শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
তাঁরা আবারও বুকের তাজা খুন ঢেলে দিতে চান
আবারও আরেকটি ৮ই ফাগুন ফিরিয়ে আনতে চান
আবারও আরও গাঢ় রঙে রাঙিয়ে দিতে চান শিমূল, কৃষ্ণচূড়া!”—জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
কৃষ্ণচূড়া বোধহয় এতটা ঘন রক্তবর্ণ হয়নি কক্ষনো এর আগে। এমনটা যে হতে পারে, তা ভাবতেই পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু শাসকেরা। ভাষার আবেগ কতটা গভীর হওয়া সম্ভব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চল্লিশটি উজ্জ্বল রত্ন বুকের রক্ত দিয়ে লিখল নতুন ইতিহাস। অবাক পৃথিবী জানল, দেশ নয়, স্বাধীনতা নয়, সন্তান নয়, মা নয়–মায়ের ভাষাও হতে পারে এমন পরম প্রিয়। যার জন্যে কৃষ্ণচূড়ার ছেঁড়া পাপড়ির মত, আগুন-রঙা পলাশের মত রক্তের ঢেউ ঢেলে দেওয়া যায় রমনার মাঠে। এমনটাই তো হল ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী, উজ্জ্বল ছাত্ররা—বেঁচে থাকলে যারা অবলীলায় হতো দেশের, সমাজের দিশারি—যুগান্তের সেই সন্ধিক্ষণে মৃত্যুর মধ্য দিয়েও নির্দেশ করল এক সুনির্দিষ্ট দিশার। জাতির জীবনে, মননে। আশা নেই বলেই বোধকরি ভাষা হয়ে ওঠে আশা। সেই সঙ্গে উৎসারিত হয় এক আত্মপ্রত্যয়ের হৃদ্স্পন্দন। ভবিষ্যতের প্রতিটা দিন-বদলের ক্রান্তিলগ্নে আর শিকল ছেঁড়ার মুহূর্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে একুশের স্পন্দন। স্বাধীন বাংলাদেশের ভ্রূণের সৃষ্টিও বোধকরি বাহান্নর সেই পুন্যদিনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই নিশ্চিতভাবে সেই দিশার পূর্ণতা।
ওদিকে বাংলাভাষার তৃতীয় ভুবনে অসমের বারাক উপত্যকায় বাংলাভাষার অধিকার রক্ষার সত্যাগ্রহীদের উপরে পুলিসের নির্বিচার গুলিতে ১৯৬১-র ১৯ মে, রবীন্দ্র শতবর্ষের কবিপক্ষের মাঝেই, জন্ম হল একাদশ শহিদের। স্বাধীন ভারতে ভাষার অধিকার রক্ষায় প্রাণ দিল কেউ প্রথম বারের জন্যে। সালাম, জব্বর, রামেশ্বর, রফিকদের হাত থেকে ভাষা শহীদের ব্যাটনটা হাতে তুলে নেয় কমলা, শচীন্দ্র, কুমুদরঞ্জন-রা।
সময় গড়িয়ে চলে। ‘এমনই করে ফি-বছর নগ্ন পদ বিক্ষেপে ৮ই ফাল্গুন আসে।’ ভাষা শহিদদের ভোলেনি বাঙালি। নিশ্চিতভাবেই। পূর্ব বাংলায় একুশ নিয়েছে গণ-উৎসবের চেহারা। পশ্চিম খণ্ডের বাঙালিও স্মরণ করে চলেছে একুশ আর উনিশের শহিদদের। প্রত্যেক বছর। আজ, একুশের পুণ্যক্ষণে, আমরা বরং একবার ফিরে দেখি আমরি বাংলাভাষার দিকেই। যে-ভাষার জন্যে রক্ত ঝরেছে বাহান্ন আর একষট্টিতে। পূর্ব খণ্ডে আর তৃতীয় ভূখণ্ডে। দুই দেশ জুড়ে। তবু, পশ্চিম খণ্ডের বাংলা ভাষাটা বোধকরি বদলে চলেছে একটু একটু করে। শহুরে কথ্য বাংলাকেও চিনতে আজ কষ্ট হয় অনেক সময়।
আসলে ‘দিবসগুলি পালিত হয়/ শপথগুলি নয়।’ শহিদমিনারের সামনে পুষ্পাঞ্জলি কিংবা কাগজে কাগজে আর সভা-সমিতিতে একুশের বন্দনাই তাই যথার্থ শহিদতর্পণ নয়। আজকের নাগরিক বাংলাভাষাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার। রয়েছে হিন্দি শব্দের জোয়ার। বাংলা থেকে বিচ্যুত হয়ে স্পষ্টতই তৈরি হয়েছে এক মিশ্র ভাষারীতির। ভাষার মাপকাঠিতে এটা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তার সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারেন যোগ্য ভাষাতাত্ত্বিকরা। বাংলাদেশের বাংলা ইতিমধ্যেই আপন করেছে প্রভূত উর্দু শব্দকে, যে উর্দুর শৃঙ্খল থেকে মুক্তির অভীক্ষায় ঘটেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। সেটা হয়তো ভাষার সমৃদ্ধির পক্ষে ভালোই। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা বর্জন করে ফেলেছে বেশ কিছু শব্দকেও, যে শব্দগুলি বার বার ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। বাংলা তাই সর্বত্রই হারিয়ে ফেলছে স্বকীয়তাকে। হারিয়ে ফেলছে তার রবীন্দ্রনাথকে, তার জীবনানন্দকে। এবং অত্যন্ত দ্রুতলয়ে।
এটা ঠিক যে আজকের দুনিয়ায় কোনও ভাষাই বিচ্ছিন্ন জলাধারের মতো তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। সেটা অভিপ্রেতও নয়। ভাষা বহতা স্রোতস্বিনী নদীর মত। দু’পাশের জনপদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় ভাষা-নদী পুষ্ট হয় বর্ষণে, সমৃদ্ধ হয় নানা উপনদীর জলধারায়, এমনকী প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে ওঠে দু’ধারের জনপদের জীবন-স্পন্দনেও। ওঠে ফুলে-ফেঁপে। যেমন, ইংরেজি ভাষার কথাই ধরা যাক। তার ২৯ শতাংশ শব্দ এসেছে লাতিন থেকে, আরও ২৯ শতাংশ শব্দের যোগান দিয়েছে ফরাসি ভাষা, যোগ হয়েছে ২৬ শতাংশ জার্মান শব্দও। বাকি ১৬ শতাংশ শব্দের মধ্যে ইতালীয়, স্পেনীয়, ডাচ, আরবি, হিব্রু, কী নেই! এমনকী ‘বাংলো’, ‘জাঙ্গল’, ‘কারি’ কিংবা ‘বারান্দা’-র মতো ভারতীয় শব্দেরও ছড়াছড়ি। এতে বড় একটা অসুবিধার কিছু দেখি না। বরং অন্য ভাষা থেকে ঋণ নিয়ে সমৃদ্ধ হয় যে কোনও ভাষার শব্দভাণ্ডার। তাই উর্দু, হিন্দি বা ইংরেজি শব্দ অর্জন করতে পারলে বাঙলা ভাষার ক্ষতি হবার কথা নয়।
সমস্যাটা কিন্তু অন্যত্র। আবার সেই ইংরেজি ভাষার উদাহরণ দেওয়া যাক। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভাষাটা তাদের নিজের নিজের মত করে গড়ে উঠেছে। যেমন সুবিশাল মার্কিন মুলুকে প্রধান যে ভাষায় কথা বলা হয় তাকে বলে ‘আমেরিকান ইংরেজি’। ব্রিটিশ ইংরাজির সঙ্গে তার পার্থক্য অনেকটাই। ব্রিটিশরা যাকে বলে ‘লিফট’, মার্কিনরা তাকেই বলে ‘এলিভেটর’। কিন্তু পার্থক্যটা কেবলমাত্র এতটাই সোজা নয়। শুধু নতুন শব্দই নয়, আমেরিকান ইংরাজিতে বদলে গিয়েছে বানান-রীতি, বদলে গিয়েছে ব্যাকরণ। নতুন স্টাইলে তাই সেটা যেন সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা। তেমনি করেই অস্ট্রেলিয়রা তৈরি করে ফেলেছে ‘অস্ট্রেলীয় ইংরেজি’। আজ ব্রেক্সিটের সন্ধিক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিদায়-বেলায় ব্রিটিশ ইংরেজি আর এক সংকটের মুখে। ব্রেক্সিটের ফলে ব্রিটেন সরে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দু-ডজন সরকারি ভাষার মধ্যেই থাকবে না ইংরেজি। ‘আমেরিকান ইংরেজি’-র মতো ইউরোপ জুড়ে ‘ইউরো ইংরেজি’ নামে যে ভাষাটা ইতিমধ্যেই গড়ে উঠছে বা উঠেছে, ব্রিটিশ ছত্রছায়ার অভাবে তা বিকশিত হয়ে উঠবে পূর্ণ রূপে। হয়তো-বা এক অনিবার্য নতুন আঙ্গিকে। প্রকাশ পাবে আর এক নতুন ভাষা।
নতুন ভাষা? হ্যাঁ, তাই তো বলছেন ভাষাতাত্ত্বিকরা। ‘আমেরিকান ইংরেজি’ অবশ্যই এক স্বতন্ত্র ভাষামাত্র, যা অনেকটাই আলাদা ‘ব্রিটিশ ইংরেজি’ থেকে। তেমনই ‘ইউরো ইংরেজি’ও এক নতুন ভাষা ছাড়া আর কিছু নয়। ভেবে দেখুন না, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্পেনীয়, ইতালীয় ইত্যাদি অনেক ভাষাই তো ব্যবহার করে একই অক্ষরমালা, তাদের মধ্যে রয়েছে একই ধরনের প্রচুর শব্দ। তবু এই ভাষাগুলি তো সম্পূর্ণ আলাদা।
আজ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও কি আমরা সে রকমেরই এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে—ইংরাজির ক্ষেত্রে ঠিক যেমন সংকট তৈরি করছে ‘ইউরো ইংরেজি’? হিন্দি এবং ইংরেজির অবাধ অনুপ্রবেশের ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র শব্দভাণ্ডার ফুলে-ফেঁপে ওঠাই নয়, বদলে যাচ্ছে আমাদের কথ্য বাংলার বাচনভঙ্গি, বদলে চলেছে তার ব্যাকরণ। এক দশক আগেও শুনতাম ‘তোমাকে বিয়ে করব’, আর এখন হামেশাই শুনে থাকি ‘তোমার সাথে বিয়ে করব’। আবার টিভির বিজ্ঞাপণে যখন শুনি ‘এই সুযোগ কাল আসে না আসে’, হতবাক হয়ে খুঁজে ফিরি বাঙালি অস্তিত্ব আর কালচার। সচেতন বা অচেতন ভাবে তৈরি হচ্ছে এমন এক ভাষারীতি যার দীর্ঘশ্বাসের নাম আর ‘চণ্ডীদাস’ থাকছে না কিছুতেই, আমাদের শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম ‘মধুসূদন’ থেকে বদলে যাচ্ছে দ্রুতলয়ে, আমাদের থরোথরো প্রেমের নাম এখন আর ঠিক যেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ নয়, আমাদের বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম ‘জীবনানন্দ’ থেকে সরে আসছে, আর বিদ্রোহের ‘নজরুল ইসলাম’ নামটাও হয়তো ভুলতে বসেছে আমরি বাংলা ভাষা। শুধু কাব্যে নয়, সাহিত্যে নয়—হয়তো জীবন যাপনের স্তরে স্তরে, হৃদয়ের প্রতিটা তালে ঘটে চলেছে এই বদলগুলি। আমরা বুঝি আর নাই বুঝি। অক্ষরগুলো থাকছে একই, থাকছে শব্দগুলোও। উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি অবশ্যই পারি দিয়েছে মারের সাগর। কিন্তু যে বাংলাভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছে রফিক, সালাম, রামেশ্বর, বরকত, সফিউর, শফিক, জব্বার, কিংবা শচীন্দ্র, বীরেন্দ্র, কমলা—সে ভাষাটা থেকে অনেকটাই যে আলাদা আজকের বাংলার শহুরে চলতি ভাষা। কিংবা খুব দ্রুতলয়ে ভেঙেচুরে গড়ে উঠছে যে নতুন কথ্য ভাষাটা। কী বলব সেই ভাষাটাকে? বিশ্বায়ণের পথে ধরে বাঙলার বিবর্তনের চালচিত্র? ‘গ্লোবাল বাংলা’ ভাষা?
আমার বাংলাভাষার জন্যে রফিকদের প্রাণের মূল্য, তাদের রক্তের দাম চোকানোর দায় আছে বইকি আমাদের। পুব বাংলার আর পশ্চিমবাংলার এই প্রজন্মের সমস্ত বাঙালিদের। আর যাই হোক, আজকের এই বদলে যাওয়া ভাষাটা কিছুতেই হতে পারে না একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা উনিশে মার্চের উত্তরাধিকার। কিন্তু উর্দুর কবল থেকে বাংলাকে মুক্তি দেওয়া কিংবা শিলচরের বাঙালিদের ভাষার অধিকারের দাবির চাইতে অনেক কঠিন, হয়তো-বা এক প্রকার অসম্ভবই, বাংলাভাষার ক্রমিক অবক্ষয়ের মূল্যে ক্রমশ গড়ে ওঠা নতুন বকচ্ছপ ধরনের ভাষাটার উত্থান আটকানো। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে, আবারও আরও গাঢ় রঙে শিমূল, কৃষ্ণচূড়া রাঙিয়ে দিয়েই নতুন কোনও রফিক, জব্বর কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারবে না আরেকটি ৮ ফাগুন!
মায়ের ভাষার জন্যে আজকের রফিক, জব্বরদের তাই দিতে হবে আরও বেশি কিছু। ‘ভক্তি’।