উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
অমলাশঙ্করের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০৪ সালে। ‘আমরা মেয়েরা’ পাতার জন্য এই কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার ভার পড়েছিল আমার ওপর।
নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর। বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি। এহেন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে আমি একই সঙ্গে রোমাঞ্চিত আবার একটু শঙ্কিতও বটে। মুখোমুখি হতেই অবশ্য সব শঙ্কা কাটিয়ে দিলেন অমলাশঙ্কর স্বয়ং! হাসিমুখে আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি। তারপর অকপটে বললেন, ‘আমার ডান দিকে বোসো। বাঁ কানে শুনতে অসুবিধে হয়। আর প্রশ্নগুলো একটু জোরে জোরে বলবে। আমার বুঝতে সুবিধে হবে।’ অবাক হয়েছিলাম। এত নামী ব্যক্তিত্ব, অথচ কী সরল তাঁর আচরণ! এরপর আরও দু’-একবার অমলাশঙ্করের সঙ্গে কথা বলেছি। আর প্রতিবারই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর সহজ, সাবলীল আচরণে। শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর শততম জন্মদিনে। তবে তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি। গত ২৪ জুলাই, শুক্রবার প্রয়াত হলেন অমলাশঙ্কর। তাঁর পৌত্রী শ্রীনন্দাশঙ্করের স্মৃতিচারণায় উঠে এলেন এক অচেনা অমলা।
ঠাকুমা অমলাশঙ্কর ঠিক কেমন ছিলেন?
বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হলেও আমার কাছে তিনি শুধুই ঠাম্মা। আমার সঙ্গে শিশু হয়ে মিশতেন। খেলতেন। আবার ঠাকুমা-নাতনি সুলভ ঝগড়াও করতেন।
শুনেছি আপনাকে নাকি বিশেষ একটি ডাকনামে ডাকতেন তিনি?
ডাকতেন তো। আমি ছিলাম ওঁর বাহাদুর নাতনি। আর কেন এমন নাম দিয়েছিলেন জানেন? আমার সঙ্গে তর্কে হেরে যেতেন বলে।
কী নিয়ে তর্ক হতো আপনাদের?
যাবতীয় বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক লাগত আমার সঙ্গে ঠাম্মার। হয়তো কারও ব্যবহারে খারাপ লাগল ওঁর। আমাকে বললেই, আমি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম দোষ দু’পক্ষের। ঠাম্মার সেই কথা পছন্দ হতো না। খানিকক্ষণ উনিও তর্ক করতেন আমার সঙ্গে। কিন্তু আমি তো ছাড়ার পাত্রী নই। শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে ঠাম্মা বলতেন, ‘ওরে আমার বাহাদুর নাতনি রে, তোর সঙ্গে কি আমি তর্কে পারি?’
আপনার সঙ্গে তো ওঁর ভাবও ছিল ভীষণ...
(থামিয়ে দিয়ে) ওরে বাবা। ভাব বলে ভাব? একেবারে ভীষণ ভাব। ছোটবেলায় ঠাম্মা ছিলেন আমার খেলার সঙ্গী। খেলনাবাটি থেকে শুরু করে সব ধরনের খেলা খেলেছি আমরা দু’জনে। আর শুধু খেলাই বা বলি কেন, গল্পও তিনি দারুণ বলতেন। রূপকথার নয় কিন্তু, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প।
তাই নাকি? কী রকম?
এই যেমন তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় কেমন নাচের জন্য যশোর থেকে প্যারিস পাড়ি জমিয়েছিলেন। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে একেবারে ইউরোপের ঝলমলে শহর প্যারিস! ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়। ঠাম্মা ভীষণ ভালো ফরাসি ভাষা জানতেন। অনেক সময় তাই গল্পের কিছু অংশ ফরাসিতেও বলতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আবার আমার দাদু উদয়শঙ্করের সঙ্গে শো করার গল্প, এই সবই ঠাম্মা আমায় শোনাতেন। খাব না বলে বায়না করলে, ঠাম্মা হঠাৎ নেচে আমায় ভুলিয়ে খাইয়েও দিতেন।
ঠাকুমার ব্যক্তিত্বের কোন জিনিসটা সবচেয়ে টানত আপনাকে?
ঠাম্মা খুব সহজ সরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ওঁর সারল্যের প্রতিই বোধহয় সবচেয়ে আকৃষ্ট ছিলাম আমি।
আপনাদের খুনসুটির কথা একটু বলুন।
সে অনেক গল্প। বলতে বসলে শেষ হবে না। আমার সঙ্গে ঠাম্মার ছিল মজার সম্পর্ক। এই ভাব তো এই আড়ি। মনে আছে, তখন আমি মুম্বইতে থাকি। আমার বরের সঙ্গে সবেমাত্র আলাপ হয়েছে। বন্ধুত্বের থেকে একটু অন্যদিকে সম্পর্ক ঘুরতেই ঠাম্মার সঙ্গে আলাপ করালাম। কথা বলার পর আমাকে আলাদা ডেকে ঠাম্মা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলো। নাহলে আমার ওকে যা পছন্দ হয়েছে, বেশিদিন দেরি করলে কিন্তু আমি বিয়ে করে নেব।’ আমিও এই কথা শুনে বললাম, ‘ও যেন তোমার মতো বুড়িকে বিয়ে করবে...’। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ঠাম্মা বললেন, ‘করতেও পারে, অমলাশঙ্কর বলে কথা।’ এমনই ছিলেন আমার ঠাকুমা।
উনি তো খুব ভালো রান্না করতেন। ওঁর হাতের কোন রান্না আপনার সবচেয়ে পছন্দ?
ঠাম্মা যা-ই রাঁধতেন তাই একেবারে অন্যরকম সুস্বাদু হয়ে উঠত। তবে তার মধ্যে আমার আর বাবার (আনন্দশঙ্করের) সবচেয়ে প্রিয় ছিল কন্টিনেন্টাল রান্না। চিকেন ইন হোয়াইট স্যস, স্প্যাগেটি উইথ মিট স্যস, বিটরুট মেয়ো স্যালাড— এইসব রান্নায় ঠাম্মা এক অন্য মাত্রা যোগ করতেন। এ ছাড়াও ঠাম্মার হাতের গুজরাতি ডালও আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। রান্না নিয়ে বিভিন্ন রকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন ঠাম্মা।
কী রকম?
এই যেমন অ্যাভোকাডোর সঙ্গে এটা সেটা মিশিয়ে কিছু একটা বানিয়ে ফেললেন। অথবা খুব প্রচলিত পদে একটু অন্য ধরনের মশলা ব্যবহার করে স্বাদ বদলে দিলেন। এই রকম।
সাজগোজ করতে ভালোবাসতেন?
আলাদা করে সাজতেন না, তবে খুব ফিটফাট থাকতেন। লিপস্টিক লাগাতে খুব ভালোবাসতেন। আমি ওঁকে লিপস্টিক এনে দিতাম মুম্বই থেকে। ওয়াইন রং বা বাদামি রঙের শেড, মেরুন ইত্যাদি ওঁর খুব প্রিয় ছিল। ওই এক লিপস্টিক দিয়েই সব রকম মেক আপ সেরে ফেলতেন ঠাম্মা। আঙুলের ডগায় লিপস্টিক নিয়ে চোখের ওপর লাগিয়ে নিতেন। তখন ওটাই হয়ে যেত আই শ্যাডো। অথবা গালে লাগিয়ে ঘষে দিতেন। ওটাই তখন বদলে যেত ব্লাশ অন-এ। এই ছিল ঠাম্মার সাজ। কিন্তু শাড়ির ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। তসর খুব ভালোবাসতেন। রঙিন শাড়ি প্রায় পরতেই দেখিনি ওঁকে।
আপনার চরিত্রের কোন গুণে মুগ্ধ ছিলেন অমলাশঙ্কর?
বলতে লজ্জা করছে, তবু বলি, ঠাম্মা আমার নাচে মুগ্ধ ছিলেন। যে কোনও স্টেজ শোতে আমায় সামনে রাখতে বলতেন। অথচ বাড়িতে সবচেয়ে খারাপ বোধহয় আমার নাচ। কিন্তু সে কথা ঠাম্মাকে বোঝায় কার সাধ্য? সবসময় বলতেন আমার স্টেজ প্রেসেন্স নাকি দাদুর মতো। ছোটবেলায় না বুঝলেও ক্রমশ কথাটার তাৎপর্য বুঝেছি। এটা যে কত বড় প্রশংসা, তা আমি এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করি।
আপনার নাচের তালিম কি ঠাকুমার কাছেই শুরু?
না, না। তখন জীবনটা অত িসরিয়াসলি নিইনি। ছোটবেলায় তো বলিউডের গানই বেশি করতাম। ঠাম্মা কিন্তু সেইসব গানের সঙ্গেও দিব্যি নাচতেন। ওই যে গানটা, ‘ছোটা বাচ্চা জান কে না তুম...’ ওটা তো ঠাম্মার খুব প্রিয় ছিল। কথায় কথায় গানের আর একটি লাইন, ‘তা ধিন ধিন না, না তিন তিন না...’-র সঙ্গে নেচে দেখিয়ে দিতেন। ঠাম্মা খুব শরীর সচেতন ছিলেন। কথা বলতে বলতেই এক্সারসাইজ করে ফেলতে পারতেন। আমরা অবাক হয়ে যেতাম।
ওঁর সঙ্গে প্রথম যখন আমার আলাপ হয়, তখন নখ দিয়ে ছবি আঁকতেন উনি। এই নেশাটা কবে থেকে ধরেছিল?
আঁকার ঝোঁকটা কিন্তু নতুন নয়। দাদুর সঙ্গে স্টেজ শো করার সময় স্লাইডগুলো সব ঠাম্মাই বানাতেন। ছায়া সরিয়ে সরিয়ে দৃশ্য বানানো, পেন দিয়ে আঁচড় কেটে ছবি তৈরি এইসব করতে উনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ক্রমশ আঁকার পরিধি বাড়িয়ে তোলেন ঠাম্মা। নখ দিয়ে ছবি তারই অন্যতম নিদর্শন। ক্যানভাসে রং করে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে ছবি তৈরি, এ আমার ঠাকুমার পক্ষেই সম্ভব।
কখনও রেগে যেতে দেখেছেন ওঁকে?
রাগ, দুঃখ সবই ছিল। কিন্তু এগুলো কোনওটাই ওঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। বরং আমার ঠাকুমা ছিলেন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষ। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর সেই হাসি অনেক ম্লান হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবু বহু দিন পর্যন্ত এক অসম্ভব প্রাণশক্তি ছিল ঠাম্মার মধ্যে। শেষ দিকে যখন কথাও বলতে পারতেন না, তখনও ওঁর মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়নি। ঠাম্মার শেষ সময়ে ওঁর কাছে থাকতে না পারার দুঃখটা আমার চিরজীবন থাকবে। তবু ঠাম্মার হাসিমুখটাই যে আমার স্মৃতিতে থেকে গেল এটাই সান্ত্বনা।
ছবি: শ্রীনন্দাশঙ্করের সৌজন্যে প্রাপ্ত