উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
স্টিয়ারিংয়ের পাঠ
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আজাদ ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি অনেক রকম প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মানসী-মিতু। তারপরে সখার সঙ্গে, গতিধারা প্রকল্পের পিঙ্ক ক্যাবেও হাত পাকানো শুরু হয়ে যায়। ওলা-উবর-এর সঙ্গে চলে পার্ট টাইমও। বুকিং সবসময় না পেলে বসে না থেকে ওলা-উবরের হয়েও চালান ওঁরা। একটু বেশি রোজগারের আশায়। শুধু কলকাতায় আটকে নেই ওঁদের ক্যাবের চাকা। বুকিং পেয়ে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়াও পাড়ি দিয়েছেন মানসী। তাঁর সংসারে লোক কম, তাই তিন-পাঁচ-সাত দিনের বুকিংয়ে যেতে অসুবিধে হয় না। চালাতে চালাতে রাস্তা চেনার পাঠ চলেছে। ভরসা হয়েছে ম্যাপ। দু’বছর হয়ে গেল কমার্শিয়াল ক্যাব চালাচ্ছেন মানসী। মিতু প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বছর তিন আগে। তারপর পিঙ্ক ক্যাব গড়িয়েছে তাঁর হাতেও। প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়েও অনেকের বাঁকা কথা, তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। মিতু একটু অন্তর্মুখী, ভিতু স্বভাবের বলেই পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। তাঁর গাড়ি চালানোর স্বপ্নটা তাই ছেলেমানুষি বলেই মনে করেছিলেন অনেকে। তিনি নিজে ভেবেছিলেন, ‘দেখি না চেষ্টা করে।’ স্বামীর একার ওপরে সংসার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। চার চাকা তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই।
জীবন এখন যেমন
মানসী জানালেন, ‘খুবই দুরবস্থার মধ্যে আছি। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য পেয়েছিলাম বলে লকডাউনের চাপের পরেও বাঁচতে পেরেছি। না হলে দুই ছেলেকে নিয়ে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম!’ ঝড়ে ঘর পড়ে গিয়েছিল। সোনারপুরের পিয়ালির সে বাড়িতে লকডাউন পর্বে থাকলেও পরে চলে এসেছেন যাদবপুরের সুলেখায়। এখন শহর চলতে শুরু করলেও হাতেগোনা বুকিং। নিজেরাও একরকম প্রাণ হাতে করেই বেরতে বাধ্য হচ্ছেন। দু’বেলা দু’মুঠো না জুটলে যে চলবে না। ওলা-উবর চালিয়েও লাভ হচ্ছে না। তেলের দাম এতটাই বেড়েছে যে হাতে টাকা আসছে নামমাত্র। রেশন, ঘর সারানো সবই হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে। একই অবস্থা রাজারহাটের নারায়ণপুরের বাসিন্দা মিতুরও। গাড়ি চালিয়েও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। তাঁর কথায়, ‘ওই সংস্থা পাশে না থাকলে কী করতাম, সত্যিই জানি না। খাওয়াদাওয়া, তেলের খরচ, সংসার চালানো সব কিছু টানার কথা ভাবতেই পারতাম না।’ স্বামী শ্বাসকষ্টে ভোগেন। গত চার মাস ধরে তাঁকে বেরতে দিচ্ছেন না মিতু। সবটা একা হাতে টানতে হিমশিম দশা।
করোনা সাবধানতা
মাস্ক, ফেস শিল্ড, স্যানিটাইজার, ডেটল সবই ওই সংস্থার মাধ্যমে হাতে পেয়ে পথে নেমেছেন ওঁরা। যাত্রীরাও যাতে সুরক্ষার দিকটা মেনে চলেন, সেটাও খেয়াল রাখছেন মানসী-মিতুরা। গাড়িতে যিনিই উঠুন, তাঁকে স্যানিটাইজার দিচ্ছেন। হাসপাতাল বা নার্সিংহোম থেকে অনেক যাত্রী এখন উঠছেন। সেটা বড় উদ্বেগ ওঁদের কাছে। মানসীর কথায়, ‘এমন একজন বয়স্ক মানুষ কিছু দিন আগেই উঠেছিলেন। ওঁকে বলেছিলাম, সেফটির জন্য আপনি যেখানে বসছেন বা আপনার জিনিসপত্র আর পায়ে স্যানিটাইজার দিতে পারি? কিছু মনে করবেন না তো? তিনি বিরক্ত হননি। সুরক্ষার কথা ভেবেই মেনে নিয়েছেন।’ ওই যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে পুরো গাড়ি আবার স্যানিটাইজ করে নিয়েছেন মানসী। বাড়ি ফিরেও একইভাবে সাফসুতরো করছেন নিজেকে। মিতু বললেন, ‘সাবধান তো থাকতেই হচ্ছে। বাড়িতে বয়স্ক লোক, একটা মেয়ে ছ’বছরের। স্বামী অ্যাজমার পেশেন্ট। খুব সতর্ক হয়েই চলছি। জুতো থেকে জামাকাপড় সব বারবার স্যানিটাইজ করছি।’ যাত্রীদের কাছ থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছেন বলেই জানালেন তিনি। কেবল অনেক যাত্রী এসি চালাতে বলছেন, তখন বিনয়ের সঙ্গে ওঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এখন এসি চালানো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভয়টা থাকছেই, মানলেন মিতু। বললেন, ‘বিরাটী থেকে পিজি অবধি গেলাম একদিন। যাত্রী নামিয়ে ঠিক করেছিলাম ওখান থেকে কোনও যাত্রী তুলব না। ফিরে এসেছিলাম। তবে অদ্ভুত কথা, পরের পিক আপ এল বেল ভিউ থেকে। ক্যানসেল করলে আমারই টাকা যাবে। উপায় তো নেই, সাবধান হয়েই চলছি।’
পথের বিপদ
চলতে চলতে ‘ভালো অভিজ্ঞতাই বেশি’, বললেন মানসী। ‘তবে অনেক সময় কোনও যাত্রী পুরো টাকা না দিয়ে চলে গেলেন, কেউ বদমেজাজি, দোরগোড়াতেই নামাতে হবে। অনেকে বলেন, মেয়েরা করছেন ঠিক আছে, তবে ছেলেরা চালালেই ভালো হয়।’ বেশি রাতের ড্রপে অন্যরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে। যেমন মানসী জানালেন, মাঝরাত পেরিয়ে একবার এক যাত্রী উঠেছিলেন। মানসী বুঝতে পেরেছিলেন উনি নেশা করে আছেন। তবে তিনি নিজে থেকেই বলেছিলেন, ‘আমি তো বুকিং করে বুঝিনি মহিলা চালক আসবেন। তাহলে ক্যানসেল করে দেব?’ অত রাতে মানসী যে একটুও ভয় পাননি, তা নয়। আবার কাজ করতে করতে অনেকটা দূর চলে গিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবে বুকিং বাতিল করেননি তিনি। সৌভাগ্যক্রমে সেই যাত্রী কোনও অশালীন আচরণ করেননি। মানসী জানালেন, তবে মা ফ্লাইওভার চেকিংয়ে পুলিস দাঁড় করায়। জানতে চায়, এত রাতে কেন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছি। পুলিসকে বলেছিলাম, ‘এক-আধ দিন রাত হয়ে যায়, অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম আগের ট্রিপে। আপনারা তো আছেন আমাদের নিরাপত্তার জন্য।’ শুনে সেই পুলিস অফিসারই বলেন, ‘আপনাদের স্যালুট জানাই। আপনাদের সাহসের তারিফ করতেই হবে।’ কখনও ধীরে গাড়ি চালানো বা পাশ কাটিয়ে যেতে না পারার জন্য কটু মন্তব্য ভেসে এলেও আজকাল আর গায়ে মাখেন না মিতু। এগিয়ে চলার আনন্দে ওসব তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। কখনও ডায়মন্ড হারবার, বা বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে, কিংবা চুঁচু়ড়া ছুটে চলে যাওয়া তাঁর কাছে এখন জলভাত।
ভরসা থাকুক মহিলাদেরও
এতটা এগিয়ে গেলেও একটা আক্ষেপ তাঁদের এখনও রয়েছে। পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই বেশি আপত্তি করেন তাঁদের ক্যাবে যেতে। মানসী-মিতুদের তেমন ঘটনার মুখে পড়তে হয়েছে একাধিকবার। সেটা ওঁদের কাছে খুবই হতাশার। মানসী বললেন, ‘একবার রাতের দিকে এক মহিলা তাঁর বয়স্কা মাকে তুলে দেন ক্যাবে। কিন্তু আমাকে দেখেই বলে ওঠেন, ও বাবা এ তো মেয়ে ড্রাইভার। ভরসা হয় না। সাবধানে চালিয়ে নিয়ে যাবেন।’ এমন কথা আর একজন মহিলার মুখ থেকেই শুনতে হলে খারাপ লাগে, সন্দেহ নেই। লড়াইটা তাই রোজকার, বোঝালেন মিতুও। তিনি জানালেন, একদিন এক ভদ্রলোক ক্যাব বুক করে গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন। পরে আসেন তাঁর স্ত্রী। তিনি উঠতে গিয়ে তাঁকে দেখেই বলে ওঠেন, ‘ও বাবা লেডিজ কার! আমি যাব না।’ বলেই দরজা ছেড়ে চলে যান। ভদ্রলোক স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘ওঁরা ট্রেনিং নিয়েই গাড়ি চালাচ্ছেন, এসো, এসো।’ ভদ্রমহিলা কিছুতেই রাজি হননি। ভদ্রলোক অপ্রস্তুতে পড়ে মিতুকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি নেননি। অনেক বাধা পেরলেও শেষে মহিলাদেরই আস্থা অর্জনে এত বাধা! মেয়েদের ভরসা হয়ে উঠতে ১০০ ভাগ দিতে সদাই প্রস্তুত মানসী-মিতুরা। মেয়েরা শুনছেন তো?