উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
দিন পনেরো আগে ফেসবুকে প্রথম দেখলাম বিবিদিকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো মাত্র অ্যাকসেপ্ট করলেন। ভাবলাম হয়তো চিনতে পেরেছেন আমাকে। এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডিজাইনারের সঙ্গে আমার আলাপ সম্ভবত ১৯৯৯ সালে। কলকাতায় একটি অসাধারণ ফ্যাশন শো হয়েছিল বিবি রাসেলের। সেই শো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিবিদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের মেকআপ আর্টিস্ট প্রয়াত প্রবীরকুমার দে। তারপর থেকে কলকাতায় এলে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। তবে বছর দশ-বারো কোনও যোগাযোগ ছিল না। যাই হোক মেসেঞ্জারে কথা হচ্ছিল। এই সংক্রমণের সময়ের নতুন ভাবনা নিয়ে বিবি রাসেল আজ হাজির আমাদের পাঠকের দরবারে।
• ফেসবুকে আপনাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আগে তো কখনও আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় দেখিনি?
•• আসলে সময়ই পেতাম না। বিবি’জ প্রোডাকশনের ওয়েব পেজ আমার টিমের ছেলেমেয়েরাই দেখে। আমি তো শহরে বেশি দিন থাকতাম না। আমার কাজ প্রত্যন্ত গ্রামে। ওখানেই আমার তাঁতিভাইরা থাকেন। আমি ওঁদের কাছে থেকে,ওঁদের নিয়ে কাজ করি সারা দিনরাত। ওখানে ইন্টারনেট তেমন কাজ করে না। আর সারাটা দিন কাজের পর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করার ইচ্ছাও হত না। মার্চের মাঝামাঝি থেকে বাড়িতে আটকে রয়েছি। কিছু করতে পারছি না। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় এলাম। যদি আমার শিল্পীভাইদের কোনও সাহায্য করতে পারি।
• আপনি কি অনলাইন ব্যবসায় আসছেন?
•• আসতেই হবে। না হলে আমার দেশের এত দুর্লভ একটা শিল্প হারিয়ে যাবে যে। তাঁতশিল্পীরা খুব কষ্টে আছেন। বিক্রিবাটা নেই, মূলধনের অভাবে নতুন কোনও সৃষ্টিও হচ্ছে না। ওঁরা আমার মুখ চেয়ে বসে আছেন। নানা গ্রাম থেকে ফোন করে আমার খবর নিচ্ছেন। আপনাদের ফুলিয়া নদীয়ার শিল্পীরাও ফোন করে তাঁদের কষ্টের কথা বলছেন। এমনকী রাজস্থান অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও প্রায়ই শিল্পীদের ফোন পাচ্ছি। আমি তো ওঁদের সঙ্গেও কিছু কাজ করি। আমার ওপর ভরসা করেন সবাই। তাই ঠিক করেছি অনলাইন ব্যবসায় আসব। প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি আগস্টেই চালু করতে পারব।
• আপনি নাকি আপনার স্টোর বন্ধ করে দিয়েছেন এই লকডাউনে?
•• আমার একটাই স্টোর ছিল ঢাকা শহরে। বন্ধ করে দিলাম। এই মহামারীর সময়ে তো কেউ দোকানে কেনাকাটা করতে আসবেন না। সকলেই এখন সঙ্কটে রয়েছেন। হাতে টাকা নেই। থাকলেও কেনার মানসিকতা নেই। শুধু শুধু স্টোরের ভাড়া দিতে হত। সেই টাকা আমি আমার তাঁতিভাইদের জন্য খরচ করছি। ওঁরা কষ্টে থাকলে যে আমিও ভালো থাকি না। আমার ছেলেরা, আমার বোনেরা এই কথা হাড়ে হাড়ে জানে। প্যান্ডেমিক শুরুর সময়ে ছেলেরা লন্ডনে ওদের কাছে যাওয়ার কথা বলেছিল। যেতে পারিনি।
• ঢাকায় কি আপনি একা আছেন?
•• আমি একা থাকি বলে খুব সাবধানে আছি। যাঁদের নিয়ে আমি দিনরাত কাজ করি, এমন দুঃসময়ে তাঁদের ফেলে বিদেশে চলে যেতে পারি? হয়তো আমি গ্রামে গ্রামে যেতে পারছি না, কিন্তু এই যে ওঁরা সবসময় আমাকে ফোন করে ওঁদের কষ্টের কথা জানাচ্ছেন, আমি যতটা পারছি সাহায্য করছি, মনে সাহস দিচ্ছি- এতে ওঁরা যেমন ভরসা পাচ্ছেন, আমিও খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছি। ওঁদের ভালো রাখতেই আমি অনলাইন ব্যবসায় আসছি। বলতে পারেন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করছি। স্টোরের সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি আমার অফিসে। অফিসটা বেশ বড়। এটা আমার বাবা আমাকে দিয়ে গিয়েছেন।
• নতুন সময়ের জন্য নতুন কী করছেন?
•• এই সংক্রমণের সময়ে আমাদের এমন শাড়ি, পোশাক পরতে হবে যা বাড়ি ফিরে সাবান জলে কাচা যায়। এমনকী ব্যাগ, পার্স মাথার চুল ঢাকার স্কার্ফ, মাস্ক সব কিছুই ধুয়ে ফেলতে পারলে ভালো হয়। আমি একেবারে নরম তাঁতের মেটিরিয়াল দিয়ে ছেলে-মেয়েদের নানা ধরনের কাটের পোশাক তৈরি করছি। শাড়িও বোনাচ্ছি উজ্জ্বল রঙে। গামছা শিল্পীদের দিয়ে অনেক কাজ করাচ্ছি।
• গামছা উইভ তো আপনার স্পেশাল। ট্রেডমার্ক বলা যায়।
•• (হাসতে হাসতে) বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু গামছা মেটিরিয়াল বেছেছিলাম সকলকে অ্যাফর্ডেবল দামে আরামদায়ক শাড়ি, পোশাক দেব বলে। আমাদের দেশ, আপনাদের দেশে গরম বেশি। আর আমজনতার ক্রয় ক্ষমতা কম। আর দুই দেশেরই গামছায় প্রচুর ভ্যারাইটি আছে। ভারতের অনেক প্রদেশের গামছাশিল্পীদের দিয়ে আমি কাজ করাই। শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামেও অনেক রকম গামছা ব্যবহার হয়। সেগুলোও আমি আমার ডিজাইনে এনেছি।
• মাস্ক থাকছে আপনার নতুন সম্ভারে?
•• অবশ্যই। আমি পথে বেরনোর একটা পুরো ইউনিট তৈরি করছি। বড় ঝোলা ব্যাগ, পার্স, হেড স্কার্ফ, মাস্ক। সব কটনে তৈরি। কাচা যাবে, নষ্ট হবে না। এছাড়া ছেলেদের পাঞ্জাবি, শার্ট, মেয়েদের কুর্তি, কামিজ, লং ড্রেস, স্কার্ট টপ আর নানারকম ডিজাইনের শাড়ি তো থাকবেই। থাকবে গয়না ও ঘর সাজানোর সামগ্রীও।
• এবার একটু পিছনে ফিরি। আপনার ফ্যাশন দুনিয়ায় যাত্রা শুরু কবে?
••(নস্ট্যালজিক সুরে) ১৯৭২ সালে লন্ডন গিয়েছিলাম ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল আমার দেশের তাঁতশিল্পীদের নিয়ে নতুন জগৎ তৈরি করব। আমার দেশের ঐতিহ্যকে বিশ্বের আঙিনায় মেলে ধরব। তার জন্য দরকার ছিল পড়াশোনা। বাবা-মা খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন। আমার ওপর তাঁদের বিশ্বাস ছিল। তাই ওই সময়ে অমন একটা বিষয় পড়তে পাঠিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। বিদেশে প্রচুর মডেলিংও করেছি। কিন্তু ওখানে থেকে যাইনি। আমার লক্ষ্য আমাকে ফিরিয়ে এনেছে দেশের মাটিতে। দেশের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা গড়ে দিয়েছিলেন বাবা।
•অনেক পুরস্কারও তো পেয়েছেন আপনি।
•• দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার পেয়েছি, কিন্তু আমার কাছে সেরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘বেগম রোকেয়া জাতীয় পুরস্কার’। তার থেকেও বড় পুরস্কার দিচ্ছেন আমার তাঁতিভাইরা। এই মহামারীর সময়ে রোজ আপনজনের মতো আমার খোঁজ নিচ্ছেন, নিজেদের দুঃখ আমার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন-এটাই আমার বড় পাওয়া। লড়াই করেই এগতে হয়েছে আমাকে। এই দুঃসময়েও টিকে থাকার লড়াই জারি রেখেছি। যেমন করে হোক বাংলার তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে হবে, শিল্পীদের মুখে তুলে দিতে হবে ক্ষুধার অন্ন। আশা করি বিবি’জ প্রোডাকশনের অনলাইন ব্যবসা আলোর পথ দেখাবে।