পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
শুধু সজলবাবু নন, পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, পিংলা, পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার বহু চাষিকেই বছরের বিভিন্ন সময় এমন সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়। রাস্তার ধারে, নদী কিংবা খালে এত যত্নের কুইন্টাল কুইন্টাল ফুল ফেলে দিতে হয় বাড়ি ফেরার আগে। একবুক শূন্যতা... পরের দিনের খাবাবের টাকার চিন্তা সঙ্গী হয় নিত্যদিন। অথচ, পাড়ার মোড়ের দোকানে ১০ টাকা দিলে গোটা কয়েক ফুল ও বেলপাতা ধরিয়ে দেয়। গাঁদাফুলের একটা মাঝারি সাইজের মালার দাম নেয় কোথাও দশ টাকা, কোথাও পনেরো টাকা। সামনেই শারদীয়া উৎসব। পদ্ম ছাড়া মায়ের আরাধনার কথা ভাবাই যায় না। পুজোর দিনগুলিতে ওই পদ্ম প্রতি পিস ২০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। ফুল আজ ব্যবসা। বড় ব্যবসা। প্রচুর টাকার লেনদেন। যার কণামাত্র পৌঁছয় না সজল জানাদের কাছে।
এর শিকড়টা রয়েছে খানিকটা অতীতের পথে। আসলে কয়েক দশক আগেও বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ আমাদের রাজ্যে সেইভাবে হতো না। বাড়ির সামনের বাগানে লাগানো গাছের ফুল দিয়েই হতো দেবসেবা। ভোররাতে ওই ফুল তুলে কিছু মানুষ শহরের বিভিন্ন বাজারে বসতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসব-অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে গ্রাম থেকে শহরে। আর সেই বাজার ধরতেই ব্যবসায়ীদের উৎসাহে ছয়ের দশক থেকে গ্রাম বাংলার উঁচু ধানের জমিতে ফুলচাষের সূত্রপাত। বর্তমানে গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, অপরাজিতা, দোপাটি, চন্দ্রমল্লিক, জবা, গ্ল্যাডিওলাস, করণ, জারবেরাল আস্টার, ডালিয়া, বেল, জুঁই চাষ হচ্ছে। এছাড়া হচ্ছে অ্যাসপেরাস, বটলব্রাস, ঘোড়াপামের মতো নানান বাহারি পাতাও। এক সময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ফুলচাষে রাজ্যে প্রথম ছিল। এখন রাজ্যে প্রথম নদীয়া, দ্বিতীয় পূর্ব মেদিনীপুর, তৃতীয় পশ্চিম মেদিনীপুর, চতুর্থ স্থানে হাওড়া জেলা। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট স্টেশন সংলগ্ন ফুলবাজার, ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর দেউলিয়া ফুল বাজার ও পাঁশকুড়ার সরকারি ফুল বাজার ছাড়াও ছোটখাটো বেশ কয়েকটি ফুল বাজার রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর বা হাওড়ায় তেমন কোনও ফুলের বাজার নেই। এছাড়া নদীয়ার বীরনগর, তাহেরপুর, বাদকুল্লা, মাঝেরগ্রামে বড় ফুল বাজার বসে। রাতভর জেগে প্রথমে সাইকেল, তারপর বাস ও ট্রেনে চেপে বাজারে ফুল আনেন চাষিরা। এইসব বাজার থেকে ফুলের বড় অংশ আসে কলকাতার মল্লিকঘাট ফুল বাজারে। মল্লিকঘাট থেকে একাধিক হাত হয়ে ওই ফুল পাড়ার বাজারে পৌঁছয়। ফুলের দামের বিষয়টি ঠিক হয় অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতোই। বিয়ে বা পুজোর মরশুম ছাড়া চাষিকে চোখের জল ফেলে ফুল বেচতে হয়। এ বছর বৃষ্টির জন্য সিংহভাগ চাষির ফুল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই ক্ষত মেরামতের আগেই এসেছে পুজোর মরশুম। সেকারণে কোলাঘাট ও পাঁশকুড়ার ফুল বাজারে এখন কেজিপ্রতি গাঁদা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। তিন ফুট লম্বা ২০টি গাঁদার মালার দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। কেজি প্রতি রজনীগন্ধা ৩০০ টাকা, বেল ৩২০ টাকা, জুঁই ৪০০ টাকা, দোপাটি ৩০ টাকা, অপরাজিতা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক হাজার জবা ফুলের দাম ২৫ টাকা, প্রতি পিস গোলাপ ২ টাকা। আর পদ্ম এখন বিকোচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা প্রতি পিস।
দেবদেবীর পুজোর দিন বিশেষে ফুলের চাহিদা বাড়ে-কমে। কালীপুজোয় জবা ফুল, শনি পুজোয় নীল অপরাজিতা, মহাদেবের পুজোয় আকন্দ, সাদা ধুতরা ফুল ও ফল, সরস্বতী পুজোয় গাঁদা সহ বিভিন্ন ধরনের হলুদ ফুল, দুর্গাপুজো ও লক্ষ্মীপুজোয় পদ্ম। চাষিরাও এই সমীকরণ মাথায় রেখেই চাষ করেন। ফুলের চাষ অন্য যে কোনও চাষের তুলনায় অনেক কঠিন। আমরা কথায় কথায় বলি, ফুলের মতো জীবন। সত্যিই তাই। সামান্য জল জমলেই বেশিরভাগ ফুল গাছ নষ্ট হয়ে যায়। পোকা ও রোগের উপদ্রব থেকে গাছকে বাঁচাতে দিনভর ফুল জমিতে পড়ে থাকতে হয়। গাঁদার মতো বেশ কিছু ফুল প্রতিদিন তুলতে হয়। ফুলের দাম থাকুক বা না থাকুক...। কারণ, ফুল না তুললে নতুন কুঁড়ি আসে না। অথচ সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত বাজারে দাম ওঠাপড়ার কোনও স্থিরতাই নেই। গতকাল যে ফুল ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, আজ তা ২ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হতে পারে। এই ফাটকা কাঁধে নিয়েই চাষজমিতে যেতে হয় তাঁদের।
কথা হচ্ছিল নারায়ণচন্দ্র নায়কের সঙ্গে। সারা বাংলা ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। বললেন, ‘রাজ্যের ফুল চাষ আজও ফুল ব্যবসায়ী ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা কন্ট্রোল করে। ঢাল তরোয়ালহীন হর্টিকালচার দপ্তরের কর্মকাণ্ডের সুফল সিংহভাগ চাষিই পায় না। রাজ্যের শতকরা ৯৮ ভাগ বাজারের কোনও পরিকাঠামো নেই। বর্ষায় গোড়ালি সমান জল ও কাদার উপর ফুল রেখে বিক্রি করতে হয় চাষিদের। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা চাষিদের জন্য কারও কোনও ভাবনা নেই। ফুল থেকে উপজাত সামগ্রী তৈরির কোনও ব্যবস্থা নেই। রজনীগন্ধা থেকে সুগন্ধি তৈরি হলে, গাঁদা থেকে আবির ও রং হলে প্রতিদিন বাজারের ফুলের দাম ওঠা‑পড়ার কেরামতি আটকে যেত। বিকল্প ব্যবস্থা নেই বলেই বছরের বিভিন্ন সময় ফুল ফেলে দিতে বাধ্য হন চাষিরা। কয়েক দশক আগে ইংল্যান্ড সহ বিদেশে ফুল পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। এখন সব বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি পণ্য হিসেবে ফুলকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় কৃষিবিমার সুযোগ নেই। ক্ষতিপূরণও জোটে না চাষিদের। চাষের জন্য কৃষি ঋণও মেলে না। আসলে ফুল চাষ ও চাষিদের উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়ার সময় বোধহয় কোনও শাসকেরই নেই।’
ফুলের দামই একমাত্র সমস্যা নয়। গোলাপের সৌরভে বিমোহিত হলেও, আমরা অনেকেই জানি না গোলাপের কাঁটায় চাষির রক্তাক্ত হওয়ার কাহিনী। দেবী দুর্গার পায়ে পদ্ম অঞ্জলি দিই ঠিকই, কিন্তু আমরা জানতে পারি না পদ্ম পুকুর বা নয়ানজুলিতে থাকা পদ্ম তুলতে গিয়ে খরিশের ছোবলে কতজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। আমরা জানতেই পারি না, প্রতিদিন ভোররাতে জাতীয় সড়কের উপরে বসা ফুল বাজারে ফুল আনার সময় কত চাষি ট্রাকের ধাক্কায় মারা গিয়েছেন, স্টেশন লাগোয়া ফুল বাজারে ফুলের বস্তা নিয়ে লাইন পারাপারের সময় কতজন ফুলচাষি ট্রেনে কাটা পড়েছেন। কত রঙিন স্বপ্ন প্রতিদিন ট্রাকের তলায় ও ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ছে, পিষে যাচ্ছে... তার কোনও ইয়ত্তা নেই। তারপরও তাঁরা স্বপ্ন দেখেন ফুলচাষের সঠিক দামটা অন্তত পাওয়ার। সারা বছর চোখের জল ফেলার পর পুজোর মরশুমে অন্তত একটু বেশি টাকায় বিক্রির... যা অন্তত বাজার দরের ধারেকাছে থাকে। তাহলে ছেলেমেয়েগুলোর জন্য হয়তো একটা নতুন জামা হবে। হয়তো মায়ের জন্য একটা শাড়ি হবে...। সাপ‑লুডোর মারপ্যাঁচ খেলতে খেলতে ক্লান্ত চাষি প্রায়শই প্রশ্ন তোলেন, কবে এই স্বপ্ন সত্যি হবে!