শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
এরপর শীঘ্রই মাসুদ আজহার তৈরি করে জয়েশ-ই-মহম্মদ (জেইএম)। জেইএম প্রথম হামলাটাই করেছিল আত্মঘাতী বোমার সাহায্যে, ২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল শ্রীনগরে সেনা বাহিনীর (১৫ নম্বর কোর) উপর। তার পর থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা জারি রেখেছে—জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা, সংসদভবন, শ্রীনগর এবং কুপওয়ারা ও বারামুলা জেলায়।
অনুপ্রবেশ ও জঙ্গি নিয়োগ
জয়েশ অপারেশনটা করে দু’ভাবে: একদিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে জঙ্গি ঢুকিয়ে দিয়ে বাছাই করা লক্ষ্যগুলোতে অতর্কিত হামলা চালায়। দৃষ্টান্ত পাঠানকোট, উরি ও নাগরাকোটা। অপারেশনের অন্যদিকটা হল স্থানীয় যুবকদের ‘রিক্রুট’ করে আত্মঘাতী বোমা হিসেবে ব্যবহার করা। এরই একটা দৃষ্টান্ত হল আদিল আহমদ দার, যে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিআরপিএফ কনভয়ের ভিতরে এসইউভি গাড়ি ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাল এবং ৪০ জন জওয়ানকে মেরে দিল।
অপ্রীতিকর ঘটনা এই যে, জঙ্গি অনুপ্রবেশ এবং স্থানীয় যুবকদের জঙ্গিদলে নিয়োগের ঘটনা ২০১৫ সাল থেকে বেড়ে গিয়েছে। (সারণি দ্রষ্টব্য)
জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কে আমার মত সকলের জানা। পাকিস্তানের ‘এস্টাবিলশমেন্ট’—একটি দুর্বল অসামরিক সরকার, সেনা বাহিনী কোনও শিক্ষাই নেয়নি, নন-স্টেট অ্যাক্টরস বা অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জম্মু ও কাশ্মীরকে ‘ভিকটিমাইজ’ করছে এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কবর খুঁড়ছে। একইসঙ্গে, আমি বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মাসকুলার, মিলিটারিস্টিক ও ম্যাক্সিমালিস্ট’ অবস্থানের ঘোরতর বিরোধী, কারণ এটাও জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষকে ‘ভিকটিমাইজ’ করছে।
জাতিকে হতাশ করছে
এনডিএ সরকার ভারতকে নানাভাবে হতাশ করেছে কিন্তু কোনোটাই জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়নি যতটা জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য গৃহীত বিপর্যয়কারী নীতির কারণে হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ মে আমি এই ‘কলাম’-এ লিখেছিলাম যে ‘‘ভারত সেটাই, একটা জাতি হিসেবে, দাঁড়িয়ে আছে কারণ—তার ঐক্য, সংহতি, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটা সরকার, মতানৈক্যের সমাধানে আলোচনা প্রভৃতি—জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে একটা পরীক্ষা। ভারত, একটা জাতি হিসেবে, পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে।’’
পুলওয়ামার পর, সরকার এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা নির্বাচনের আগে ‘বধ’ করার জন্য একটা ‘শয়তান’কে খাড়া করছে। এইসব করার সময় কাশ্মীর উপত্যকার ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের জম্মুতে এবং ভারতের অন্যসকল শহরে আক্রমণ করা হচ্ছে। কাশ্মীরি ছাত্রদের হস্টেল এবং বন্ধুদের আড্ডা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিক্ষিপ্ত পোস্টগুলোকে রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যাপারস্যাপার গণ্য করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার জন্য এবং সে-দেশের সঙ্গে খেলাধুলোয় অংশ নেওয়া ঠেকাতে দাবি উঠল। মেঘালয়ের রাজ্যপাল সংবিধানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিলেন, বললেন, ‘‘কাশ্মীর ভ্রমণ করবেন না, অমরনাথ তীর্থে যাবেন না, প্রতি শীতে যেসব কাশ্মীরি ব্যবসায়ী আসেন তাঁদের কাছ থেকে কোনও জিনিস কিনবেন না।’’
৪০ জনের প্রয়াণে আমরা শোকাহত এবং তাঁদের পরিবারগুলির প্রতি সমবেদনা জানাই। কিন্তু, এই কোলাহলে আমরা কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাচ্ছি, জাতীয় নিরাপত্তারক্ষার দায়টা কার? ‘ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়োর’ কিছু ছিল না তো? দুই সহস্রাধিক সেনাকে একসঙ্গে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনও মারাত্মক ত্রুটি ছিল না কি? আদিল দার নামে বছর বাইশের এক যুবক কেন ৪০ জন জওয়ানকে মারল এবং নিজেকেও শেষ করে দিল? যতক্ষণ না আমরা এই প্রশ্নগুলো তুলব এবং উত্তর খুঁজব, ততদিন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে না।
বিবেকী কণ্ঠস্বর
অনেক মানুষ প্রশ্ন তুলছে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসনাইন লিখেছেন: ‘‘যদি কাশ্মীরিরা শারীরিক নিগ্রহ আর হেনস্তার লক্ষ্য হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে সংখ্যালঘুরা নিন্দিত হতে থাকে, তবে ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।’’
এক সাক্ষাৎকারে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুডা বলেছেন: ‘‘কাশ্মীর সমস্যার ব্যাপারে আমাদের চোখ বুজে থাকা উচিত হবে না, মনে রাখতে হবে যে, যে-জঙ্গি এটা করেছে সে স্থানীয় অধিবাসী ...। সুতরাং, সমস্যটা ঘরের।’’
অবসরপ্রাপ্ত বিদেশসচিব শ্যাম সারন লিখেছেন: ‘‘কাশ্মীরকে বাকি ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এবং এর বিচ্ছিন্ন মানসিকতার মানুষজনকে নিরাপত্তার কাঠিন্য দিয়েও বাগে আনা সম্ভব হবে না ...। আমাদের এমন একটা কৌশল নিতে হবে যাতে ভিতর বাহির দুদিক থেকেই কাশ্মীর ইস্যুটাকে যথার্থভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।’’
অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার জুলিয়ো রিবেইরো লিখেছেন: ‘‘জঙ্গিরা যে ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে উঠে আসছে সেই গোষ্ঠীটাকে যদি জয় করা সম্ভব নাহয় তবে জঙ্গিরা পরে ওই ধর্মী গোষ্ঠী থেকেই ‘অক্সিজেন’ পেতে থাকবে এবং একজন নিহত জঙ্গির জায়গায় খুব শিগগিরি উঠে আসবে আর-একজন, এমনকী দুই বা তিনজন আবেগ-তাড়িত মানুষ।’’
এমনকী এইসমস্ত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হওয়ার পরেও আর্মি পুরনো কণ্ঠেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে: লেফটেন্যান্ট জেনারেল কানোয়ালজিৎ সিং ধিলন, কোর কমান্ডার, চিনার কোর ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বলেছেন, ‘‘কাশ্মীরে যে কেউ হাতে বন্দুক তুলে নিলে, আত্মসমর্পণ না করলে, তাকে নিকেশই করে দেওয়া হবে।’’
ক্রমবর্ধমান ক্রোধ ও হতাশার মধ্যে দিনের বাকিটা অনুতাপ করে কাটালেও, আমরা আশা ছাড়তে পারি না। বর্তমান সরকার সবচেয়ে খারাপ যেটা করতে পারে সেটা হল দেশটাকে আরও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া—যার পরিণামে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস বৃদ্ধি, জম্মু ও কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতার মানসিকতার বৃদ্ধি, আরও প্রাণহানি এবং সমাধানের সামনে আরও দূরত্ব তৈরি। আমি নিশ্চিত, যাইকহোক, বিবেকী কণ্ঠ জাগবে এবং ভবিষ্যৎ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাবে আরও বোঝাপড়ার মানসিকতা, সুবিবেচক নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সমাধানের আন্তরিক প্রচেষ্টা।