উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
রথের দিন দেবীর কাঠামো পুজো দিয়ে সূচনা হয় আমাদের বাত্সরিক আনন্দ উৎসবের। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি শরতের এই পাঁচটা আনন্দ দিনের জন্য। শুধু কলকাতা নয়, পুরো বাংলা জুড়ে যেন আনন্দের বন্যা। আর তার তোড়জোড় শুরু হয় চার মাস আগে থেকেই। বাংলার তাঁতশিল্পীরা, ডিজাইনাররা পুজোর নকশা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেন নববর্ষ থেকে। বহু বছর ধরে চলে আসা এই ট্র্যাডিশনে ভাঙন ধরাল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ। পুজো কীভাবে হবে, বা আদৌ কোনও বড় বারোয়ারি পুজো হবে কি না, কিছুই জানা নেই আমাদের। তার ওপর মহামারীর আতঙ্কে আমাদের কাজে উত্সাহ নেই, মনে উদ্যম নেই। এমন দোলাচল চিত্তে কি শিল্পী প্রাণ ঢেলে দিতে পারেন সৃষ্টিতে?
স্বাস্থ্য আসুক সৃষ্টিতে
জীবন তো থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে আপন খেয়ালে। তাই আমাদেরও থেমে থাকলে চলবে না। বরং এমন কিছু করতে হবে যা মানুষের কাজে লাগে। এই সংক্রমণের সময়ে যেন সে সঠিক প্রোটেকশন পায়— বললেন ডিজাইনার অভিষেক দত্ত। তাই তাঁর নতুন কালেকশনের ফ্যাব্রিক টেফলন আর অ্যান্টিভাইরাস কোটিংয়ে তৈরি। এই কোটিং শাড়ি বা পোশাক বারবার ওয়াশ করলেও নষ্ট হবে না। খুব দামি শাড়ি বা ড্রেস এবার করবেন না অভিষেক। মেয়েদের কুর্তি, কামিজ, ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ড্রেস, ছেলেদের কুর্তা, জ্যাকেট করছেন খাদি, হ্যান্ডলুম ও চান্দেরি মেটিরিয়ালে। কারিগরদের ওয়ার্কশপে থেকে কাজ করতে অনুরোধ করেছেন। তাঁরা তা মেনেই কাজ করছেন। প্রত্যেকটি ড্রেস বা শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মাস্ক থাকছে। ছেলেদের জ্যাকেটের সঙ্গে ইন্টারেস্টিং ডিজাইনের মাস্ক অভিষেকের পুজো স্পেশাল।
বেনারসের বাসওয়ারা তসর কলকাতায়
ডিজাইনার লালিয়া দত্তগুপ্ত বললেন, এই মাস থেকে তাঁর স্টোর সংস্কৃতি খুলে গিয়েছে। সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিকিকিনি চলছে। এবার যা পরিস্থিতি তাতে খুব দামি সিল্ক বা খুব কারুকাজ করা হেভি শাড়ি তৈরি করার মানে হয় না। পুজোতে সকলেই এই ধরনের দামি শাড়ি কিনতে চাইতেন, কিন্তু এই বছর সেই মানসিকতাই নেই। তাই বেনারসের তাঁতশিল্পীদের বোনা এক ধরনের মিক্সড তসর এবার আনছেন লালিয়া। র-তসর আর কটনের মিশেলে তৈরি এই মেটিরিয়াল দেখতে জমকালো কিন্তু দাম বেশ কম। এছাড়াও মেয়েদের একটু অন্যরকম কাটের কুর্তি, স্মার্ট লুক ড্রেসও রয়েছে যা ডেলিওয়্যার হিসেবে ভালো। পুজোয় বাঙালি ছেলেদের ধুতি পাঞ্জাবি চাই-ই।
এবার পুজো কেমন কাটবে কেউ জানেন না। তবু অনেকেই পাঞ্জাবির খোঁজ করছেন। এক্ষেত্রেও খুব দামি সিল্ক তসরে না গিয়ে কটন ফ্যাব্রিক দিয়ে নতুন ডিজাইনের কুর্তা ও ম্যাচিং ধুতি তৈরি করছেন তিনি। সঙ্গে থাকছে ইক্কত বা কলমকারি জহরকোট।
গোলাপির শেডে আনন্দ সন্ধান
অন্যান্যবার পুজোর চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই আমার ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। বেনারস, বেঙ্গালুরু ঘুরে শাড়ি আনি। ডিজাইন করি, কারিগরদের কাজে বসাই। এবার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পুজো পুজো গন্ধ নেই বাতাসে। শুধু ভয় আর আতঙ্ক। মুক্তি পেতে হাত বাড়িয়েছি গোলাপের রঙে। গাঢ় গোলাপি, হালকা গোলাপি, কমলাটে গোলাপি, রানি রং, লাল নিয়ে কাজ করছি। আমার মনে হয় গোলাপি আমাদের মন চাঙ্গা করে দেবে। প্রতি বছরের মতো জাঁকজমক করে পুজো না-ই বা হল, তবু মাতৃ আরাধনার দিনগুলোয় নতুন শাড়ি তো পরতেই হবে। বেনারস থেকে আমার নিজস্ব উইভারকে দিয়ে বুনিয়েছি খাডডি বেনারসি। সঙ্গে একটা ডিজাইনার ব্লাউজ হলেই সাজ কমপ্লিট। দামও খুব বেশি নয়, ছ’ হাজার টাকা— বললেন ডিজাইনার সোমা ভট্টাচার্য। এছাড়াও সোমা বাংলার তাঁতশিল্পীদের দিয়ে বেশ কিছু হ্যান্ডলুম শাড়ি বুনিয়েছেন। লং-লেন্থ আনারকলি, ডিজাইনার কুর্তিও তাঁর স্পেশাল আইটেম।
ইন্দো-ওয়েস্টার্ন শাড়িতে খুশির মেজাজ
ডিজাইনার ইরানি মিত্র কলকাতার ফ্যাশন আঙিনায় প্রথম এনেছেন ইন্দো-ওয়েস্টার্ন শাড়ি, রেডি টু ওয়ার শাড়ি। দীর্ঘ চার মাস নতুন কোনও কাজ করতে পারেননি। তবে মনখারাপের দাওয়াই হিসেবে অনলাইনে নানান অনুষ্ঠান করে চলেছেন। তাঁর অনলাইন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা ‘আমি বন্দি সুন্দর’ ফ্যাশন দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছে। এই মুহূর্তে ছোটদের নিয়ে একটা অনলাইন প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি হাত দিয়েছেন নতুন ডিজাইনে। ইরানিও জানালেন, এবার খুব দামি কোনও শাড়ি বা পোশাক তৈরি করবেন না। এমন মেটিরিয়াল ব্যবহার করবেন, যাতে বারবার কাচলেও নষ্ট হয়ে না যায়। ইন্দো-ওয়েস্টার্ন শাড়ি শুধু ইয়ং জেনারেশনই নয়, সব বয়সের সব ধরনের মেয়েই পছন্দ করছেন। ফিগার, প্রফেশন, বয়স অনুযায়ী কাস্টমাইজ করেন ইরানি। লং স্কার্ট, ওয়ান পিস ড্রেস, স্মার্ট লেহেঙ্গা, অফবিট কুর্তি, ছেলেদের জন্য ক্যাজুয়াল পাঞ্জাবি, সব আছে তাঁর স্টুডিওতে। বাঁকুড়া বীরভূমের গামছা, লুঙ্গি
নিয়েও অনেকরকম ডিজাইন করছেন। আছে ফ্রিলের জাদুও।
স্ট্রাইপে পুজোর আবাহন
ডিজাইনার প্রণয় বৈদ্যর তৈরি জমকালো শাড়ি আর লেহেঙ্গার খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পড়ি দিয়েছে বিদেশেও। প্রতি পুজোয় প্রণয় জরি জারদৌজি ব্রোকেড আর বেনারসের চান্দেরি নিয়ে মনের সুখে কাজ করেন। বঙ্গললনাদের তা মনেও ধরে। এবার এই সংক্রমণের পরিবেশের সঙ্গে অমন ঝকঝকে শাড়ি কি মানায়? — একটু ক্লান্ত স্বরে বললেন প্রণয়। তাই হালকা ফ্যাব্রিক আর একটু সাবডিউড কালার প্যালেটে তৈরি করছি নতুন কালেকশন। স্মার্ট ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্ট্রাইপস, গ্রে আন্ড ব্ল্যাক চেকসও রয়েছে। বলতে পারেন এটাই এবারের পুজো কালেকশন।
দ্বিধায় দুলছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি
একদিকে অর্থনৈতিক মন্দা, অন্যদিকে মহামারী আতঙ্ক ঘুম কেড়েছে মানুষের। ক্রেতার যেমন মন জুড়ে অবসাদ, ডিজাইনারদেরও অনেক অসুবিধে। ট্রেন বন্ধ, তাই কারিগরেরা আসা-যাওয়া করতে পারছেন না। একজন ডিজাইনার কারিগরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন সিল্ক আর তসর কাঁথাকাজের জন্য। কিন্তু সেই শিল্পী সপরিবারে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এমন হাজার অসুবিধের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডিজাইনাররা টাকা ইনভেস্ট করতে দ্বিধা বোধ করছেন। তবে এখনও তো মাস তিনেক সময় আছে হাতে। এটুকুই ভরসা।