উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
শুরুতেই একটু পিছিয়ে যাই বরং। তখনও করোনা ত্রাস আসেনি। বাংলার বুকে যখনই নতুন কোনও ঋতু উঁকি দিয়েছে, তখনই নকশার কারবারিরা নানা ফ্যাশন উইক কিংবা প্রদর্শনীতে সাজিয়ে বসেছেন ঋতু অনুযায়ী নিজস্ব পসরা। কখনও সুতি বা রেশম, কখনও আবার বিয়েবাড়ির জমকালো নকশা। কখনও বা পশমের নানা কেতার সাজগোজ ঠাঁই পেয়েছে তাঁদের বানানো পোশাকে-গয়নায়। নতুন, আরও নতুন কিছু নকশায় ভরে উঠেছে গ্ল্যামার দুনিয়ার গ্রিনরুম।
চিরকেলে চেনা ছবিটা বদলে যাচ্ছিল মার্চের মাঝ বরাবর। ২৪ তারিখের পর থেকেই ফ্যাশন দুনিয়া দেখল এক অন্য পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে মুলতুবি রইল পোশাক-গয়না নিয়ে বাড়তি কোনও আভিজাত্য। অসুখ এড়ানো, অর্থনীতির সঙ্গে লড়াই, সামাজিক দূরত্ববিধি, ঘরবন্দি জীবন। এই চার আবহেই জীবনের মানচিত্রে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সাজগোজের চেনা অঙ্ক। মাস্ক, স্যানিটাইজার, ফেস শিল্ডে মুখ ঢাকা জীবন ঝড়ের মতো এসে দাঁড়াল বেঁচে থাকার রুটিনে। রোজনামচার সব স্তরেই সমীকরণ বদলাতে একপ্রকার বাধ্য হল মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ওষুধ, মাস্ক, স্যানিটাইজার, আর সাবধানতার বাইরে শুধু পড়ে রইল অসুস্থ না হওয়ার ভয় ও শঙ্কা। বাকি সবই যেন বিলাসিতা। সামাজিক দূরত্বের ঘেরাটোপে ততদিনে বাদ পড়েছে লোক-লৌকিকতা, জমায়েতও। এ সবের সঙ্গেই ফ্যাশন নিমেষে হয়ে গেল জীবনের ‘সেকেন্ডারি’ চাহিদা। ক’মাস আগেও যে মঞ্চ আলো, মেক আপ, পোশাক, গয়না, দর্শকে গমগম করে উঠত, সে মঞ্চ হয়ে পড়ল শূন্য। বন্ধ ফ্যাশন শো। বাতিল ফ্যাশন উইক।
তাহলে কি পোশাক-গয়নার নকশার দুনিয়া আগামী কয়েক বছর থেমে গেল এখানেই? নাকি অনলাইনে আর পাঁচটা পেশার মতোই ফ্যাশনও খুঁজতে পারে কোভিড পরবর্তী মঞ্চ?
শিল্পী ও পোশাকের আঁকাআঁকিতে অভ্যস্ত ইলিনা বণিক কিন্তু মনে করেন কোভিড যুগে অনলাইনেও বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে ফ্যাশন দুনিয়াকে। জনসমারোহে হওয়া ফ্যাশন শো, ফ্যাশন উইকগুলোকে কোনও ভাবে অনলাইনে আনলে, এই সময়েও ফ্যাশন দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিল্পী, মডেল, ফোটোগ্রাফার, প্রসাধনশিল্পী কেউই কর্মহীন হয়ে পড়েন না। ইলিনার মতে, ‘এই পরিস্থিতিতে পেটের খাবার জোগান ও অসুখের সঙ্গে লড়াই করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। তবে ফ্যাশনও তো আরও অনেকের পেশা, পেটের খাবার। তাই এই ক্ষেত্র যদি অনলাইনে আসে মন্দ কী? ফ্যাশন উইকের মতো সমারোহ হয়তো সেখানে সম্ভব নয়। কিন্তু খুব সাবধানে, সব নিয়ম মেনে, ন্যূনতম লোকজন নিয়ে যদি কোথাও কোনও ফ্যাশন উইক বা ফ্যাশন শো উপস্থাপন করার কথা ভাবেন ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এফডিসিআই) তাহলে অবশ্যই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই অনেকটা উপকার হবে।’
তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পুরো ফ্যাশন উইককে তুলে আনা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেন বিভিন্ন ফ্যাশন উইকে অভিজ্ঞ মডেল দিতি সাহা। এই বঙ্গললনার কেরিয়ারে যুক্ত দেশ-বিদেশের নানা ফ্যাশন উইক। নানা ব্র্যান্ডের মুখ হয়ে ওঠা দিতি যদিও নিয়ম ও সাবধানতা মেনে কিছু ফ্যাশন শ্যুট শুরু করেছেন। তবে তিনি মনে করেন, ফ্যাশন উইকের মতো জমকালো বিষয়কে অনলাইনে বেঁধে ফেলার কিছু সমস্যাও আছে। তাঁর মতে, ‘একটা ফ্যাশন উইক মানেই অনেক লোকজন, আলো, ক্যামেরা, পার্টি, মেক আপ, কর্পোরেট আলাপচারিতা, মিটিং, দর্শক— এককথায় একেবারে হইহই ব্যাপার। পুরো বিষয়টা থেকে লোক কমিয়ে এনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তা অনলাইনে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু যদি বিকল্প পথ হিেসবে কোনও সংস্থা এমনটা ভাবতে পারেন, তা হলে মন্দ হয় না। তবে এখন চারপাশের যা পরিস্থিতি, তাতে সত্যিই এই ফ্যাশন উইকের মতো বৈভব এতটা অপরিহার্য এখনই নয়।’
অপরিহার্য হোক বা না হোক, যে কোনও মাধ্যমকে বেঁচে থাকতে হলে যুগ ও সময়ের হাত ধরেই টিকে থাকতে হয়। এ কথা বিলক্ষণ বোঝেন ডিজাইনাররাও। তাই সারা পৃথিবীতেই কোভিড পরবর্তী ফ্যাশন ট্রেন্ডে উঠে আসছে নয়া নয়া কনসেপ্ট। যার মধ্যমণি অবশ্যই মাস্ক। করোনা ঠেকাতে এই হাতিয়ার যেহেতু আগামী কয়েক বছর আমাদের সঙ্গী, তাই ফ্যাশন ট্রেন্ডেও উঠে আসছে তা। এমনকি, বিয়ের বেনারসির নকশার সঙ্গেও ভেবে রাখতে হচ্ছে বর-কনের মুখের মাস্কের নকশা!
এই যেমন অগ্নিমিত্রা পল। নিজের স্কেচবুকে ইতিমধ্যেই এঁকে ফেলেছেন নানাবিধ মাস্কের নকশা। ডিজাইন অনুযায়ী তাদের নামও দিয়েছেন তিনি। ফ্রিডা, আন্দ্রে ও মর্জিনা। সাজপোশাকের দুনিয়ায় এই নতুন তিন মাস্ক দিয়েই কোভিড পরবর্তী বাজারে তাক লাগাতে চান অগ্নিমিত্রা। শুধু তাই-ই নয়, মাস্কের সঙ্গে ফেস শিল্ড, হেড গার্ডকেও জুড়ে কিছু নকশা বানাচ্ছেন তিনি। অগ্নিমিত্রা মানেন, যেখানে বেঁচে থাকার প্রশ্ন প্রথম, সেখানে ফ্যাশন চলে যায় পরের সারিতে। তাই এই মুহূর্তে ফ্যাশন দুনিয়ায় কেনাকাটায় ভাটা যে আছে, তা স্বীকার করেন। তাঁর অভিমত, ‘যে কোনও পোশাক কেনার সময় ‘টাচ’ বা স্পর্শ একটা বড় বিষয়। অনলাইনে পোশাক চোখে দেখে কেনায় সেই স্পর্শই অনুপস্থিত থাকে। তাই ফ্যাশনে যতই অনলাইন কেনাকাটার বিকল্প খোলা থাকুক না কেন, ওতে ঠিক মনে ভরে না। পোশাকের নকশা, জরিসুতো, ফ্যাব্রিক সবটাই হাতে ধরে দেখা একটা বড় ফ্যাক্টর। এ ছাড়া যে কোনও অনুষ্ঠানের সময় দলবেঁধে কিনতে আসাতেও একটা আলাদা আনন্দ থাকে। সেটা বাদ দিলে পছন্দের বেলাতেও কিছুটা আপসের পথে হাঁটতে হয় বইকি!’
ছুঁয়ে দেখা, পরখ করার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন ঋতু কুমারের মতো ডিজাইনারের টিমও। কোভিডের সময় যে এই ছুঁয়ে দেখার বা অনুভব করার উপায় নেই! সম্ভব নয় হাজির থেকে মাপজোক দেওয়াও। নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে ফ্যাশনের বাজার যে বেশ কিছুটা নিম্নমুখী, তা মানেন তাঁরাও। তবে এঁরাও কোভিড পরবর্তী যুগে মাস্ককে নতুন ভাবে উপস্থাপন করতে চান। কিছু ক্ষেত্রে ফেস শিল্ড, হেড গার্ড নিয়েও কাজ করছেন নানা ডিজাইনার। বিয়ের পোশাকে বর-কনে দু’পক্ষের জন্যই মাস্ক বানানোর কথা ভাবছেন কলকাতার আর এক ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক নাইয়া।
কোভিড পরবর্তী সময়ে ফ্যাশন ট্রেন্ডে যে রোগ প্রতিরোধের হাতিয়ারগুলোই উঠে আসবে, তা বিশ্বাস করেন ফ্যাশন উইকের এক অত্যন্ত পরিচিত মুখ শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ইদানীং কিছু ফ্যাশন শ্যুট শুরু হলেও যে কোনও ফ্যাশন উইক বা বড় কোনও ফ্যাশন শো এখনই যে সম্ভব নয় তা বোঝেন তিনি। অসম্ভব ফ্যাশন উইকে কোনও ব্র্যান্ডের েপ্রামোশনও। বরং রোগের সঙ্গে লড়তে ফ্যাশন শোয়ের পোশাক ব্যবহারেও মুম্বইয়ে বেশ কিছু কড়া নিয়ম জারি হয়েছে। আগে স্টাইলিস্টরা নানা ধরনের পোশাক এনে হাজির করতেন মডেলদের সামনে। তার মধ্যে মানানসই পোশাকে কাকে কেমন দেখাচ্ছে, তা বুঝে নিয়েই চূড়ান্ত পোশাক নির্বাচন হতো। ফ্যাশনের এই চিরকেলে চেনা অভ্যাসও ছক ভেঙেছে রোগের সামনে। এখন আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে কোন পোশাক কে পরবেন। খুব যত্নে, এতটুকু না ছুঁয়ে সেই পোশাক হাজির করতে হবে মডেলের সামনে। যাঁর পোশাক, একমাত্র তিনিই তা ছুঁতে পারবেন। একে তো বন্ধ নানা ইভেন্ট। শো-এর দেখা পাওয়াও দুষ্কর। কমেছে বিকিকিনিও। এই অবস্থায় সচেতনতা বজায় রাখার নিয়ম মানতে গিয়ে আনুষঙ্গিক খরচও বাড়ছে বিস্তর। সে সব সামলে ফ্যাশন দুনিয়া তাই এখনও নিজের চেনা স্রোত পাচ্ছে না। কবে পাবে তা-ও অজানা।
তবে রোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ে অভ্যস্ত আমাদের মন ও মানসিকতা দিনের শেষে মানুষকেই জিততে দেখতে চায়। ফ্যাশন-সচেতন মানুষ আজও স্বপ্ন দেখে, কোভিড শেষ হয়ে এক ঝলমলে আলোর রোশনাইতে ভেসে যাচ্ছে মডেলদের প্ল্যাটফর্ম। ভিড় করে থাকা দর্শকদের সামনেই ক্যামেরা, মেক আপ আর পোশাকের চাকচিক্যে র্যাম্প মাতাচ্ছেন দিতি, শুভমিতা, স্নেহারা। দুঃসময় কেটে আলোর পথে হাঁটা দেশে এমন স্বপ্ন কিন্তু সুদূরের হলেও লোভনীয়!
আর কার তাতে কী, কেউ যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখেন?
শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
মর্জিনা মাস্ক: অগ্নিমিত্রা পল