শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
সেদিন বিকেলে ঘটনার খবর ছবি, তা নিয়ে রাজনৈতিক প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া টিভিতে প্রচার শুরু হতেই আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল দেশ জুড়ে। শোক এবং ক্ষোভে কতটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশের মানুষের মন তার প্রমাণ মিলেছিল ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ট্যুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পথপ্রান্ত সর্বত্র। বিশেষ করে যখন জানা গেল জয়েশ-ই-মহম্মদ এই জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে তখন মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছিল প্রতিবেশী পাকিস্তানের ওপর—কারণ, সাধারণের ধারণা জয়েশ জঙ্গিরা পাক মদত পায়। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয় ঠিকই কিন্তু ওই জঙ্গিরা কি সবসময় পাকিস্তানের কথা শুনে চলে, পাক নিয়ন্ত্রণ মানে? বৃহস্পতিবারের ঘটনার দায় জয়েশ নিয়েছে এ কথা সকলেই জানেন। কিন্তু তার পিছনে পাক মদতের কোনও প্রমাণ কি মিলেছে? আর যতক্ষণ না তেমন প্রমাণ মেলে ততক্ষণ কি আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র সম্পর্কে এমন অভিযোগ আনা যায়?— এমন একটা কথা বলছেন অনেকেই। তাঁরা এই ঘৃণ্য কাজের জন্য জয়েশ সমেত যাবতীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সেনা অভিযানের দাবি জানাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু প্রমাণ পাওয়ার আগে সরাসরি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তোলাটাকে নীতিগত দিক থেকে সমর্থনে উৎসাহী হচ্ছেন না। তাঁদের বক্তব্য, দেশপ্রেমের আবেগের চেয়ে দেশ রক্ষায় কার্যকরী ও কঠিন পদক্ষেপ আজ অনেক বেশি জরুরি। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইকের চেয়েও শক্তিশালী কোনও ঘাতক ব্যবস্থা থাকলে তা প্রয়োগ করুক সরকার। অন্যদিকে, জঙ্গিদের মদত দেওয়া থেকে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলিকে বিরত করতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি অনেক বেশি প্রয়োজন। নরেন্দ্র মোদি সরকার যদি সেটাই করেন তবে দেশ ও দশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা আরও জোরালো হতে পারবে। জঙ্গিরাও শিক্ষা পাবে।
কিন্তু, এসব কথায় দেশের মন শান্ত হবার নয়। ৪২/৪৪টা তাজা প্রাণ দেশের ঐশ্বর্য কতকগুলো শয়তানের নারকীয় হিংসায় শহিদ হয়ে গেল—এমনটা মেনে নেওয়া তো চাট্টিখানি ব্যাপার না! আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও তো দুই মায়ের কোল খালি করে দিয়ে গেল জঙ্গি জয়েশ। এর আগেই এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে আমাদের এই বাংলা। কনাদ ভট্টাচার্যের মতো যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে শহিদ হন তাঁদের ক্ষেত্রে শোক ব্যথা সত্ত্বেও একটা সান্ত্বনা থাকে—তিনি দেশ রক্ষায় লড়াইয়ের ময়দানে শত্রু নিধন করতে করতে বীরের মৃত্যু বরণ করে শহিদ হয়েছেন। আমাদের গায়ে কাঁটা দেয় তাঁদের শৌর্যবীর্যের কথা কাহিনী। একজন সেনানীর পক্ষে এ তো পরম গৌরবের ব্যাপার। কিন্তু, জঙ্গিদের তো সামনে থেকে লড়ার ক্ষমতা নেই। চোরাগোপ্তা আক্রমণে কিছু লোক খুন করা, বাড়ি-ঘর ধ্বংস করা বা পিছন থেকে ছুরি মারার মতো কাপুরুষতাই তাদের চরিত্র, দেশে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করাটাই তাদের হাতিয়ার।
বৃহস্পতিবারও তার অন্যথা হয়নি। গাড়ি ভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে কনভয়ের সিআরপিএফ ভর্তি বাসে সটান ধাক্কা মেরেছে এক আত্মঘাতী জঙ্গি। মুহূর্তেই বিস্ফোরণে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে বাস, ছিন্নভিন্ন হয়ে শ্রীনগর জাতীয় সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে সেনানীদের দেহ, দেহাংশ। আর এরপর আর এক দল জঙ্গি এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছে সেনা কনভয়ে, রকেট লঞ্চার ছোঁড়ার প্রমাণও মিলেছে বলে দাবি তদন্তকারীদের!
এত বড় একটা ঘটনার নিন্দায় অনিবার্যভাবেই সরব হয়েছে সব মহল। শাসক-বিরোধী রাজনীতিও ছায়া ফেলতে শুরু করেছে ঘটনার ওপর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি ঘটনার পর থেকেই বলে আসছেন, এমন মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। অকারণ দোষারোপ ছেড়ে আমাদের একজোট হয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সাধারণ কাশ্মীরবাসীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ করতে হবে। আর তার জন্য তিনি নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিশেষ উদ্যোগও দাবি করেছেন। রাজ্যের দুই শহিদ পরিবারের ভবিষ্যতে যাতে কোনও দিক থেকে কোনও অসুবিধে না হয় তা দেখার আশ্বাসই কেবল দেননি, পরন্তু, ওই দুই পরিবারের সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে সান্ত্বনা সহমর্মিতা জানিয়েছেন। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি কী করেছেন? ঘটনার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব সেনার হাতে তুলে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, এই ঘটনার জবাব কীভাবে কবে দেওয়া হবে তা দেশের সেনাই ঠিক করবে। তাঁর এই ভূমিকার মধ্যে রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অনেকেই ‘ধীরে চলো নীতি’র ছাপ দেখতে পাচ্ছেন এবং কংগ্রেস সমেত বিরোধীদের অনেকেই তাঁর ৫৬ ইঞ্চি ছাতির শক্তি ক্ষমতা নিয়ে টিপ্পনীও করছেন!
আসলে ঘটনা ঘটেছে এমন একটা সময়ে, যখন দেশে সাধারণ নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে আর তা নিয়ে আগাম সমীক্ষার ফল অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান শাসকের চিন্তা বাড়িয়েছে। সেজন্য— ঘটনা যত বড়ই হোক —চটজলদি কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় শাসক গেরুয়াশিবির। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের একাংশে।
সত্যিই তো, ভোট কি কম বড় বালাই! বিশেষ করে যখন সমীক্ষার রিপোর্ট কুডাক ডাকছে, শেষ পাঁচ বিধানসভার ফলে রীতিমতো ধাক্কা লেগেছে, বিরোধী দলের প্রধান মুখ হয়ে উঠে আসছেন দুর্দান্ত জননেত্রী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—তখন শাসকচিন্তা যে ঊর্ধ্বমুখী হবে তাতে আশ্চর্য কী? সার্জিকাল স্ট্রাইক দিয়ে ২০১৬ সালের শেষদিকে মোদিজি ও তাঁর দল তাঁদের সরকারের প্রতি মানুষের আগ্রহ খানিকটা হলেও ফেরাতে পেরেছিলেন, ভাটার টান লাগা জনপ্রিয়তার খাতে কিছুটা হলেও জোয়ারের ঢেউ তুলতে পেরেছিলেন। নোটবন্দি ইত্যাদির ক্ষত তাতে খানিকটা ঢাকাও পড়েছিল। কিন্তু, সেই একই হাতিয়ারে আবার সাফল্য মিলবে কি না, নাকি হিতে বিপরীত হবে ভোটবাজারে—তা যে কেউ হলফ করে বলতে পারছেন না! বরং, গতবার কেন কটা জঙ্গিঘাঁটি ভেঙে আর জঙ্গি মেরেই কাজ সেরেছিল ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’, কেন আরও ঢুকে সন্ত্রাসবাদীদের সর্বস্বান্ত করে দিয়ে আসেনি সেনা— আজ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে! সেইসঙ্গে অবন্তীপোরার এই ঘটনা থেকে বাহিনীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেসব মারাত্মক গাফিলতির কথা উঠে আসছে—তা নিয়েও তো প্রশ্ন বিস্তর।
এদিকে সামনে ভোট। মহারণ। দিল্লির মসনদ বাঁচানোর লড়াই। গোলটা তো বেধেছে সেইখানেই। আর তাই ‘ব্যবস্থা’ নিতে এত দ্বিধা, এত কৌশল! অন্তত রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অভিমত তেমনই। কিন্তু কথা হল, এভাবেই কি রাজনৈতিক নানা কারণে, নানা স্বার্থের তাড়না ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে চিরকাল এমন বধ্যভূমি করে রাখবে? জঙ্গিরা যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে? আর দিনের পর দিন এইভাবে আমরা কি কেবল মার খেতেই থাকব!? দিল্লি, একটু ভাবুন।