শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
আসছেন নরেন্দ্র মোদি। আসছেন অমিত শাহ। আসছেন রাজনাথ সিং। আসছেন যোগী আদিত্যনাথ। আসছেন শিবরাজ সিং চৌহান। যাচ্ছেন ঠাকুরনগরে। যাচ্ছেন দুর্গাপুরে, যাচ্ছেন বর্ধমানে। যাচ্ছেন কোচবিহারে। যাচ্ছেন পুরুলিয়ায়। সকলেরই টার্গেট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লি থেকে মোদি সরকারের তাবৎ মন্ত্রিসভা আসছে নিয়ম করে পশ্চিমবঙ্গে। কারণ লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ দখল। এই তো সেদিন তখন রাজীবকুমার এবং সিবিআইকে নিয়ে বিতর্ক সবেমাত্র শুরু হয়েছে। পরদিনই দিল্লি থেকে কলকাতায় বিজেপি সদর দপ্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করতে কে চলে এলেন? দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর। বিজেপির কোনও রাজ্য নেতাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হল না কিন্তু। তিনি কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে মমতাকে কটাক্ষ করে বললেন, কেন সিবিআইকে এত ভয়? লোকসভায় স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিবৃতি দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক সংকটের সূত্রপাত হয়েছে। দিল্লির বিজেপি দপ্তরে আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ কিংবা বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। সকলেই মমতাকে চরম আক্রমণ করে বললেন, মমতা ভয় পেয়েছেন। দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নির্বাচন কমিশনে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে। এই যে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এভাবে নিজেদের গোটা ফোর্স নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে নেমে গেলেন সেটা আসলে কী বার্তা দেয়? মমতাকে হারাতে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—সকলকেই ময়দানে নামতে হচ্ছে। সেটাই প্রমাণ করে তাঁরাই মমতার গুরুত্ব বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিলেন। এই যে কথায় কথায় এঁরা রাজ্যে চলে আসছেন, এর অন্তর্নিহিত বার্তা কি এটাই নয় যে বিজেপি শীর্ষ নেতারাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন আসলে রাজ্য বিজেপি নেতারা মমতার বিরুদ্ধে লড়ার পক্ষে যথেষ্ট যোগ্য নয়? এভাবে বারংবার যখন তখন ছোটখাটো বিষয়েও মমতাকে আক্রমণ করার জন্য কলকাতায় কেন্দ্রীয় নেতাদের আসা কিংবা মফস্সলের সভাতেও জাতীয় নেতাদের আগমনের অর্থ তো এটাই যে বিজেপি নেতৃত্ব মনে করে, একজনও এমন কোনও রাজ্য বিজেপি নেতা নেই যাঁকে সামনে রেখে মমতা বিরোধী আক্রমণ করলে জনতা সিরিয়াসলি গুরুত্ব দেবে। তাই দরকার পড়ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। এর ফলে সবথেকে ক্ষতি কার হচ্ছে? রাজ্য বিজেপির। কারণ তাঁদের নিয়ে জনতা আর আলোচনাই করছে না। মমতাকে মারাত্মক আক্রমণ করে রীতিমতো ব্যাকফুটে ফেলে দিচ্ছেন মোদি, অমিত শাহ, যোগী ইত্যাদি ইত্যাদি। আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কেউ রাজ্য নেতাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এটা বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষে কি খুব স্বস্তিদায়ক?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবথেকে বড় রাজনৈতিক কুশলতা হল তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাঁর বিরোধী দলগুলির রাজ্য নেতৃত্বকে রীতিমতো গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তাঁকে কখনও দেখা যায় না কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপির রাজ্যস্তরের নেতাদের কোনওরকম আক্রমণের জবাব দিতে। তিনি শুধু পাল্টা জবাব দেন ওইসব দলের দিল্লির নেতাদের বিবৃতির। বিরোধী রাজ্য নেতাদের যে কোনওরকম আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য তাঁর দলের মেজ সেজ মুখপাত্ররাই যথেষ্ট, এরকমই একটি বার্তা দেন। মমতাকে টাইট দেওয়ার জন্য যতরকম তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ করা হয় তার সবই করেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রিমিয়ার লিগের খেলাটা ওই মমতা বনাম মোদির মধ্যে হয়। বিরোধীদের রাজ্য নেতৃত্ব নেহাত সেকেন্ড ডিভিশনের লিগের মতো গুসকরা কিংবা আমতা অথবা বিষ্ণুপুরের মতো ছোট ময়দানে ছোট জনসভা, পথসভার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। মমতা একাই ব্রিগেড করেন। একাই ২১ জুলাই করেন। কংগ্রেস, বিজেপিকে ব্রিগেড করার আগে দশবার ভাবতে হয় কেন? কারণ তাঁরা জানেন রাহুল গান্ধী কিংবা নরেন্দ্র মোদি না এলে ব্রিগেড করার রিস্ক আছে। সিপিএম এখানে প্রশ্ন তুলতে পারে আমরা তো একাই ব্রিগেড করি? সেখানে মারাত্মক ভিড়ও হয়। ঠিক। আর এই প্রশ্নটির পাল্টা একটি জিজ্ঞাস্য আছে। সেটি হল, তাহলে মমতাকে হারাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার জন্য এত উদগ্রীব কেন আপনারা? এই যে ব্রিগেডে এত ভিড় হল এবং আপনারা মমতাকে কঠিন চ্যালেঞ্জ দিতে পারেন সেটা যদি প্রমাণিতই হয়ে যায়, তাহলে মমতার বিরুদ্ধে একাই লড়ুন। সেটাই তো আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ, তাই না? কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? কংগ্রেসের সঙ্গে যদি সিপিএম আবার জোট করে, তাহলে তো স্বীকার করে নেওয়া হল একা আর কোনও দল মমতাকে হারাতে পারবে না, নিজেরাই ধরে নিয়েছে দুই দল। অর্থাৎ এভাবে নিজেরাই নিজেদের দুর্বলতা আর মমতার শক্তির ক্রমাগত বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে বিরোধীরা।
এবং কংগ্রেস! প্রদেশ কংগ্রেস যদি মনে করে মমতা ও মোদি প্রধান প্রতিপক্ষ এবং রাজ্যে কোনওরকম জোটই মমতার সঙ্গে করা সম্ভব নয়, তাহলে কিন্তু শুধু রাজ্যে জোট নয় এই আরজি রাহুল গান্ধীকে জানিয়ে এলেই যথেষ্ট নয়। একইসঙ্গে প্রদেশ নেতৃত্বের উচিত রাহুল গান্ধীকে এটাও জানিয়ে দেওয়া, যে রাহুল ঘোষণা করুন, জাতীয় স্তরেও আগামীদিনে আর যাই হোক কোনওভাবেই মমতার থেকে কংগ্রেস কোনও সাহায্য নেবেও না, দেবেও না। মহাজোটেও তৃণমূলকে নেওয়া চলবে না। এটাই তো স্বচ্ছ রাজনীতি। নীতির রাজনীতি। রাজ্যে মমতা বিরোধী। কিন্তু কেন্দ্রে মোদি-বিরোধী লড়াইকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে কিংবা রাহুল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলে আশা করা হবে মমতা সমর্থন করবেন, এই অবস্থান সুবিধাবাদী। বিরোধীরা বলেন মমতা সুবিধাবাদী রাজনীতি করেন। যদি সেটা ঠিক হয়, আপনারা তাহলে কেন সেই একই রাজনীতি করছেন? সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে আরও গুরুত্ব হারাবে কংগ্রেস। তৃণমূলের এই একক বৃহৎ শক্তির পাশাপাশি দ্রুত সিপিএমের ক্ষয় এবং বিজেপির অত্যন্ত দ্রুত সমর্থন বৃদ্ধির মধ্যেও কংগ্রেসের এখনও যে সামান্য ভোটব্যাঙ্ক, কর্মী, সমর্থক বেঁচে আছে, সেই অংশটির কাছে মমতা ও মোদি অবশ্যই সমান প্রতিপক্ষ। কিন্তু সিপিএম নামটিকেও তারা কি বন্ধু ভাবেন? মনে হয় না। তাই সিপিএমের সঙ্গে জোট হলে তারা হয়তো কষ্টই পাবেন। তাহলে কেন এই উদ্যোগ? কারণ জোটপন্থীরা মনে করেন, মমতা বিরোধী ভোট তিনভাগে বিভাজিত হওয়ার থেকে দু’ভাগে বিভাজিত হওয়া বেশি আশাপ্রদ। এই দুই দলের সম্মিলিত ভোটব্যাঙ্ক এক হয়ে অন্তত মমতার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসে বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দেওয়াই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য স্থাপনে কোনও অন্যায় নেই। দুটি ক্রমক্ষীয়মান দল অস্তিত্ব বাঁচাতে এটা করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই একই জোট ২০১৬ সালেও হয়েছিল। সেখানে কংগ্রেস যথেষ্ট সংখ্যক আসনও পেয়েছিল। কিন্তু সেই বিধায়ক সংখ্যার বৃদ্ধি কি সংগঠন বৃদ্ধিতে আদৌ কোনও কাজে লেগেছে? ভোটব্যাঙ্ক বৃদ্ধিতে কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েছে? সিপিএমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে কংগ্রেস সম্পর্কে বৈরিতা আর বিশেষ নেই। সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব অনায়াসে কংগ্রেসের হাত ধরতে উদগ্রীব। বহু কর্মীরও কোনও আপত্তি নেই হয়তো। পক্ষান্তরে কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকদের বহুলাংশের মধ্যে কিন্তু সিপিএম সম্পর্কে তীব্র ক্রোধ, অ্যালার্জি রয়ে গিয়েছে। ক্ষতি সিপিএমের হবে না। কিন্তু কংগ্রেস নিজেদের কর্মী সমর্থক হারাতে পারে এই সিদ্ধান্তের জেরে। ব্লকে, ছোট জনপদে বহু কংগ্রেসি মনে করেন সিপিএমের সঙ্গে হাত মেলালে সেইসব এলাকায় তাঁদের যথেষ্ট রাজনৈতিক তাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গবিদ্রুপের মধ্যেই পড়তে হবে।
সিপিএম মমতার বিরোধিতা করছে। কিন্তু মমতার বিকল্প রাজনীতিটা তারা কী দেবে সেটা বোঝাতে পারছে না। কারণ সেটা তাদেরই জানা নেই। যদি তাঁরা বলেন, মমতার আমলে দাদাগিরি,সিণ্ডিকেট এসব চলছে। জনগণ হেসে বলবেন, এসবের জন্মদাতা কারা? আপনারা। যদি তাঁরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা নেই। পাল্টা প্রশ্ন শুনতে হবে সিপিএমের আমলে একটা দুটো হত্যা হতো না। সিপিএমের শাসনকাল বিখ্যাত হল অসংখ্য গণহত্যার জন্যই। অবশ্যই এটা ঠিক যে চাকরি, শিক্ষাব্যবস্থা, নিচুতলায় দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ আছে মানুষের তৃণমূলের আমলে। কিন্তু কই সেগুলি নিয়ে বিরোধীদের কোনও গঠনমূলক পরিকল্পিত আন্দোলনই নেই কেন? ভোটে যেই জিতুক, শাসক ও বিরোধীরা যখন তখন রাজনৈতিক কৌশলে পরস্পরকে টেক্কা দিচ্ছে, এটা যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং তীব্র কৌতুহলোদ্দীপক চিত্র। কিন্তু সমস্যা হল এ রাজ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীদের মধ্যে মমতাকে বড়সড় সংকটে ফেলতে পারে এরকম কোনও ইনটেলিজেন্ট মুভমেন্টই দেখা যাচ্ছে না। সেই একই সিবিআই, সারদা ইত্যাদি। কিন্তু ২০১১ অথবা ২০১৪ এবং ২০১৬ কোনও ভোটেই সারদা, সিবিআই এসব মমতাকে ভোটের রাজনীতিতে বিপদে ফেলতে পারেনি। নিশ্চয়ই তাহলে কোনও অন্য ইস্যু আছে যা নিয়ে মমতা এসব ছাপিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চলেছেন! কী সেটা? ওটার সন্ধানে সময় দিতে রাজি নয় বিরোধীরা। মমতাকে কিন্তু তখনই হারানো সম্ভব যখন মমতার নিজের ভোটব্যাঙ্ক তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। এই সহজ রাজনৈতিক ফর্মুলাই বিরোধীরা আত্মস্থ না করে মমতাকে ব্যক্তিগতভাবে বিপাকে ফেলার প্রবল প্রয়াসে তাঁর রাজনীতিকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে দিচ্ছেন। তিনিও সময় পেয়ে যাচ্ছেন অবিরত নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ককে আরও সংহত করার!
মানুষ ঠিক কোন কোন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ, সেটা আইডেন্টিফাই করাই বিরোধীদের কাজ। অথচ সেই পরিশ্রম কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ অথবা কর্মসূচির মতো পলিটিক্যাল ম্যাচিওরিটি দেখা যাচ্ছে না বিরোধীদের মধ্যে। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন পজিটিভ হোক, নেগেটিভ হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদাই আলোচনার, ইস্যুর, চর্চার ভরকেন্দ্র হয়ে বিরাজ করছেন। আমরা যাঁরা নিজেদের সামান্য পারিবারিক সমস্যা কিংবা অফিসের ঝামেলা সমাধান করতে বছরের পর বছর হিমশিম খাই, তাঁরা এক সেকেণ্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসে মমতা ভুল করলেন। মমতাকে নিয়ে তারপর ৭২ ঘণ্টা ধরে হাসাহাসি করলেন বহু মানুষ। কিন্তু এটা ভেবে দেখলাম না ওই ৭২ ঘণ্টা ধরে মিডিয়ায়, চর্চায়, ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে, আড্ডায় এক ও একমাত্র আমরা সময় ব্যয় করলাম মমতাকেই নিয়ে। তাঁকে ইগনোর করতে পারলাম না কেউ। এই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকার টেকনিকটাই ধরতে পারছে না বিরোধীরা।