পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
সত্যিই তো! ধান গাছ লতানে হয় না। এই হল কল্পজগতের বাস্তব প্রকাশ। নিরবচ্ছিন্ন সম্পদ তথা শস্যের আগমনির আশায় এই চিত্রকল্প। কী করে বোঝাবে ওইটুকু মেয়েকে? সেই সময়েই ‘ঠাকুর মশাই এসেছে’... ‘ঠাকুর মশাই এসেছে’ বলে ছুট্টে ঘরে ঢুকল ছ’বছরের হৈ। হৈ আর চৈ সকাল থেকেই দিদুনের বাড়িতে। বাবা-মা-পিসুন-পিসাই-মাম্পিদাদা আরও সব। সকাল থেকেই লক্ষ্মীপুজো। নারকোল নাড়ুর গন্ধ... একটা-দুটো গরম নাড়ু দিদুনের থেকে পাওয়া। ভোগের গন্ধ। ফল কাটার গন্ধ। লক্ষ্মীপুজোর একটা আলাদা গন্ধ পাড়ায় পাড়ায়, বাতাসে বাতাসে। এই পুজো খুব কাছের। ঘরের। নিজেদের হাতেই সাজিয়ে তোলা সব আয়োজন। শঙ্খ বেজে ওঠে, উলুধ্বনি শোনা যায় সেই বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে পুরোহিত ঢুকেছে। অন্য বাড়ি তখন প্রতীক্ষায় চুপ। ঘোতনের মোবাইল বেজে ওঠে, ‘যাচ্ছি কাকিমা যাচ্ছি, বারোটা পয্যন্ত লগ্ন আছে তো...!’
ঘোতন জিনস আর টিশার্ট ছেড়ে আজ পুরোহিত। ধুতি আর ফতুয়া পরে বাইকে বসেছে। এক গাল হাসি... ‘সবই মা লক্ষ্মীর দান, কাকা!’ হৈ পাশেই ছিল। চিৎকার করে উঠল, ‘আউল আউল বাহন, পেঁচা পেঁচা, না পিসাই?’ হৈ বিকেলবেলা পাড়ার ফাঁকা মণ্ডপে একা লক্ষ্মী ঠাকুরকে কাছ থেকে দেখে এসেছে পিসাইয়ের সঙ্গে। আউলের গায়ে হাত দিয়েছে ভয়ে ভয়ে। ও আউল থেকে পেঁচা জেনেছে, পেঁচা থেকে আউল জানেনি! কিন্তু পেঁচা বা আউল অত কাছ থেকে দেখে, আঙুল ঠেকিয়েও ওর বিহ্বলতা কাটেনি। নানা প্রশ্নে পিসাই নাজেহাল! পেঁচা কেন নিল? লক্ষ্মী তো আরও ভালো কিছু নিতে পারত!
লক্ষ্মী কি পেঁচা সেধে নিয়েছে! ওঁর তো শুধু একা নয়, ফুল ফ্যামিলিতেই বাহন নিয়ে নানা সমস্যা যুগের পর যুগ ধরে চলেছে। মা লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা ফাইনালি সেট্ল হয়েছে আধুনিককালে। তার সামাজিক ও ভাবগত নানা কারণ আছে। বাহন হওয়ার যুক্তিগুলি সবই নির্ভর করে আছে পেঁচার গুণগত বৈশিষ্ট্যের উপর। সেক্ষেত্রে মা লক্ষ্মীর পছন্দ হয়েছিল কি না জানা যায় না। তবে ভক্তের পছন্দ মানেই জনগণের পছন্দ। তাই মেনে ও মানিয়ে নিতেই হয়েছে। পেঁচাকে কেন দেওয়া হল লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে? পেঁচা রাতে দেখতে পায়। আর রাতেই শস্য ও সম্পদের পাহারায় থাকা জরুরি। সুতরাং রাতের প্রহরী পেঁচা। তার ঘাড় সবদিকে ঘোরে। এমনকী স্থির বসে থেকে পেছন দিকেও ঘাড় ঘোরাতে পারে সে। সর্বদিকে তার নজর দেওয়া সুবিধা। সামান্য শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিতে পারে, কোনও ইঁদুর গোলাভরা শস্য তথা সম্পদ নষ্ট করছে কি না। তীক্ষ্ণ তার নখ ও চঞ্চু, যা আক্রমণে ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে পারে শত্রুকে। দিনে মানুষ যখন জেগে থাকে, তখন পেঁচা বিশ্রাম নেয়। রাতে সে বেড়িয়ে পড়ে পাহারায়। মা লক্ষ্মী যে সম্পদ সবার অজ্ঞাতে রাত্রিবেলা দিয়ে আসেন গৃহস্থের ঘরে ঘরে, তা রক্ষার দায়িত্ব পেঁচার।
অবশ্য হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও পেঁচাকে লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে বসতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন পুরাণে লক্ষ্মী দেবীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা থাকলেও পেঁচা সম্পর্কে আশ্চর্য নীরব থেকেছেন পুরাণকারেরা। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত চণ্ডী অনুসারে দেবগণের যে বাহন, তাঁদের শক্তিরুপিণী দেবীগণেরও সেই বাহন। বিষ্ণুর বাহন গরুড়, অতএব লক্ষ্মী দেবীর বাহনও গরুড় হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কারও কারও মতে, গরুড়ের স্ত্রীরূপ কল্পনা করা পেয়েছে কোনও ‘গোষ্ঠী-প্রতীক’ এই পেচক বা পেঁচার মধ্যে। তাই পেঁচা ঠাঁই পেয়েছে লক্ষ্মীর চরণে।
কিন্তু লক্ষ্মীর প্রথম পছন্দ ছিল সিংহ। বেশ খুশিই ছিলেন এই সিংহ বাহন নিয়ে। ধারেকাছে কেউ আসবে না সিংহের ভয়ে। সেফ ড্রাইভ। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কার স্বর্ণমুদ্রায় লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে সিংহকেই দেখা যায়। আবার সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বের প্রথমদিকে সিংহবাহিনী মা লক্ষ্মীকে দেখা যায়। আর্যরা এসে পৌঁছনোর আগে নিরাকার প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে প্রতীক হিসেবে পূজাই গোষ্ঠীগুলিতে প্রচলিত ছিল। দেবদেবীর মূর্তি কল্পনা তখন আকার পায়নি। গোষ্ঠী-প্রতীক ধীরে ধীরে মূর্তির অঙ্গ হিসেবে পূজিত হওয়ার বিবর্তনের কথাই বিভিন্ন পুরাণ বা শাস্ত্রে কথিত হয়ে চলেছে। যদি সিংহ নিয়েই আলোচনা হয়, দেখা যাবে সিংহ এদেশেরই নয়। রোমিলা থাপার, বাল্মিকী থাপার ও ইউসুফ আনসারির লেখা, Exotic Aliens: The Lion & the Cheetah in India বইতে রোমিলা থাপার বলছেন, সিংহ আদৌ ভারতবর্ষের নয়; সিংহ আনা হয়েছিল পশ্চিম এশিয়া, ইরান এই অঞ্চল থেকে।
সিন্ধু সভ্যতায় সিংহের দেখা পাওয়া যায়নি। দেবী দুর্গা ছিলেন মহিষমর্দিনী। ভারতে দুর্গার বাহন হিসেবে বাঘের দেখা মিলেছিল প্রাচীন ভাস্কর্যে। শ্রীশ্রী চণ্ডীর ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, দেবতাদের সম্মিলিত তেজঃপুঞ্জ থেকে দেবী দুর্গার উদ্ভব। তারপর বিভিন্ন দেবতা একে একে দিলেন বিভিন্ন সাজপোশাক, অস্ত্র-শস্ত্র। আর হিমালয় দিলেন ‘বাহনকেশরী’, ‘ধূতসট’, মানে সিংহ। কিন্তু হিমাচল প্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীরে দুর্গার বাহন সিংহ নয়, বাঘ। এইসব গোলকধাঁধায় না ঢুকে সমাজবিদদের একটা মতের উল্লেখ করা যায়। তা হল, সিংহ ছিল আর্যদের কোনও এক গোষ্ঠীর ‘টোটেম’। তাই তার রং ফর্সা। আর মহিষ তথা মহিষাসুর হল অনার্যদের গোষ্ঠী-প্রতীক। পুরাণের কথা যেহেতু শুরু হয়েছে ষষ্ঠ শতকে, তাই তখন থেকেই এই দুই খাদ্য-খাদকের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মূর্তির মাধ্যমে। পূজ্য। সংরক্ষণীয়।
সমুদ্রগুপ্তের জমানার শেষদিকে কিছু কিছু মুদ্রায় দেখা গেল ময়ূরকে বাহন করে আবির্ভূতা মা লক্ষ্মী। কুমারগুপ্তের সময়ের মুদ্রায় দেখা যায়, লক্ষ্মীদেবী একটি ময়ূরকে খাওয়াচ্ছেন। এই লক্ষ্মীমূর্তি আজও দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় পুজো হয়। পরবর্তীকালে ময়ূর চলে গেল পেখম নাচিয়ে কার্তিকের সঙ্গে। দেখা গেল, লক্ষ্মী তখন হাঁস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সপ্তম শতাব্দী অর্থাৎ যখন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক... সেই সময়কার মুদ্রায় দেখা গিয়েছে লক্ষ্মীর এই হাঁস বাহনকে। সেই মুদ্রায় দেখা যায়—মা লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছেন, ডান হাতে পদ্ম। পদ্মলতা ছড়িয়ে আছে পশ্চাতপটে, আর পায়ের কাছে শ্বেতশুভ্র হংস বা সাদা হাঁস। পরবর্তী কালে হাঁস চলে গেল বোন সরস্বতীর কাছে। প্রথমে কিন্তু জ্ঞান ও সম্পদের দেবী আলাদাভাবে পূজিত হতেন না! একসঙ্গেই হতো তাঁদের আরাধনা। পরে আলাদা হল। তখন বোন সরস্বতীর বায়নায় লক্ষ্মী মায়া ত্যাগ করলেন হাঁসের। মা দুর্গার কাছে সিংহের যাত্রা তো এই সেদিনের কথা! ভাই কার্তিকের কাছে চলে গেল ময়ূর। সেও তো নানা গণ্ডগোল।
পশ্চিম ভারতে বিশেষ করে বোম্বাই অঞ্চলে সরস্বতী আবার ময়ূরবাহিনী। পুরাতত্ত্ববিদ জেনারেল কানিংহাম বলেন, সরস্বতী নদীর তীরে ময়ূরের প্রাচুর্যের কারণে দেবী সরস্বতীর বাহন ময়ূর কল্পনা করা হয়েছে। আবার কোনও কোনও সমাজবিদ বলেন, প্রাচীন ভারতবর্ষের মৌর্য বংশের রাজত্বের সময়কালে উত্তর-পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা সংলগ্ন অঞ্চলে ‘যৌধেয়’ নামে এক কার্তিক উপাসক গোষ্ঠী বসবাস করত। যাদের গোষ্ঠী-প্রতীক ছিল ময়ূর। সে হিসেবে ময়ূর কালক্রমে দুই বোন লক্ষ্মী আর সরস্বতীর হাত ঘুরে চলে এসেছে শেষ পর্যন্ত যোদ্ধা কার্তিকের কাছে। শুধু কি ময়ূর! শ্রী শ্রী চণ্ডীর বিখ্যাত টীকাকার গোপাল ভট্ট বলছেন, ‘কুক্কুটোহপি কার্ত্তিকেয়স্য বাহনম্’। তাহলে কুক্কুট অর্থাৎ মোরগও কোথাও না কোথাও কার্তিকের বাহন ছিল। বঙ্গদেশে তথা গৌড়বঙ্গে ছিল না ময়ূর। ছিল কুক্কুট, মানে মোরগ। তাই কি শাস্ত্রকারেরা মোরগকে ময়ূরের পরিবর্ত হিসেবে দেখার বিধান দিয়েছেন! মহাভারতে আছে অগ্নিদেব কুমারকে দিয়েছিলেন কুক্কুট; আবার মৎস্যপুরাণে আছে, বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন কুক্কুট। যদিও স্বভাবে মোরগ ও ময়ূরের সাদৃশ্য দেখিয়েছেন পণ্ডিতেরা—যুদ্ধ, প্রাতরুত্থান, ভোজন ও স্ত্রীরক্ষা। এই স্বভাব এবং সৌন্দর্য কার্তিকের সঙ্গেই মানানসই। সিংহ, হাঁস, পেঁচা, ময়ূর নিয়ে ভাইবোনেদের টানাটানির মধ্যে গণেশ কিন্তু নিজের বাহন নিয়ে কোনওদিনই কোনও ওজর আপত্তি তোলেননি। গণেশ পূজায়—‘মোক্ষার্থী লভতে গতিম্’ সবার জানা। জ্ঞান মোক্ষ লাভ করলে অষ্টপাশ ছিন্ন করে অগ্রসর হওয়ার কল্পরূপে প্রকাশ পায়। ঘৃণা, অপমান, লজ্জা, মান, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ, বৈগুণ্য—অষ্টপাশ। এই ফাঁস কেটে মানুষকে মোক্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাহন হল মূষিক। সবার অলক্ষ্যে ক্ষুদ্র এই প্রাণী কুট কুট করে একটি একটি ফাঁস, তথা সংসারের মায়াজাল কেটে সিদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। কুমেরু ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইঁদুরের অস্তিত্ব। ইঁদুরকে আসলে অনার্যকৃষ্টি, কৃষিকৃষ্টি, রাত্রির প্রতীক রূপে ব্যাখ্যা করা হয়। আবার হাতির সঙ্গে ইঁদুরের সম্পর্ক বেশ গভীর। পৃথিবী গণেশকে মূষিক উপহার দিয়েছিলেন—‘পৃথ্বী মূষিকবাহনম্’ (বৃহদ্ধর্মপুরাণ)। তবে মূষিক বা ইঁদুর নিয়ে টানাটানি খুব একটা হয়নি।
আর এক বাহন নিয়েও খুব একটা সমস্যা হয়নি... তা হল, শিবের বাহন বৃষভ। মহাভারতের সেই উপাখ্যান... দক্ষ-প্রজাপতি ক্ষিপ্ত রুদ্র তথা শিবকে দান করেছিলেন গাভী সহ বৃষ। শিব বৃষভকে বাহন রূপে গ্রহণ করে ঘুরে বেড়ালেন। বৈদিকে যিনি রুদ্র, পুরাণে তিনিই শিব। ঋগ্বেদে রুদ্রকে বলা হয়েছে ‘বৃষভ’, সেই ‘বৃষভ’ পুরাণে হয়েছে শিবের বাহন। ‘বৃষভ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, বলবান ও শুক্রল। অসীম শক্তিধর শিবের যথোপযুক্ত বাহন... যাঁর শক্তিময় কর্ষণে পৃথিবী শস্যবতী হয়ে ওঠে।
আসলে দুর্গা পরিবারের এই বাহন-সমস্যাটা খুব প্রাচীন নয়। সব গণ্ডগোল চতুর্থ শতাব্দী থেকে সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত। এখন মা দুর্গা পূজিত হচ্ছেন নানা পশুপাখির সমাহারে—সিংহ, মহিষ, ময়ূর, পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, আর আছে সাপ। একদম প্রাথমিক পর্যায়ে মা কিন্তু একাই আসতেন। সমষ্টিগত এই পুজোয় একটা সম্পূর্ণ ইকো-সিস্টেম মাতৃ আরাধনার মধ্য দিয়ে মানুষের সামনে হাজির করার এক চিরন্তন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ হয় পুরাণকালে। দেব-দেবী পুজোর মধ্য দিয়ে তাঁদের বাহনকেও পূজ্য করে তোলা, রক্ষা করার ব্রত পালন। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য এত সুন্দর ও সহজ করে সেই সময়কার শাস্ত্রকারেররা বিষয়টি ভেবেছেন যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবলে অবাক হতে হয়। পূজার ছলেই রক্ষার নিয়ম। সংরক্ষণের বীজ বপন হয়েছিল তখনই। আসলে দেবী দুর্গা যেভাবে, যে যে উপাচারে পূজিত হন, তার প্রতিটি পর্যায়ে আছে প্রকৃতির প্রতীক। যা চলে এসেছে সেই গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সময়কাল থেকে। এক এক গোষ্ঠীর প্রতীক এক একটি পশু বা পাখি। যা হয়তো ওই গোষ্ঠীর এলাকায় বেশি ছিল। কিন্তু খাওয়া বা স্রেফ আনন্দের তাগিদে মেরে ফেলার জন্য হয় সংখ্যায় কমে যাচ্ছিল, কিংবা বিলুপ্ত হতে বসেছিল। তাই সেই পশু-পক্ষী তথা জীবকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হল পুরাণকালে। এক এক গোষ্ঠীর প্রতীক আলাদা আলাদা। সুতরাং দেব-দেবীর এই বাহন কল্পনা আসলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর টোটেমকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই স্বীকৃতি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল প্রাণীগুলিকে প্রণাম ও ভক্তির মধ্য দিয়ে বাঁচানো এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা। এই যে দুর্গামণ্ডপে নবপত্রিকা পুজো... গণেশ ঠাকুরের পাশে লালপাড় শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় লজ্জাবনত। নবপত্রিকা পুজোর মধ্য দিয়ে উদ্ভিজ্জ প্রকৃতিকে রক্ষা করা তথা পূজার বার্তা। নবপত্রিকায় থাকে কলা, কাঁচা হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান, কচু, এবং ধান। একটি কলাগাছকে স্নান করিয়ে একজোড়া বেল সাদা অপরাজিত লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে রাখা হয় এবং পুজো করা হয়। পুজো করা হয় আসলে উদ্ভিদ সম্পদকে। প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষা করার এবং তার ভারসাম্য রক্ষা করার এক সুন্দর উপায় এই পূজা পদ্ধতি। সুন্দর এক সামাজিক মেলবন্ধন উৎসবের মোড়কে ছড়িয়ে দিয়েছে ‘ইকো সিস্টেম’-এর এক মহান ব্রতকথা। সংরক্ষণের ব্রতপালন। কত কত বছর আগে আজকের ভয়ঙ্কর পৃথিবীর অবস্থার কথা কি ভেবেছিলেন তাঁরা! নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা ফুটোফাটা ফুসফুসে বিষাক্ত বায়ু নিয়ে শুকনো জমির নীচে শেষ হয়ে যাওয়া জলের দিকে তৃষ্ণার্ত তাকিয়ে আছি। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আজ পৃথিবীর বুকে। সংরক্ষণ দরকার এই পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের। চারিদিকে হাহাকার। আর কোজাগরী পূর্ণিমার ছড়িয়ে পড়া দুধেল চাদরের জোৎস্নায় সারারাত লক্ষ্মী উড়ে চলেন, এক বসত থেকে অন্য বসতে। লক্ষ্মীপেঁচা ঘোলাটে এই নগরের আকাশে উড়ে চলে অতীব কষ্টে। তার সবুজ বসত, সোনালি ফসল, শস্যভরা এই দেশ খাঁ খাঁ করছে। কোথায় নামবে! কোনখানে জুড়োবে তার ডানা!
এত বলি লক্ষ্মী দেবী ভাবে মনে মনে।
মর্ত্যের এ দুঃখ নাশ করিব কেমনে।।
চিন্তান্বিত হয় কন নারায়ণ প্রতি।
কিরূপে নাশিব বল নরের দুর্গতি।।
চৈ হাত জোড় করে শুনছে দিদুনের পাশে বসে। পিসুন আছে, রাঙা কাকি আছে। আশপাশে আরও কয়েকজন আছেন দিদারা। তাঁদের ঠিক চেনে না সে। হাতে দূর্বা আর আতপ চাল নিয়েছে সবার মতো। বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে গল্পের মতো ব্রতকথা শুনতে। ছড়ায় ছড়ায় কথাবার্তা চলছে। দিদুন সুর করে দুলে দুলে পড়ছে। চৈ মন দিয়ে শুনছে সব কথাগুলো। লক্ষ্মী ভাবছে কী করে এই দুর্গতি থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়। চারিপাশে হিংসা, দ্বেষ, অপমান আর ক্লেদ। ঘুমিয়ে আছে সবার চেতনা। জ্ঞান। অন্ধের মতো চলেছে মৃত্যুর দিকে, ধ্বংসের ধ্বজা নিয়ে। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আজকের রাত অনেক অনেক বেশি স্বচ্ছ। সাদা ডানা মেলে লক্ষ্মীপেঁচা আকাশে। ধান্য কলস নিয়ে বরদা লক্ষ্মী। ‘নিশীথে বরদা লক্ষ্মী কো জগর্তীতি ভাষিনী’। কে জেগে আছ! উনি লক্ষ রাখছেন। কে জেগে আছ? কোঃ জাগরী। জেগে থাক। জেগে থাকাটাই আজ ধর্ম। ‘জাগ্রত যে ভালো’। দিকে দিকে শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। উলুধ্বনি আকাশে বাতাসে। সারা প্রকৃতি জেগে ওঠার জয়গান গেয়ে উঠছে। কোঃ জাগরী! সমস্ত জীবজগৎ জেগে উঠুক।
দিদুন গলায় আঁচল জড়িয়ে উবু হয়ে নমস্কার করল। সবার দেখাদেখি নমো করল চৈ আর হৈ। দিদুন আজ জেগে থাকবে? দিদুন কোলে টেনে নেয়, দিদিভাই সবসময়েই জেগে থাকতে হয়। সেটা মনে মনে... জেগে থাকাটাই জ্ঞান অর্জন... তোমরাও জেগে থেকো, আশীর্বাদ করি...।
ছবি ও গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় অভিষেক গোস্বামী