শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
কিন্তু, তারপর জঙ্গি দমন অভিযানের আর কোনও জোরালো খবর সংবাদমাধ্যমে না আসায় সাধারণ মানুষ যেন কিছুটা হতাশ এবং আশাহত! অন্তত, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে গত কয়েকদিন নানা সময়ে কথা বলে এমনটাই মনে হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ ভাবছেন, কটা জঙ্গি নিকেশ করেই সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন যা চলছে তা কূটনৈতিক পর্যায়ে চিরাচরিত বাক্যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিবেশী পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার অভিযান। কারণ, পাকিস্তান এইসব জঙ্গির অন্যতম প্রধান আশ্রয়স্থল বলে বহু পুরনো একটা অভিযোগ আজও সমান সক্রিয় ও সতেজ। সেক্ষেত্রে ভারত যে ইতিমধ্যে বেশ সফলও হয়েছে তা সংবাদমাধ্যম মারফত জেনে দেশজনতা খুশি কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ জওয়ানের অমন মর্মান্তিক মৃত্যুর বদলায় এটুকু সাফল্য তাঁদের সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট করতে পারছে না। তাঁরা চাইছেন আরও বড় প্রত্যাঘাত, আরও বড় শাস্তি!
অবশ্য, কেউ কেউ আবার ভাবছেন—সেনা অনেক বড় ও ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু গোটা ঘটনাটা টপ সিক্রেট। তাই সাধারণ জনতা কিছু জানতে পারছে না। তবে, ভারতের সেই চাপের দাপটেই পাকিস্তানের ইমরান সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে এবং জয়েশ সমেত যে জঙ্গি সংগঠনগুলো আছে সেগুলোকে সতর্কবার্তাও পাঠাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম প্রচারিত এই সংবাদে সেনা অভিযান সম্পর্কিত তাঁদের ধারণা যেন আরও দৃঢ় হয়ে উঠছে। সেই সুবাদে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিগুলির ওপর বড় প্রত্যাঘাত ও জঙ্গিদের বড় শাস্তির প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা যেন অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাঁদের মনে মনে।
কিন্তু, দেশের যে বীর জওয়ানেরা অনন্তপোড়ায় শহিদ হলেন, যাঁরা চিরকালের জন্য স্বাভাবিক জীবন ছন্দ হারিয়ে বেঁচে রইলেন—তাঁদের পরিবার পরিজন আজ কেমন আছেন? তার খবরও কি আর খুব বেশি দিন খুব বিশদে মিলবে? ঘটনার পর দেশ জুড়ে দেশপ্রেমের যে আবেগ উঠেছে সেনা ও তাঁদের পরিবারের সুরক্ষায় আরও বেশি সরকারি দৃষ্টির যে দাবি উঠেছে—তা নিয়েও কি আজ অব্দি কোনও বড় সিদ্ধান্ত হল? পুলওয়ামায় ওই বিপুল সংখ্যক সেনাকে কেন সড়কপথে জম্মু থেকে শ্রীনগর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কেন জাতীয় সড়কে তখন যে লেনে সেনা কনভয় তার পাশের লেনটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে রাখা হয়েছিল, কেন সেনা কনভয় যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা হল না, আর যদি হয়ে থাকে তবে বিস্ফোরক বোঝাই ওই গাড়ি নিয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি কী করে কনভয়ে পৌঁছল, কী করেই বা অন্য আরও জঙ্গিরা গুলি চালিয়ে রকেট ছুঁড়ে সেনাদের শহিদ করে নির্বিবাদে এলাকা ছেড়ে পালাতে পারল? পুলওয়ামার পর এমন অজস্র প্রশ্ন ওঠেনি কি? কিন্তু, এর কটার উত্তর আমরা আজ পর্যন্ত পেয়েছি? দেশের সরকারের তরফ থেকে বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কতটুকু জবাব মিলেছে? কদিন আগে সেনাপ্রধান বলেছেন, কাশ্মীরে জঙ্গি কাজে যুক্তরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু হাতে অস্ত্র নিয়ে জঙ্গি কাজে নামলে রেয়াত করবে না সেনা! ঠিকই বলেছেন হয়তো। কিন্তু, এই নিদান দিয়ে কি জঙ্গি মুক্ত করা যাবে ভূস্বর্গ?
জানি না। এর সঠিক জবাব কবে মিলবে, আদৌ কোনও দিন মিলবে কি না তাও জানা নেই। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে এমন অনেক নিদান এসেছে কিন্তু সেসব সাময়িক কিছু ফল ফলালেও দিনের শেষে সমস্যা থেকেই গেছে এবং পরবর্তীতে সেসব আরও জটিল, আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আর কাশ্মীরের সেই বাড়বাড়ন্ত সমস্যা নিয়ে ভোটবাজারে ফায়দা তোলার চেষ্টায় সক্রিয় থেকেছে রাজনীতি। আজও কি তার খুব ব্যতিক্রম হচ্ছে? পুলওয়ামার ভয়াবহ ঘটনার পর দেশের শাসকদলের মন্ত্রী নেতাদের কথায়, মন্তব্যে দেশাত্মবোধের জয়গানের পাশাপাশি যা উঠে এসেছে, প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে মনোভাবনার যে আভাস প্রকাশ পেয়েছে, এমনকী এই রাজ্যে নিরীহ কাশ্মীরিদের কয়েকজনের প্রতি (যাঁদের মধ্যে একজন ডাক্তারও আছেন) যে অসভ্য আচরণ করা হয়েছে—তার পিছনে রাজনীতি নেই বলছেন? গায়ের জোরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে সন্দেহ জাগানোর চেষ্টা নেই? আমাদের পরম সৌভাগ্য—এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কঠোর অনুশাসনে বিভেদকামীদের অনিষ্ট করার চেষ্টা বেশি দূর এগতে পারেনি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জলও গড়াতে পারেনি।
কিন্তু অন্যত্র? দেশের গেরুয়া-শাসিত রাজ্যগুলোতে— সেখানে সব ঠিকঠাক আছে তো? যতদূর খবর—সব ঠিকঠাক নেই। তবে, দেশের মানুষের সচেতনতা এখন অনেক বেড়েছে, এটাই ভরসা। চার-দশটা জঙ্গি নরকের কীটের জন্য গোটা দেশের মানুষকে অপরাধী করা যে ন্যায়সঙ্গত নয়, কোনও প্রমাণ ছাড়া কেবল অতীত অভিজ্ঞতায় ভর করে প্রতিবেশীর প্রতি শত্রুভাব জাগিয়ে তোলাটা যে যুক্তিসম্মত হয় না—সেটা রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ উপেক্ষা করে গেলেও দেশের মানুষ বোঝেন। খুব ভালোভাবেই বোঝেন—এসবের পিছনে ভোটের মুখে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। সুতরাং, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা ও শহিদ জওয়ানদের নিয়ে দেশবাসী ক্ষোভে আবেগে ভেসে গেলেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তাঁরা দূরেই রাখবেন এবং রেখেছেনও। কোথায় কতটা রেখেছেন জানি না, তবে পশ্চিমবঙ্গে রেখেছেন, একশো শতাংশ রেখেছেন। মানুষজনের সঙ্গে কথা বললেই তা বোঝা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক দিক থেকে এই অগ্রগতিটুকু কিন্তু আমাদের বাংলায় ঘটেছে। সত্যি বলতে কী এই অগ্রগতির জন্যও কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেই সাধুবাদ জানাতে হয়। এ যে তাঁর সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ-সম্প্রীতি রক্ষার নীতি এবং তা অক্ষরে অক্ষরে রূপায়ণেরই সুফল, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুলওয়ামার পর এমন নানা ঘটনা আবেগ ক্ষোভ শোক ধিক্কার সেনা অভিযান জঙ্গি নিকেশ সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কাণ্ড নিরীহজনের ওপর হামলা শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক তরজা—কত কিছুই না ঘটল। কিন্তু, এর মধ্যেই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে ঘটনাটিকে সামনে আনা হল তাতে আমাদের মতো দেশেরও বিস্ময় বোধহয় সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল! পুলওয়ামা হামলার সময় ও তার পরেও কিছুক্ষণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথ্যচিত্রের ‘শ্যুটিং’-এ ব্যস্ত ছিলেন! নৈনিতালের করবেট ন্যাশনাল পার্কের অতিথিশালায় বিশ্রাম নিয়েছেন! এমনও সম্ভব! কাপুরুষ জঙ্গিদের চোরা হামলায় অতগুলো তাজা প্রাণ বীর শহিদের রক্তে যখন ভূস্বর্গে নেমে এসেছে মর্মান্তিক মর্মস্পর্শিতা, টিভিতে চোখ রেখে বাক্রুদ্ধ গোটা দেশ, সব কাজ ফেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নেমে পড়েছেন দেশ-রাজ্যে সাম্প্রদায়িক শান্তি আমন বজায় রাখার কাজে— তখন দেশের সর্বময় কর্তা দেশের অভিভাবক শ্যুটিং করছেন, শ্যুটিংয়ের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন—এটা ভাবা যায়!
কংগ্রেস হয়তো ভোট রাজনীতির স্বার্থেই ঘটনাটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করেছে। কিন্তু মূল ঘটনাটা তো ঘটেছে। না হলে নিশ্চয়ই কড়া প্রতিবাদ আসত শাসক শিবির থেকে। এসেছে কি? নিঃসন্দেহে ওই শ্যুটিং পূর্ব নির্ধারিত ছিল। কিন্তু পুলওয়ামার পর তো সেটা বাতিল হওয়ার কথা। অমন মারাত্মক ঘটনা জানার পর নিশ্চয়ই মোদিজি ওই তথ্যচিত্রের শ্যুটিং করে ভোটের মুখে অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেন না!
তাহলে কি তাঁকে ঘটনার কথা সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয় না? বিতর্ক ছড়িয়েছে তা নিয়েও। কিন্তু, সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন পারিষদ যাঁরা ঘটনা জেনে তার অপরিসীম গুরুত্ব বুঝেও শ্যুটিংরত প্রধানমন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখেছিলেন—তাঁদের কী হয়েছে? আমরা জানি না। কিন্তু, এটা বুঝি— পুলওয়ামার পর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায়, দেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রচেষ্টায় এবং তড়িঘড়ি প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দ্রুততায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনেকটাই ছাপিয়ে গেলেন।