উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
‘শোলে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপটা মনে পড়ছে? হাতে ঘোড়ার চাবুক নিয়ে বাসন্তী রূপী হেমা মালিনী বলছেন, ‘চল ধান্নো ভাগ...তেরি বাসন্তী কি ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়।’ আর তারপরেই সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য— বাসন্তীর টাঙ্গায় চড়ে ধান্নোকে নিয়ে সেই ধুলো ওড়ানো দৌড়। দর্শকও যেন রুদ্ধশ্বাস সেই দৌড়ে সামিল। শেষমেশ টাঙ্গার চাকা ভেঙে ঘায়েল হল বাসন্তী। তাই বলে দৌড় তখনও থামেনি। ভাঙা টাঙ্গায় বিঁধে ধন্নোর সঙ্গে ছেঁচড়ে চলল বাসন্তী। এই আইকনিক দৃশ্যে স্ক্রিন জুড়ে হেমামালিনীর দাপাদাপি থাকলেও পুরো দৃশ্যটার দুঃসাহসিক অভিনয় যিনি করেছিলেন, তাঁর নাম রেশমা। হেমা মালিনীর ডুপ্লিকেট। স্টান্ট ওম্যান। চরম দারিদ্র্য আর ভাত কাপড়ের অভাব টমবয় মার্কা রেশমাকে করে তুলেছিল এক জেদি নির্ভীক দুঃসাহসিনী। এছাড়া বাবার বন্ধু ফাইট মাস্টার আজিম আঙ্কেল ও পাড়ার টাঙ্গাওয়ালাদের সঙ্গে মেলামেশা ও তাদের সহায়তায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন পুরোদস্তুর স্টান্ট ওম্যান। ১৯৬৮ সালে ‘তাস কে ৫২ পত্তে’ ছবি দিয়ে বডি ডাবলের কাজে হাতেখড়ি। এরপর কয়েকটি বিখ্যাত সিনেমা, যেমন ‘রাখি আউর হাতকড়ি’, ‘শোলে’, ‘কসমে ওয়াদে’ তাঁর স্টান্টবাজিকে স্মরণীয় করে তোলে। মীনাকুমারী, হেমামালিনী, রীনা রায়, শর্মিলা ঠাকুর, মৌসুমী চ্যাটার্জি, রাখী গুলজারের মতো বলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রীদের হয়ে স্টান্টবাজি করেছেন তিনি অবলীলায়। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এসব দুঃসাহসিক কাজে হাউজফুল সিনেমা হলে হাততালি কুড়িয়েছেন নায়িকারাই। আড়ালে থাকা স্টান্ট ওম্যান রেশমাকে কেউ মনেও রাখেনি। তাই তো আর্থিক স্বীকৃতি প্রায় কিছুই জোটেনি তাঁর কপালে। দুর্দশা আর দুর্ভোগ সঙ্গে করেই সাঙ্গ হয়েছে জীবন।
তবে হিন্দি সিনেমায় স্টান্ট ওম্যান একা রেশমা নন। তার বহু আগেই মেরি অ্যান ইভান্সের হাত ধরে বলিউডে স্টান্ট ওম্যানদের কেরামতি শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে জন্ম মেরি অ্যানের। বাবা স্কটিশ আর মা গ্রিক। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর বছর দুই আগে ১৯১৩ সালে বাবা মায়ের সঙ্গে প্রথম ভারতে আসা। মেরি অ্যানের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। সে বয়সেই বন্দুক চালানো আর শিকারে হাতেখড়ি। এরপর সার্কাসে ছেলেদের পোশাক পরে চাবুক হাতে বাঘ সিংহের খেলা দেখানো শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ আসে। মেরি অ্যান থেকে তখনই তিনি হয়ে ওঠেন নাদিয়া। ছবির নাম ‘হান্টারওয়ালি’। মুক্তি পেল ১৯৩৫ সালে। সিনেমার পর্দা জুড়ে কেবল দুঃসাহসী নাদিয়ার দাপাদাপি। হিন্দি ছবি তথা সারা ভারতের প্রথম স্টান্ট কুইন হয়ে উঠলেন নাদিয়া। সিংহের সঙ্গে খালিহাতে যুদ্ধ, হাতির পিঠে চড়ে দুঃসাহসিক স্টান্টবাজি কিংবা চলন্ত ট্রেন থেকে অবলীলায় ঝাঁপ— নাদিয়ার কাছে এসব ছিল জলভাত। হাতে চাবুক নিয়ে একজন মহিলা হয়ে সেকালের পুরুষশাসিত সমাজে তিনি ছিলেন এক ভয়ঙ্কর হান্টারওয়ালি। মিস ফ্রন্টিয়র মেল, ডায়মন্ড কুইন, জাঙ্গল প্রিন্সেস, লেডি রবিনহুড— এমন বহু নামে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। প্রকৃত নাম মেরি অ্যান ইভান্স হারিয়ে গেল একাধিক দুঃসাহসিক ছদ্মনামের আড়ালে। ডরোথি ওয়েনার তাঁর আত্মজীবনী ‘ফিয়ারলেস নাদিয়া : দ্য ট্রু স্টোরি অব বলিউড’স অরিজিনাল স্টান্ট কুইন’-এ বর্ণনা করেছেন তাঁর স্টান্ট খ্যাত জীবনের বহু অজানা কথা ও কাহিনী। এক কথায় হান্টারওয়ালি নাদিয়া সম্পর্কে বলা হয় – ‘Riding like a storm, fighting like a fury and loving like a woman .’ (দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস) সাহসিনী বঙ্গললনা মিনারা খাতুনকে হয়তো আপনারা কেউই চেনেন না। কিন্তু আমির খান ও রানি মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘তলাশ’ ছবিটি দেখেছেন অনেকেই। ভয়ঙ্কর জলের সেই রোমহর্ষক দৃশ্যটাও হয়তো বা মনে গেঁথে আছে। কিন্তু দৃশ্যটি বাস্তবায়িত করার পিছনে যে স্টান্ট ওম্যানের কেরামতি রয়েছে, তাঁর নাম কারও নজরেই পড়েনি। তিনিই মিনারা খাতুন। ফুল বডি ফায়ার, হর্স কার স্টান্ট, গ্লাস ব্রেক প্রভৃতি স্টান্টবাজিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
স্টান্ট ওম্যান সানোবর পারদীওয়ালার নামও নিশ্চয়ই ঘুণাক্ষরেও কেউ শোনেনি। অথচ ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ , ‘ধুম ৩’, ‘বাজিরাও মস্তানি’, ‘উড়তা পঞ্জাব’ প্রভৃতি সিনেমার চমকপ্রদ দৃশ্যগুলো শ্যুট করা সম্ভবই হতো না তাঁর স্টান্টের কেরামতি ছাড়া। এইসব দৃশ্যই সানোবর করেছেন জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি
নিয়ে। এছাড়া ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ খ্যাত স্টান্ট ওম্যান গীতা ট্যান্ডনকে কতজনই বা চেনেন? ডিভোর্সি, দুই সন্তানের জননী গীতা তাঁর শিশুদের দুধ কিনে খাওয়াতে পারেন না। অর্থাভাব এমনই প্রকট তাঁর জীবনে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সম্মান হিসাবে জোটে চরিত্র নিয়ে অপবাদ। জীবনযুদ্ধে তবু হেরে যাননি গীতা। পুরুষশাসিত সমাজে একচেটিয়া স্টান্টম্যানের ভোগের রাজত্বে থাবা বসিয়েছেন গীতা ও
তাঁর মতো বহু অখ্যাত স্টান্ট ওম্যান। যাঁদের পরিশ্রম ও অবদানের কারণে বলিউডে
নায়িকারা আজ আর শুধুই গাছের ডাল ধরে গান করেন না। বরং নায়কের পাশাপাশি তাঁরাও ছবিতে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পান। যাঁদের কারণে মর্দানির মতো ছবি তৈরি হয়। সমানাধিকারের প্রশ্নে, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে স্টান্ট ওম্যানদের এই লড়াই নিঃসন্দেহে প্রশংসার
দাবি রাখে।