পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
তায়েব এসে একদিন বলল, ‘তোমাকে বি এস থাপা ডাকছেন। একটা নাটক নিয়ে। চার্চ গেটের গে লর্ড কফি শপে। যেতে পারো।’ যতীন্দর বেশ উৎফুল্ল। বি এস থাপা খুব গুণী মানুষ। থিয়েটার জগতে খ্যাতনামা। থাপা দেখলেন যতীন্দর ছেলেটির কথা বলার মধ্যে একটা বিশেষ সুর আছে। টেনে টেনে কথা বলে। আর সংলাপ ডেলিভারিটাও অন্যরকম। মাঝেমধ্যেই মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। সেটা কি ম্যানারিজম? যাই হোক। সুদর্শন একটা যুবক দরকার নাটকে। তাই যতীন্দরকেই সিলেক্ট করা হল। তাঁর বিপরীতে মেয়েটি খুব আড়ষ্ট। কিন্তু অত্যন্ত সুন্দরী। নাম অঞ্জু মহেন্দ্র। অঞ্জুর পরিচয় বেশ উচ্চমানের। সঙ্গীত পরিচালক মদনমোহন তাঁর মামা। আর ফিল্মিস্তান স্টুডিওর অন্যতম মালিক হলেন মেয়েটির দাদু। যতীন্দর আর অঞ্জু চার্চ গেটের গে লর্ড কাফে শপে দেখা হওয়ার দিন থেকেই একে অন্যকে পছন্দ করে ফেলল। সেই পছন্দ এগতে লাগল রিহার্সালের হাত ধরে এক অন্য পরিণতির দিকে। সেই কাহিনিতে আমরা ঢুকব না। আমরা বরং দেখি যতীন্দর ওই নাটকের মাধ্যমে কী পেল?
যতীন্দরের একটা শখ। সাজগোজ। সর্বদাই সে টিপটপ জামাকাপড়ে। এটা সে শিখেছে তার এক স্কুলের বন্ধুর থেকে। বন্ধুটির নাম রবি। রবি কাপুর। মুম্বইয়ের গিরাগাঁও এলাকায় সেন্ট সেবাস্টিয়ান গোয়ান স্কুলে ক্লাস টু থেকে একসঙ্গে পড়েছে রবি আর যতীন্দর। সেই রবি ওই ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড স্মার্ট আর ঝকঝকে জামাকাপড় পরতে পছন্দ করত। রবিকে দেখেই যতীন্দরও সেরকম। বি এস থাপার নাটকের রিহার্সাল যেখানে হবে সেই বিল্ডিংয়ের তিনতলায় সারাক্ষণ বেশ ধোপদুরস্ত মানুষজনের যাতায়াত। অফিসটি গীতা বালির। তাঁর একটা ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি আছে। সেটারই অফিস। যতীন্দর নাটক করে কেন? কারণ, তার মনে একটি গোপন বাসনা হল একদিন সে সিনেমায় অ্যাক্টিং করবে। হিরো হবে। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে রিহার্সাল রুমে ওঠার মুখেই আচমকা সামনে গীতা বালি। হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াই নিয়ম। কিন্তু গীতা বালি তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করছেন। নামজাদা অভিনেত্রী। বহু হিন্দি ছবির হিরোইন। সেই মহিলা এভাবে তাকিয়ে কেন? যতীন্দর একটু অস্বস্তিতে। গীতা বালি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি অ্যাক্টর?’ যতীন্দর বলল, ‘হ্যাঁ, মানে একটা নাটকের গ্রুপে..।’ কথা শেষ করতে না দিয়েই গীতা বালি বলে ফেললেন, ‘শোনো আমরা একটা পাঞ্জাবি ফিল্ম করব। একটা নিউ ফেস চাই হিরোর রোলে। তোমার কিছু ছবি দিয়ে যেও তো আমার অফিসে। আমাদের প্রোডাকশনের পছন্দ হলে তোমাকে ডাকা হবে স্ক্রিন টেস্টে।’ যতীন্দরের পা যেন সিঁড়িতে আটকে গেল। এই অভাবনীয় সুযোগ এভাবে হেঁটে হেঁটে তার কাছে এল, এটা ভাবাই যায় না। তা হলে স্বপ্ন সত্যিই হতে চলেছে? পরদিন সকালেই নিজের সবথেকে ভালো ভালো ছবি নিয়ে সোজা গীতা বালির অফিসে গিয়ে দিয়ে এল যতীন্দর। দিন যায়। মাস যায়। যতীন্দর অপেক্ষা করে কবে ফোন আসবে। সে নিয়ম করে বি এস থাপার সেই নাটকের গ্রুপে রিহার্সাল করছে। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, আর একবারও দেখা হল না গীতা বালির সঙ্গে। অফিসে গিয়ে খোঁজ নেওয়াই যায় না। কারণ, উনিই বলেছেন খবর দেবেন। কিন্তু খবর এল না। উল্টে এল খবরের কাগজের একটি নিউজ। গীতা বালি একটি পাঞ্জাবি ফিল্ম করছেন। তার বিবরণ। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেখানে নিজের নাম পেল না যতীন্দর। বরং নায়কের ভূমিকায় অন্য একজনের নাম দেওয়া হয়েছে। সেই নামটিও পাঞ্জাবি। ধর্মেন্দ্র!
তাকে সিনেমায় নেওয়া হল না। অথচ একটা ইনভাইটেশন কার্ড পাঠানো হল। সেখানে বলা হয়েছে ‘সিনেমার মহরৎ পার্টি হবে। আপনি আমন্ত্রিত।’ যতীন্দর ভাবছে যাবে কি না। কী হবে গিয়ে? চান্সই দিল না। আর এখন পার্টিতে ডেকে ভালোমন্দ খাওয়াবে। কিন্তু তবু কিছু একটা মনের তাড়না যতীন্দরকে যেন বলল, যেতে। গীতা বালির বাড়িতেই পার্টি। বাড়ির নাম ব্লু হেভেন। সংকোচ নিয়ে হাতে ইনভাইটেশন কার্ড দেখিয়ে ঢোকা গেল। কিন্তু একি! এ তো স্টারের ছড়াছড়ি। শাম্মি কাপুর, সুনীল দত্ত, রাজ কাপুর, সায়রা বানু, দেব সাব, জে ওমপ্রকাশ, দাদা বর্মণ (শচীন দেব বর্মণ), গুরু দত্ত... কে নেই। এখানে যতীন্দর বড় বেমানান। কেউ চেনে না। কেউ তাকে স্বাগতও জানায়নি। একা একা ঢুকে একটা জুসের গ্লাস নিয়ে যতীন্দর নিঃশব্দে লনের এক প্রান্তে চলে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আমি কেন এলাম! দ্রুত গ্লাস শেষ করে যতীন্দর চলে যাবে বলে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছে। তখনই দেখল হাসিমুখে গীতা বালি এগিয়ে আসছেন। বললেন, ‘লোনলি লাগছে তো? বিরক্ত হয়েছ? আকাশ দেখতে পাচ্ছো। অনেক গ্রহ তারা নক্ষত্র। একদিন ওরকমই তারকাদের ভিড়ে তোমারও স্থান হবে। অপেক্ষা করো।’ যতীন্দরের চোখ জলে ভরে এল। গীতা বালি বললেন, ‘উঁহু, চোখের জল নয়। কান্না দিয়ে কিছু হয় না। স্ট্রাগল আসল কথা। কান্নাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। মানুষের মনের জোরকে দুর্বল করে দেয় কান্না।’ যতীন্দর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে কিংবা গীতা বালি তখনও জানেন না যে, ওই ছোট্ট বাক্যটি আগামীদিনের ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে একদিন। যতীন্দরের হাত ধরে। রূপালি পর্দায় বাক্যটির নবজন্ম হয়ে কোটি কোটি মানুষের অন্তরের ধ্রুবপদ হবে ঠিক এ রকমই একটি ইমোশনাল স্টেটমেস্ট- ‘পুষ্পা..আই হেট টিয়ারস...!’
* * *
রবি শর্মার বাড়িতে গুরু দত্ত এসেছেন। প্রায় মধ্যরাত। এত রাতে কী ব্যাপার? রবি শর্মা চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। গুরু দত্ত বললেন, ‘রবি আমি একটা গান চাই। একটি মানুষ অনেক রাত পর্যন্ত মুশায়রার আসর থেকে বাড়ি ফিরেছে। তার সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী। সেই মেয়েটি স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে করে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বামী ভদ্রলোক বাড়ি ফিরে দেখছেন স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পূর্ণচন্দ্রের আলো সোজা এসে পড়েছে মেয়েটির মুখের উপর। সেই মুখও যেন একটি চাঁদের মতোই উজ্জ্বল। এরকম সিচুয়েশনে গান তৈরি করো।’ রবি শর্মা বললেন, ‘তাহলে শাকিলজিকে ডেকে নেওয়া যাক। ওই রাতেই লোক পাঠিয়ে শাকিল বদায়ুনিকে ডাকা হল। তিনি লিখবেন গানের কথা।’ গুরু দত্ত বললেন, ‘ঠিক আছে আপনারা আলোচনা করে নিন। কাল কথা হবে।’ বেরিয়ে গেলেন তিনি। শাকিল বদায়ুনি এসেই সিচুয়েশন শুনেই পেন আর ডায়েরি নিয়ে চোখটা বন্ধ করলেন। কয়েকমিনিট। লিখে ফেললেন প্রথম লাইন। রবি শর্মা সঙ্গীত পরিচালক। তিনি দেখলেন, শাকিল ভাই অসম্ভব সুন্দর লাইন লিখেছেন। ‘চৌধবী কা চাঁদ হো, ইয়া আফতাব হো, যো ভি হো তুম খুদা কি কসম, লা জওয়াব হো...।’ রবি শর্মা এক মিনিটও দেরি করলেন না। তৎক্ষণাৎ হারমোনিয়াম বের করে সুর ভাঁজলেন। শাকিল বদায়ুনি লিখছেন। রবি শর্মা সুর করছেন। মাত্র আধ ঘণ্টা। ওই মধ্যরাতে গান রেডি। আর বিলম্ব সহ্য হল না। ওই রাতেই গুরু দত্তকে ফোন করলেন রবি শর্মা। বললেন, ‘গান রেডি।’ গুরু দত্ত বললেন, ‘এখনই আমার অফিসে চলে এসো।’ সেই রাতেই গুরু দত্তের অফিসে গিয়ে তাঁকে গান শোনানো হল। গুরু দত্ত কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। তার পর বললেন, ‘রফি সাব কি ডেট লে লো!’ তখনও পর্যন্ত আলোচনা হয়নি যে এই ছবির গান কে গাইবেন। কিন্তু মহম্মদ রফির কণ্ঠমাধুর্য আর গ্রহণযোগ্যতা এমনই এক পর্যায়ে ছিল যে, কাউকে ভাবতে হতো না যে কে গাইবেন এ রকম গান। কিন্তু কে জানত পরবর্তী প্রজন্ম এক অন্য ঈশ্বরকে মনেপ্রাণে বন্দনার আসনে বসানোর জন্য অলক্ষ্যে যেন তৈরি হচ্ছিল। তার আভাস সঙ্গীত পরিচালক রবি শর্মা পেলেন ‘এক মহল হো সপনো কা’ ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময়ে। প্রযোজক দেবেন্দ্র গোয়েল রবি শর্মাকে বললেন, ‘রবিজি একটা প্রবলেম হয়েছে। আমার বাড়ির ছেলেমেয়েরা চাপ দিচ্ছে যে গানগুলো রফি সাবের বদলে কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়াতে হবে। সবাই মিলে ধরেছে। কী করি বলুন তো?’ রবি শর্মা বললেন, ‘কিন্তু দেবেন্দ্রজি ধর্মেন্দ্রর লিপে রফি সাব যতটা মানায়, ততটা কি কিশোরকে ভালো লাগবে! আমার সন্দেহ আছে।’ দেবেন্দ্রজি বললেন, ‘বাচ্চারা সব চাপ দিচ্ছে। ফ্যামিলি প্রোডাকশন হাউস, বোঝোই তো।’ রবি শর্মা একটি গান কিশোর কুমারকে দিয়েই রেকর্ডিং করালেন। কিন্তু শুটিংয়ের এক মাস পর দেবেন্দ্রজি বললেন, ‘রবিজি আপনি ঠিক বলেছিলেন। ধর্মেন্দ্র আর শর্মিলা ঠাকুর কল্পনায় রোমান্স করছেন। কিন্তু এই গানে সেই মেজাজটা আসছে না।’ অতএব আবার সেই মহম্মদ রফিকে দিয়ে রেকর্ডিং করিয়ে সেই গানই রাখা হল সিনেমায়। গোটা ব্যাপারটা জানতে পেরেও চুপ রইলেন সেই প্রথম গায়ক। যাঁর গান বাদ গেল। তিনি এই কষ্টের কথাটা একজনকে বলেছিলেন শুধু। যে ভদ্রলোক বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে সব থেকে বেশি স্নেহ করেন। বর্মণ দাদা। শচীন দেব বর্মণ বলেছিলেন, ‘এ সব এই লাইনে হয়ই কিশোর। তুই তো জানিস। দুঃখ পাস না। এটা ফিল্ম জগতে হতেই পারে।’ কিন্তু এরকম ঘটনা আগেও হয়েছে কিশোরের সঙ্গে। তাই তিনি ভাবছেন আমার কণ্ঠ কি এতটাই খারাপ যে কোনও ক্লাসিক্যাল বেসড গানে সিরিয়াস সঙ্গীত পরিচালক আমাকে চান্স দেয় না?
এ দিকে তখন সেই গিরগাঁও-এর যুবক যতীন্দর খান্না আকস্মিক বড়সড় ধাক্কার সামনে। সে যত ফিল্ম কোম্পানিতেই পাগলের মতো নিজের ফোটো দিয়ে আসছে, কেউই আর ডাকে না। কিন্তু ধাক্কাটা লাগল যখন একদিন সেই স্কুলের বন্ধু রবি কাপুর গে লর্ড কাফে শপে এসে আনন্দে জড়িয়ে ধরল যতীন্দরকে। কারণ কী? কারণ হল, রবি অবশেষে একটা খুব ভালো ব্যানারের সিনেমায় চান্স পেয়েছে। তাও আবার আজেবাজে সিনেমা নয়। ভি শান্তারামের পরিচালনা। ছবির নাম ‘গীত গায়া পত্থরো নে’। ১৯৬৪। সেই ছেলেবেলা থেকে দু’জনে একসঙ্গে স্বপ্ন দেখেছে। তাই যতীন্দরের তো খুশি হওয়ারই কথা। সে খুশিও হচ্ছে। আবার কষ্টও পাচ্ছে। কারণ রবি নিজের নাম পাল্টে যে নামটি সিনেমা জগতের জন্য নিয়ে ফেলেছে, সেই নামটি যতীন্দরের খুব পছন্দ ছিল। সিনেমায় চান্স পেলে তার নিজেরই নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। দু’জনে এটা নিয়ে বহু কথাও বলেছে। কিন্তু রবি আগে ভালো চান্স পেয়েছে। তাই সে নিতেই পারে সেই নাম। সেই নাম নিয়ে রবি কাপুর ওই সুপারহিট সিনেমার নায়ক হয়ে গেল। রবি কাপুরের নতুন নাম হল জিতেন্দ্র!
যে যুবককে বরাবরই নাটকের জগতে প্রচণ্ড প্রতিভাবান বলে মনে হয়েছে যতীন্দরের, সেই ছেলেটিও হঠাৎ খুব নাম করে ফেলছে। আইপিটিএ’তে যোগ দিয়েছিল। এই তো কয়েক বছর আগে একটা ছোট রোলে সিনেমাও করেছে। ছেলেটি দারুণ অভিনয় করে থিয়েটার জগতে। যতীন্দর শুনল সেই হরি জরিওয়ালাও নাকি একটা সিনেমায় নায়কের রোল পাচ্ছে। সই করা হয়ে গিয়েছে। ছবির নাম ‘নিশান’। হরি জরিওয়ালাও ব্রেক পেয়ে নিজের নাম চেঞ্জ করলেন। তাঁর নতুন নাম হল সঞ্জীব কুমার।
* * *
কিন্তু যতীন্দরকে কেউ চান্স দিচ্ছে না। এবার আর চুণীলাল কোনও কথাই শুনবেন না। যতীন্দরকে বিজনেসে ঢুকতেই হবে। যতীন্দরের সামনে শেষ সুযোগ। ফিল্মফেয়ার কোম্পানি একটি ট্যালেন্ট হান্ট আয়োজন করছে। সেখানে অংশ নিয়ে শেষ চেষ্টা করবে যতীন্দর। দেখা যাক কী হয়। এই ট্যালেন্ট হান্টের লক্ষ্য হল নতুন মুখের সন্ধান। ১০ হাজার প্রতিযোগী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আর ওই ট্যালেন্ট প্রতিযোগিতার রেজাল্ট যখন প্রকাশিত হল সেই মুহূর্তটাই ছিল ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নতুন ইতিহাস রচনার প্রথম পরিচ্ছদ। প্রথম স্থানাধিকারী যতীন্দর খান্না। চুক্তিই ছিল যে এই ফিল্মফেয়ার প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে, তাকে একাধিক সিনেমায় স্বাক্ষর করানো হবে। সেই মতো শূন্য হাতের যতীন্দরের কাছে এক ধাক্কায় এসে গেল একের পর এক সিনেমায় স্বাক্ষর করার সুযোগ। ‘আখরি রাত’। ‘আওরত’। ‘ডোলি’। ‘ইত্তেফাক’। যতীন্দর খান্না নাম পাল্টে ফেললেন। একটি নতুন যুবক পা রাখলেন ফিল্ম জগতে। রাজেশ খান্না।
শক্তি সামন্তকে চিত্রনাট্যকার শচীন ভৌমিক একটি কাহিনী শোনালেন। এক নারীর সংগ্রাম। বন্দনা নামক নারীটি ভালোবেসেছে এয়ারফোর্স অফিসার অরুণ ভার্মাকে। গোপনে বিয়েও করলেন তাঁরা। কিন্তু সামাজিক ভাবে বিবাহ হওয়ার আগেই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার অরুণ ভার্মার মৃত্যু হল প্লেন দুর্ঘটনায়। বন্দনাকে সমাজ, পরিবার গ্রহণ করল না। সেই শুরু তাঁর লড়াইয়ের। কাহিনী নতুন নয়। ১৯৪৬ সালের ইংরাজি ফিল্ম ‘টু ইচ হিজ ওন’ অবলম্বনে চিত্রনাট্য। শক্তি সামন্তের ভালোই লাগল। শুরু হল প্রস্তুতি। আচমকা প্রযোজক সুরিন্দর কাপুর বললেন, ‘আমার এক শ্রীমান এক শ্রীমতি সিনেমার সমাপ্তিটাও এরকমই।’ শুনে চমকে গেলেন শক্তি সামন্ত। বললেন, ‘তা হলে আমি সিনেমাটাই করব না।’ ঠিক এই সময় লেখক গুলশন নন্দা বললেন, ‘আমরা তো সেকেন্ড হাফটা চেঞ্জ করে দিতে পারি। এয়ারফোর্স অফিসারের ছেলেকে নিয়ে এসে ডাবল রোল করে দিই।’ প্রস্তাব পছন্দ হল। দেব আনন্দকে বলা যাক? কিন্তু শক্তি সামন্ত চাইলেন নতুন কোনও মুখ। সিনেমাটা শর্মিলা ঠাকুরকে কেন্দ্র করে। দেব সাব রাজি নাও হতে পারেন। নারীকেন্দ্রিক ছবি। তা হলে? রাজেশ খান্নাকে নেওয়া হোক। শচীন দেব বর্মণ প্রথমেই দু’টি গানের রেকর্ডিং করে নিলেন। ‘বাগো মে বাহার হ্যায়।’ লতা মঙ্গেশকর এবং মহম্মদ রফি। দ্বিতীয় গান আশা ভোঁসলের সঙ্গে। ‘গুন গুনা রহে হ্যায় ভমর’। সব ঠিকভাবেই এগোচ্ছে। কিন্তু আচমকা দুঃসংবাদ। শচীন দেব বর্মণ অসুস্থ। এমনকী হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তিনি শক্তি সামন্তকে বললেন, ‘আমি পঞ্চমকে বুঝিয়ে দিয়েছি। বাকি গানগুলো ও রেকর্ডিং করে নেবে।’ পঞ্চম বাকি গানগুলির রেকর্ডিং করালেন। সিনেমা যখন রিলিজ হল দেখা গেল মহম্মদ রফির গাওয়া ওই দুটি গানকে অনেক পিছনে ফেলে গোটা দেশকে আলোড়িত করে ফেলেছে অন্য গায়কের গানগুলি। কিশোর কুমার। ‘রূপ তেরা মস্তানা’, ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ এবং ‘মেরে সপনো কি রানি কব আয়েগি তু’। ভারত বস্তুত ভেসে গেল দু’টি দখিনা বাতাসের জুটিতে। কিশোর কুমার এবং রাজেশ খান্না। তবে চরম জল্পনা, মতান্তর এবং পারস্পরিক দোষারোপের পর্বও শুরু হল। একটি মহল থেকে বলা হল রফি সাবকে দিয়েই সব গান গাওয়ানোর কথা ছিল শচীন দেব বর্মণের। তিনি রফিকে ডেকে মহড়াও করিয়েছেন। পঞ্চম অর্থাৎ রাহুল দেব বর্মণই এসে প্ল্যান পাল্টে বাকি গানগুলি কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন। আবার অন্য মহলের বক্তব্য, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল। দুটি গান রেকর্ডিং করার পর শচীন দেব বর্মণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রফি সাব বিদেশে কনসার্ট করতে চলে যান। সেই সময়ই কিশোর কুমারকে দিয়ে বাকি গানগুলো রেকর্ড করান রাহুল। সেটা রফিকে জানিয়েই হয়েছিল। কোন তত্ত্ব সত্যি সেটা আজও রহস্যময়।
এসব তো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের গসিপ। আমজনতার তাতে কী এসে যায়? আট থেকে আশি গোটা ভারতবর্ষ ভেসে গেল অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের পেপারব্যাক ‘হোয়েন এইট বেলস টোল’ পড়তে পড়তে যাওয়া দার্জিলিঙের টয় ট্রেনের জানালায় শর্মিলা ঠাকুরের গালের টোলে। জনতা আপ্লুত হল, সেই জানালার বাইরে এক চিরবসন্তের রোমান্সের আবেশ ‘মেরে সপনো কি রানি কব আয়েগি তু’র সুরে। ভারতীয় নারীদের স্বপ্নে হাজির হতে শুরু করল এক ভুবন ভোলানো হাসির রোমান্টিক যুবক। ভারতের ঘরে ঘরে, রাস্তায় রাস্তায়, বিবিধ ভারতী আর বিনাকা গীতমালারা ছড়িয়ে দিল এক উদাত্ত পুরুষ কণ্ঠে ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’র আগের অত্যাশ্চার্য এক প্রিল্যুড-হে হে.....। ভারত শিহরিত হল সাড়ে তিন মিনিটে একটা টেকেই শুট করা ‘রূপ তেরা মস্তানা’র অলৌকিক এক যৌন আবেদনে। ‘আরাধনা’ সুপারহিট হল!
১৯৬৯। প্রথম চাঁদে গিয়েছিল মানুষ। ভারতের বিনোদন মহাকাশেও আবির্ভাব হয়েছিল দুই মহাতারকার। সেই প্রথম জন্ম হয়েছিল একটি নতুন শব্দের। সুপারস্টার। দুই আইকনের আত্মপ্রকাশ। রাজেশ খান্না ও কিশোর কুমার।
...........................................
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়