয়ার রাস্তায় চোখে পড়বে একটি উঁচু রোয়াক। একটি ঘরে ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর চেয়ারের পিছনে দুটি ফোটোফ্রেম। নেতাজি আর স্বামীজি। লক্ষ্মীকান্ত মিশ্র ফৈজাবাদ কোর্টের আইনজীবী। অযোধ্যায় এটাই তাঁর চেম্বার। বাড়ি থেকে চলে এসে লক্ষ্মীকান্ত মিশ্র প্রতিদিন সকালে উঠে ধূপ আর প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করেন এই দু’টি ছবিকে। নেতাজি ও স্বামীজি। বললেন, ‘এই দুটি মানুষকে ভারতবাসী যদি ফলো করে, যদি সকলেই এদের পুজো করে, তা হলে আর রাজনীতি করা লোকগুলো আমাদের বোকা বানাতে পারবে না বুঝলেন তো! তাই আমার ঈশ্বর এই দু’জন।’ সবেমাত্র কাল সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরিয়েছে মন্দির মসজিদ নিয়ে। আজ তো সব দোকানপাট বন্ধ। আপনি চেম্বার খুলেছেন কেন? কেউ তো আসছেও না আজ। যদি গোলমাল হয়? ‘গোলমাল?’ লক্ষ্মীকান্ত মিশ্র হাসলেন। ‘অযোধ্যার হিন্দু-মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে কোনওদিন আজ পর্যন্ত লড়াই করেনি। কোনওদিন না। সব বাইরে থেকে আসা লোকগুলো ঝামেলা করেছে। ১৯৯২ সালেও তাই। এই আমাকেই দেখুন না। আমার বেশিরভাগ মক্কেলই মুসলিম। তারা আমাকে মারবে? নাকি আমি মারব? আমার বাড়ির সব অনুষ্ঠানে টেন্ট ভাড়া করি সাজ্জাদের থেকে। আমি ওকে মারব? আর ভয়ে চেম্বার খুলব না কেন? সকালে নেতাজি স্বামীজিকে প্রণাম করতে হবে না! ওটা তো রোজের অভ্যাস!’ শ্রীরামচন্দ্রের নগরীর এক গলিতে নেতাজি আর স্বামীজিকে উকিলের চেম্বারে প্রতিদিন ঈশ্বরজ্ঞানে বন্দনা করা হচ্ছে, এই দৃশ্যই জানিয়ে দিচ্ছে, বৈচিত্র্যময় এই ভারতীয় সমাজে জীবনদর্শনের আয়তনটি আসলে অনেকটাই বড়। কতটুকুই বা দেখেছি! কতটাই বা স্পর্শ করা সম্ভব!
নিয়মটা হল তীর্থস্থান, উৎসব, মেলায় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশের কণ্ট্রোল রুমে খুঁজে পেলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে পুলিশকে ধন্যবাদ-টন্যবাদ জানিয়ে স্বজনের হাতটি আরও শক্ত করে ধরে দ্রুত চলে যাওয়া। এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবশেষে স্বামী রামকিশোর যাদবকে দেখেও হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীর মুখে হাসি ফুটলেও এখনই তিনি যাবেন না। কণ্ট্রোল রুমেই থাকবেন। ‘কেন? আর কী কাজ এখানে?’ রামকিশোর জানতে চান। পাশে বসা মহিলাকে দেখালেন রাজকুমারী। তুলসী উদ্যানের কন্ট্রোল রুমে এতক্ষণ পাশাপাশি বসে ছিলেন রাজুকমারী আর নুরাদেবী। তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন অযোধ্যার কার্তিক পূর্ণিমার ভিড়ে। অনেক বার পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ ঘোষণা চলছে তাঁদের স্বামীদের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ পর রাজুকমারীর স্বামী রামকিশোর যাদব দিশাহারা ভাবে কণ্ট্রোল রুমে ঢুকে স্ত্রীকে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু স্ত্রী যাবেন না এখন। তিনি জানালেন, এই এতক্ষণ ধরে যে মেয়েটির সঙ্গে অধীর অপেক্ষায় প্রবল উদ্বেগ আর কান্না ভাগাভাগি করলেন, সেই নুরাকে ছেড়ে যাবেন কী ভাবে? রাজকুমারী না হয় স্বামীকে পেলেন, নুরার স্বামী তো এখনও আসেনি! একটু আগেও কেউ কাউকে চিনত না। বিহারের নওয়াদা জেলার ভরোসা গ্রামের রাজকুমারীর সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকির নুরার আলাপ এই কন্ট্রোল রুমেই। দু’জনেই কার্তিক পূর্ণিমায় হারিয়ে গিয়েছেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দুজনের স্থান হয়েছে। পাশাপাশি বসে সেই আলাপ। দু’জনের অধীর অপেক্ষা ছিল কখন আসবে স্বামী। রাজকুমারী স্বামীকে পেয়েছেন। কিন্তু রাজুকমারীর জেদ, যতক্ষণ না নুরার স্বামী আসছে, ততক্ষণ নুরাকে ফেলে তিনি যেতে পারবেন না। রাজকুমারী স্বামী রামকিশোরকে হেসে বললেন, ‘যাও আমাদের জন্য সামোসা নিয়ে এসো। কতক্ষণ কিছু খাইনি।’ হতভম্ব রামকিশোর চাপা স্বরে বললেন, ‘আরে আমরা কতক্ষণ ইন্তেজার করব। ওর আদমি যদি না আসে? ট্রেন ছুটে যাবে না?’ রাজুকমারী বললেন, ‘ভরোসা রাখো। আসবে। তুমি যেমন এলে।’ তখন কার্তিক পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে সরযূ নদীর উপরে। নুরা আরও শক্ত করে ধরলেন রাজকুমারীর হাত। চোখে জল এবং ভরসা! সরযূর দিক থেকে একটা বাতাস এল। বসল রাজুকমারীদের পাশে। আশ্বাস হয়ে। বাসুদেব ঘাটে তখন যজ্ঞ শুরু হয়েছে। বিশ্বকল্যাণের!
..............................................................
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় উজ্জ্বল দাস