উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
বিতর্কটা শতাব্দীপ্রাচীন। কিন্তু এখনও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে উত্তাল আমেরিকাকে দেখে কিছুটা নাড়া পড়েছে এ দেশেও। সম্প্রতি ফর্সা হওয়ার একটি ক্রিম প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের নামে সামান্য বদল এনেছে। অনেকে বলছেন, এই নাম পরিবর্তন দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। কিন্তু নামে কী-ই বা আসে যায়? মনের মধ্যে কালো নিয়ে অবিরত কুণ্ঠার যে বীজ, তা তো আজীবন লালন করেই চলি আমরা। আর তাই তো কালো হওয়ার দাম দিতে হয় এ দেশের অসংখ্য মেয়েকে। কালো মেয়ে মানেই এখনও বিবাহযোগ্যা নয়। অনেক বেশি পণ ও আরও বহু কিছু খয়রাতি দিয়ে বাবা-মা যদি সে মেয়ের কোনওমতে বিয়ের ব্যবস্থাও করেন, রঙের কাঁটাটা তবু থেকেই যায়। হয় সারা জীবন সেই গঞ্জনা মাথায় নিয়ে চলেন মেয়েটি। নয়তো তাঁকে জীবন থেকেই সরে যেতে হয়। কখনও আবার তাঁকে সরানোর দায়িত্বটা সুনিপুণভাবে পালন করেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
এ দেশে ছেলে কালো হলে অবশ্য ততটা মাথা ঘামায় না কেউ। কোনও মা শিশুকন্যার জন্ম দিলে আজকাল যদিও উদার হয়ে আমরা বলতে শিখেছি, আমাদের কাছে ছেলে-মেয়ে সমান। কিন্তু সে যদি কালো হয়? আমাদের উদারতার কপালে ভাঁজ পড়ে! চক্রবৎ গল্পটা ঘুরতে থাকে এভাবেই।
কালোর কোনও কদর না করাটাই ঘোর বাস্তব আজও। নন্দিতা দাশের মতো অভিনেত্রী ২০০৯ সাল থেকে ডার্ক ইজ বিউটিফুল ক্যাম্পেন চালাচ্ছেন। অতীতেও আরও অনেক আন্দোলন হয়েছে। এত বছর পরে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলতে কোনও কোনও সংস্থা ফেয়ারনেস ক্রিম তুলে নিচ্ছে। কেউ নাম বদলে নতুন মোড়কে পুরনো জিনিস দিয়ে বিতর্ক ঢাকতে চাইছে। এ বিষয়ে মনোবিদ এবং নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রত্নাবলী রায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘বিষয়টা একেবারেই নিন্দনীয়। ত্বকের রং নিয়ে এই আন্দোলনটা বহু দিনের। নারীবাদী, বিশেষ করে যাঁরা অশ্বেতাঙ্গ (উওম্যান অব কালার) মহিলা, তাঁরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন। আজ হঠাৎ করে ফেয়ারনেস ক্রিমের নাম বদল কিন্তু একেবারেই ওপর-ওপর একটা বদল মাত্র। এর মধ্যে তো কোনও গভীরতা নেই। নাম বদল করলেও মনোভঙ্গি বদলায়নি। এই পদক্ষেপটার মধ্যে রাজনীতি থেকে যায়। চাপের মুখে একটা সংস্থা নাম পাল্টেছে তাদের পণ্যের। তা বলে জনমানসে ফর্সা নারীর প্রতি যে কামনা-বাসনা, সেটা তো উধাও হচ্ছে না। এই আকাঙ্ক্ষা তো বহু শতাব্দীর। এটা তো সামাজিক নির্মাণ। তাই এই একটামাত্র পদক্ষেপে সেই মানসিক গঠনের কি পরিবর্তন হবে? ফর্সা যদি বা না-ও
হয়, এখনও কাঙ্ক্ষিত থেকে যাবেন গমের বর্ণের সুন্দরী নারী।’
রত্নাবলীর মতে, এই বিষয়টায় সিনে-তারকাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো অভিনেত্রী এক সময় ফর্সা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপন করেছেন। পরে সেটা নিয়ে আক্ষেপও করেছেন। কিন্তু তাঁদের মতো ব্যক্তিত্ব যখন পণ্যটির প্রচার একবার করে ফেলছেন, তখন সাধারণ মানুষ চটজলদি তাতে প্রভাবিত হবেনই। নন্দিতা দাশের মতো অভিনেত্রী আজও তাঁর অভিনয় নয়, প্রাথমিকভাবে ত্বকের রঙের জন্য আগে পরিচিতি পান।
পাশাপাশি রত্নাবলী মনে করিয়ে দিলেন, ‘ঠাকুরের রূপে কালো দেখতে আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু জীবনসঙ্গিনীটি কালো হলে তাঁকে অবমাননা করি। এই মানসিকতার সংঘাত চললে আমাদের নাম বদলে সত্যিই কোনও কিছু হবে না। পণ্যের নাম বদল করে এমন একটা শব্দ বেছে নেওয়া হল, যার মধ্যে পুরনো শব্দটারই ছায়া। এটা তো বিপণন কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। রোষের মুখে পড়ে একটা সামান্য শব্দ সরিয়ে সেই গোত্রেরই আর একটি শব্দ দেওয়া হল।’
তাঁর উপলব্ধি, ‘আমি নিজে কালো বলে এটা বুঝতে পারি খুব। আমাকে হয়তো কিছু শুনতে হয়নি। কিন্তু জানি, লোকে কালো হিসেবেই দেখে আমাকে। আমার নিজের সেটা নিয়ে কোনও স্টিগমা নেই, কারণ শিক্ষা-কাজ-অর্থ দিয়ে সেটা পার করেছি। কিন্তু সবার পক্ষে সেটা তো সম্ভব নয়। ত্বকের রং কেন তাঁর পরিচয়ের সূচক হবে, এই প্রশ্নটা তুলতে হবে। এই মানসিক গঠন তৈরির ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ কালো শিশুকন্যা জন্মালে যদি পরিবারের মধ্যেই লজ্জা তৈরি হয়, সেটা তো বড় সমস্যা। সেই শিশু বড় হয়ে ওঠার মধ্যেই গোটা পরিবারের কুণ্ঠা মিশে থাকে।
নারী অধিকার রক্ষার আর এক কর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায়ের গলাতেও এক সুর। তিনি জানিয়েছেন, প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে ফেয়ারনেস ক্রিমজাতীয় সব পণ্য মেয়েদের সৌন্দর্যের যে ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে, নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলন বহুকাল ধরেই তার বিরোধিতা করছে। তাঁর কথায়, ‘আমরা যাঁরা এই আন্দোলনের কর্মী, তাঁরা সবসময়েই বলি, এই সব পণ্য সৌন্দর্যের যে ধারণা তৈরি করে, সেটা বৈষম্যমূলক এবং পিতৃতান্ত্রিক। পুরুষের চোখে একজনকে সুন্দরী হতেই হবে, এটা তৈরি করা ভাবনা।’
আজ একটা সংস্থা তাদের পণ্য থেকে শব্দ বাদ দিয়েছে বলে হইচই হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে চামড়ার রঙের রাজনীতির যোগ রয়েছে, বুঝিয়ে দিলেন দোলনও— ‘ফর্সা না হলেই বৈষম্যের শিকার হতে হবে। কালো মেয়ে হলে পণের টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে। এই তো আমাদের বাস্তব। তার মধ্যে ওরা নাম থেকে ফর্সা শব্দটা বাদ দিয়েছেন, বেটার লেট দ্যান নেভার। এইটুকু ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু তারপরেও পণ্যটা রয়েছে। আর যেসব শব্দ সহ রয়েছে, তাতেও সৌন্দর্যের সেই অনুরণন বোঝানোরই চেষ্টা রয়েছে। সেই স্টিরিওটাইপ থেকে সরে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করা হয়নি।’
বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা কিছুটা হলেও বিষয়টার মধ্যে যে গলদ রয়েছে, সেটা বুঝছে। এটা অন্তত ইতিবাচক, মনে করছেন তিনি। তবু বোঝালেন, ‘বাস্তবে আমাদের সমাজের মানসিকতায় ফর্সা-কালোর ভেদাভেদ থেকেই যাচ্ছে। এখনও বিয়ের জন্য ফর্সা পাত্রীই চাই। ফর্সা বউয়ের বেশি প্রশংসা। কালো মেয়েদের রং পরিষ্কার করার জন্য হাজার উপায় ভাবতে হয়। ফলে বৈষম্য মনের গভীরেই রয়েছে। শুধু নাম পরিবর্তন করে সেক্ষেত্রে কিছু হবে না। আমাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। সৌন্দর্যের ধারণা কেন কর্পোরেট হাউস তৈরি করে দেবে, সেই প্রশ্নটা তুলতে হবে। আমরা কেন তার দ্বারা প্রভাবিত হব, সেটাও ভাবতে হবে।’
যদি সত্যি পরিবর্তনের কথা ভাবা হতো, তাহলে চামড়ার স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা যেতে পারত। চামড়ার রঙের প্রশ্ন কেন আসবে? বলছেন দোলন। ‘উজ্জ্বল বলো বা ফর্সাই বলো, এগুলো তো কোনও পার্থক্য তৈরি করে না। প্রসাধনী ব্যক্তিত্ব বা সুস্থতা নিয়ে কথা বলুক, কিন্তু চামড়ার রঙে বৈষম্য দেখিয়ে সৌন্দর্যের ধারণা গড়ে তোলা উচিত নয়। আসলে সমাজের মানসিকতা বুঝেই ওরা এইভাবে পণ্যগুলোকে সামনে এগিয়ে দেয় আর আমরা সেটা কিনি সেই মানসিকতা বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। তাই প্রক্রিয়াটা চক্রাকারে চলে। সেটা থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।’