উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
মেয়েরা শিক্ষিত। মেয়েরা স্বনির্ভর। তবু আজও সমাজে কন্যাসন্তান বড় বালাই। তাই তো আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এখনও কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হয় অবাধে। এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করেছে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক। তাতে ভারতের তিনশোর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করা হয়, একমাত্র সন্তানের ক্ষেত্রে পুত্র না কন্যা, কে বেশি কাম্য? প্রশ্নের উত্তরে ৯২% ছাত্র এবং ৬৬% ছাত্রীর ভোট পড়েছে পুত্রের পক্ষে। এই যখন সামাজিক চিত্র, তখনও দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে কন্যার দিকেই পাল্লা ভারী! ভারতের বিভিন্ন দত্তক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানলাম দত্তক নেওয়ার সময় একটি ফর্ম ফিল আপ করতে হয়, যেখানে পুত্র বা কন্যার চাহিদা জানানো যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কন্যাসন্তান দত্তকের প্রতি নিঃসন্তান দম্পতির আগ্রহ ক্রমবর্ধমান।
আধুনিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির বদল
এই বিষয়ে সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি বা ‘সিএআরএ’-র সিইও দীপক কুমারকে প্রশ্ন করলে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘কন্যাসন্তানের পক্ষে অক্লান্ত ক্যাম্পেনের ফলেই নিঃসন্তান বাবা-মা পুত্রের তুলনায় কন্যাসন্তানই বেশি দত্তক নিতে চাইছেন।’ কিন্তু সামাজিক চিত্র তো সে কথা বলে না। তাহলে কি কন্যাসন্তান বেশি মাত্রায় দত্তকের জন্য দেওয়া হয় বলেই এক্ষেত্রে তাদের চাহিদা বেশি? প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দিলেন দীপক কুমার। বললেন, বাবা-মায়ের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই তাঁদের পুত্রের তুলনায় কন্যার প্রতি বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। তিনি আরও বলেন, এই চিত্রটি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে তা নারীর অগ্রগতির পথপ্রদর্শক
হতে পারে।
কন্যা বড় বালাই
এই বিষয়ে দিল্লির বেসরকারি দত্তক সংস্থা ‘মাতৃছায়া’-র কর্ণধার গীতা চৌহান জানালেন, ২০১৪ সাল থেকে কন্যাসন্তান দত্তক নেওয়ার হার বাড়তে শুরু করে। আগেকার চিত্র অনুযায়ী, দত্তক বিষয়ে নিঃসন্তান দম্পতিদের একটা মানসিক বাধা কাজ করত। তখন দত্তক দেওয়া-নেওয়ার কাজটি মোটামুটি পরিবারের মধ্যেই সারা হত। কিন্তু কাগজে-কলমে, সইসাবুদ করে অনাথ শিশু দত্তক নেওয়ার মাত্রা গত পঁচিশ বছরে প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছে। এবং এই বৃদ্ধিতে পুত্রের তুলনায় কন্যা ক্রমশ বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। গীতার মতে, বাবা-মায়ের একাধিক কন্যা থাকলে তাঁরা একটিকে নির্দ্বিধায় দত্তকের জন্য দিয়ে দেন। কিন্তু পুত্রের ক্ষেত্রে এমনটা কখনওই ঘটে না। ফলে পুত্রসন্তান তখনই দত্তকের জন্য দেওয়া হয়, যখন সে প্রকৃতই অনাথ। তাই আজও দত্তকের দপ্তরে পুত্রের চেয়ে কন্যাই বেশি আসে। গীতা জানালেন, এর জন্য আমাদের সমাজই দায়ী। এখনও বহু পরিবারে একাধিক কন্যার জননী অত্যাচারিত হন। আজও মেয়েদের বিয়ের সময় পণের প্রশ্ন ওঠে। এবং এখনও কালো মেয়ের বাবা-মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ফলে সমাজে মেয়েদের যখন এমন অবস্থা, তখন একাধিক কন্যাসন্তান দায় তো বটেই।
কী বলছে পরিসংখ্যান?
এবার বরং একটু দেখি কন্যাসন্তান দত্তকের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান কী বলছে? সিএআরএ-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে তাদের সংস্থায় ৪১৭০ জন বাচ্চা দত্তকের জন্য আসে। তার মধ্যে ২৫৪৭ জন কন্যা এবং ১৬২৩ জন পুত্র। এর আগে, ২০১৬-১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১৩০ জন শিশু দত্তকের জন্য এই সংস্থায় জমা পড়ে। তাদের মধ্যে ২৪৬৬ জন কন্যা এবং ১৬৬৪ জন পুত্র। অতএব এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, বেশি সংখ্যক কন্যাসন্তানই দত্তকের জন্য আসে। অথচ কন্যাভ্রুণ হত্যার কারণে প্রতি বছর দেশে যত কন্যাসন্তান জন্মায়, পুত্র জন্মায় তার চেয়ে বেশি। তবু দত্তকের জন্য দেওয়ার সময় কন্যাই বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়! এই পরিসংখ্যান যাচাই করার পর বলতেই হয় যে, হঠাৎ মানুষের চিন্তাধারায় তেমন বদল ঘটেনি। ঘটলে এখনও এত বেশি কন্যা দত্তকের জন্য বিভিন্ন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হত কি?
কন্যাসন্তানের ভালোর জন্য
দত্তক বিষয়ে কলকাতার চিত্রটা তুলে ধরলেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র মুখপাত্র সুনীতা কুমার। তিনি জানালেন, বেশ কিছুদিন তাঁদের হোম থেকে দত্তক দেওয়ার কাজ বন্ধ ছিল। আদালতের রায় অনুযায়ী একক জননী ও ডিভোর্সি মা-বাবাও বাচ্চা দত্তক নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা এই রায়ের সঙ্গে সহমত ছিলেন না বলেই দত্তক দেওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। তবে সিএআরএ-র আধিকর্তার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর তাঁরা আবার দত্তকের কাজ শুরু করেছেন। দত্তকের ক্ষেত্রে কন্যা বনাম পুত্র, কোন দিকে পাল্লা ভারী? এমন প্রশ্ন করলে সুনীতা বলেন, সেইরকম পরিসংখ্যান তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে নেই। তবে কন্যা মানুষ করতে সাহস লাগে। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মেয়েদের। সেই প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে দৃঢ়চেতা, সাবলীল কন্যা মানুষ করা সহজ নয়। ফলে বাবা-মা যদি কন্যা দত্তক নিতে চান, তাহলে সেই চিত্রকে মেয়েদের পক্ষে ইতিবাচক হিসেবেই ধরা উচিত। সাধারণভাবে অবহেলিত কন্যা কোথাও যদি আদৃত হয় ক্ষতি কী?
কী বলছেন নিঃসন্তান দম্পতিরা?
বেঙ্গালুরু নিবাসী সুন্দরম দম্পতির মতে, সন্তানের কোনও লিঙ্গ হয় না। বাবা-মায়ের কাছে পুত্র বা কন্যা সমান আদরের। তাই দত্তক নেওয়ার সময় ‘কন্যা না পুত্র?’, ওই কলামটা ফাঁকাই রেখেছিলেন তাঁরা। তাঁদের কথায়, ‘আমাদের নিজের সন্তান হলে তার ভ্রুণ নির্ণয় করার সুযোগ পেতাম কি? তাহলে দত্তক নেওয়ার সময়ই বা পক্ষপাত করব কেন?’ বরোদা নিবাসী বর্ণমালা ডেভিড ও অজয় লাখেরার কিন্তু স্বপ্নই ছিল কন্যা। বর্ণমালা জানালেন, একজন অনাথ শিশুকে মানুষ করার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। তাই দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কথায়, ‘আমার মনে হয় আমাদের সমাজে মেয়েরা আজও অবহেলিত। পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্রই পুরুষ বেশি মূল্যবান। তাই আমি দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে কন্যাই নিতে চেয়েছিলাম। সেই মতো সিএআরএ-র সাইটে গিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার সময় দেখলাম কন্যাসন্তান দত্তকের জন্য ওয়েটিং লিস্ট পুত্রের চেয়ে বড়!’
সামাজিক বদল ও আধুনিক চিন্তা
‘নিঃসন্তান হলেই যে তাঁরা সন্তান দত্তক নিতে চাইবেন এমন কোনও কথা নেই। সেই সব দম্পতিই সন্তান দত্তক নেন, যাঁদের মধ্যে বাচ্চা মানুষ করার প্রবল ইচ্ছা থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রেখে দেখুন, কন্যাসন্তান মানুষ করার মধ্যে চ্যালেঞ্জ বেশি। আর সেই চ্যালেঞ্জটা নিঃসন্তান দম্পতি নিতে চান বলেই তাঁরা পুত্র অপেক্ষা কন্যাসন্তান দত্তক নিতে পছন্দ করেন।’ এমনই মতামত মনোবিদ রীমা মুখোপাধ্যায়ের। তিনি আরও বলেছেন, দত্তকের ক্ষেত্রে কন্যার কদরের পিছনে সামাজিক বদল ও বাবা-মায়ের আধুনিক চিন্তার একটা ছাপও স্পষ্ট। একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের ‘পরের ঘরের ধন’ হিসেবে মানুষ করা হতো। তখন পিতার সম্পত্তি বা নাম কোনওটাতেই মেয়েদের অধিকার থাকত না। সেই সময় অনেকেই অনায়াসে কন্যাসন্তান দত্তক নিতেন এই ভেবে যে, বিয়ে দিয়ে তাকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দেবেন অতএব সে মেয়ে হলেই বা ক্ষতি কী? কিন্তু এখন আর সেই মনোভাব খাটে না। সমাজ বদলেছে। পিতৃপরিচয়ের ওপর মেয়েদের অধিকার জন্মেছে। পুত্র এবং কন্যা উভয়ই বাবার সম্পত্তির সমান ভাগিদার। সেক্ষেত্রেও যখন দত্তকের জন্য কন্যার কদর করা হচ্ছে, তখন সেটাকে বাবা-মায়ের আধুনিক চিন্তাধারা বলতে হবে বইকি। কন্যাকে সঠিক লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পারলে বাবা-মায়ের বুড়ো বয়সের লাঠি হিসেবে সে কাজ করবে, এমন মনোভাব অনেক দম্পতিই পোষণ করছেন। ফলে অবাধে চলছে কন্যাসন্তান দত্তক নেওয়া।
শেষ কথা
নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের মনে পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা হয়তো এখনও বেশি। তবু দত্তকের ক্ষেত্রে যে চিত্রটা পরিবর্তিত হচ্ছে তা অবশ্যই সামাজিক দিক দিয়ে ইতিবাচক। সিএআরএ-র বক্তব্য, এখন অনেক দম্পতি কালো মেয়েও দত্তক নিতে চান। অনলাইন ফর্ম থেকেই এমন চাহিদা উঠে এসেছে। এ বিষয়ে হায়দরাবাদের এক একক জননী বলেন, নিজের সন্তান হলে তাকে নিজের চাহিদা মতো গড়ে নিতে তিনি পারতেন না। কিন্তু বাছবিচারের সুযোগ যখন পাওয়াই গিয়েছে তখন মনের মতো সন্তান নিতে বাধা কোথায়? সমাজ একটু দেখুক, কালো মেয়ের কদর করতেও এ যুগের মায়েরা দ্বিধাবোধ করেন না।