শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
ধর্মতলায় মমতার মোদির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। সিবিআইকে কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছে— মমতার তোলা এই অভিযোগের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব এখন সহমত পোষণ করছেন। কেজরিওয়াল থেকে তেজস্বী যাদব, মায়াবতী থেকে রাহুল গান্ধী সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা সিবিআই ইস্যুকে সামনে রেখে মোদির বিরুদ্ধে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করার অভিযোগ তুলছেন। গত কয়েকদিন সংসদের ভেতরে এবং বাইরের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ধর্না চলাকালীন স্বয়ং কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মমতাকে ফোন করে তাঁর আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। সিবিআইকে কেন্দ্র করে মমতার ধর্না জাতীয় রাজনীতিতে তাঁকে কয়েক কদম এগিয়ে দিল বলা যায়।
বস্তুত, নোটবন্দির পর থেকে লাগাতার মোদি-বিরোধী আন্দোলন মমতাকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে এসেছিল। গত ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে মোদি-বিরোধী দেশের সমস্ত নেত্রীবৃন্দকে এক মঞ্চে এনে তিনি প্রমাণ দিয়েছিলেন এই মুহূর্তে মোদি-বিরোধিতায় তিনি প্রধান মুখ। ওই সমাবেশে কংগ্রেসের তরফ থেকে লোকসভার দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং দলের সংসদ সদস্য অভিষেক মনু সিংভি ব্রিগেডের জনসভায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী একপ্রকার বাধ্য হয়েছিলেন ব্রিগেড সমাবেশকে সামনে রেখে মমতার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে। প্রদেশ কংগ্রেসের অনুরোধ উপেক্ষা করেই সোনিয়া গান্ধী মমতার ব্রিগেড সমাবেশে মল্লিকার্জুন খাড়গের মতো নেতাকে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন। না হলে জাতীয় রাজনীতিতে মোদি-বিরোধিতায় কংগ্রেসের একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
ব্রিগেডের পর ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে একাধিক বিরোধী নেতার উপস্থিতি দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বকে নতুনভাবে কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেসের সমীকরণ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। কংগ্রেসের জাতীয় নেত্রীবর্গ জানে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃবর্গ যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট চায় না, তেমনি তৃণমূল নেত্রীও রাজ্যের ৪২টি আসন জয়ের আশায় প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট নিয়ে ভাবেন না। রাহুল-সোনিয়া গান্ধীর কাছে সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে নয়—তাঁদের কাছে আরও বড় প্রশ্ন হল, মমতা যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে মোদি-বিরোধী প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন, তাতে নির্বাচনের ফলাফলের পর বিজেপিকে সরিয়ে দেশের সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিলে আদতেও সেই সরকার পরিচালনার নেতৃত্বের চাবিকাঠি রাহুলের হাতে থাকবে কি না সেই বিষয়ে। যেভাবে রাহুলের তোলা রাফাল ইস্যুকে ছাপিয়ে গিয়ে মমতার তোলা সিবিআইয়ের অপব্যবহার সংক্রান্ত ইস্যু জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেল, তাতে কংগ্রেস নেতৃবর্গের হাতে মোদি-বিরোধী আন্দোলনের চাবিকাঠি থাকবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। রাফালকে জাতীয় ইস্যু করেই নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীর পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল জাতীয় রাজনীতিতে। রাস্তার আন্দোলনে মমতা সব সময়ই অপ্রতিরোধ্য। বাম জমানায় বারবার রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে তৎকালীন বাম সরকারের থেকে দাবি আদায় করে নিয়েছেন কখনও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, কখনও বা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি রক্ষার আন্দোলন—সর্বত্রই বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। মোদির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আরও একবার প্রমাণ করলেন রাস্তার আন্দোলনে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এই আন্দোলনের যে সমস্ত ফসল তিনি ঘরে তুলতে পেরেছেন সেগুলি হল:
(ক) ধর্নার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মোদির বিরোধিতায় তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
(খ) দেশের সমস্ত আঞ্চলিক নেতৃবর্গ সমেত কংগ্রেস সভাপতি তাঁর আন্দোলনকে সমর্থন করে মোদি-বিরোধিতায় তাঁর ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
(গ) কেবল বিরোধী পক্ষ নয়, ধর্নায় বসার পর থেকে কেন্দ্রের শাসকবর্গ, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের মতো বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃবর্গ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত জনসভাগুলিতে মমতাকে টার্গেট করে বক্তৃতা করছেন। যা প্রমাণ করে বিরোধী নেতৃবর্গের মধ্যে শাসকের দৃষ্টিতেও তৃণমূল নেত্রী কেন্দ্রে রয়েছেন।
(ঘ) লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রীর ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে বসা তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতায় আট বছর থাকার পরেও নেত্রী রাস্তায় বসে এখনও আন্দোলন করতে পারেন—এই ভাবনা তৃণমূল নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা করল।
(ঙ) সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে সারা রাজ্যের প্রতিটি বুথে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা মিটিং-মিছিল আয়োজন করে। এর ফলে লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের বুথ ভিত্তিক সাংগঠনিক শক্তি কেমন রয়েছে তা যাচাই করার সুযোগ পেয়ে গেল তৃণমূল নেতৃত্ব। ভোটের আগে সাংগঠনিক দিক থেকে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
(চ) মমতার ধর্না এবং তীব্র মোদি-বিরোধিতা রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে তৃণমূল কংগ্রেসকে একমাত্র মোদি-বিরোধী মঞ্চ হিসেবে প্রতিপন্ন করবে। এই নির্বাচনে একশো ভাগ সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে আশি ভাগ সংখ্যালঘু মানুষ যদি তৃণমূলের পক্ষে রায় দেয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই সমস্ত কিছু ভাবনা জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের পক্ষে যেতে পারে। অন্যদিকে তেমনি সিবিআই ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসায় নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতির ইস্যু অর্থাৎ রাফাল দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির প্রচারের কেন্দ্র থেকে বেশ খানিকটা আড়ালে চলে গেল। তাতে কি বিজেপি’র জন্য খানিকটা স্বস্তি এল? কারণ মোদির বিরুদ্ধে যতক্ষণ রাফাল-এর মতো দুর্নীতি ইস্যু প্রচারের কেন্দ্রে ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত মোদি সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত এই ভাবনায় ভোটারদের প্রভাবিত করবার সুযোগ ছিল। অন্যদিকে সিবিআইকে নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করছেন—এই অভিযোগের প্রচার মোদি, অমিত শাহকে পাল্টা প্রচার করবার সুযোগ এনে দিয়েছে বিরোধীরা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত সেই বিষয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরবার। বিরোধীদের বিরুদ্ধে চলা সিবিআই তদন্তকে প্রচারের আলোতে নিয়ে এসে মোদি, অমিত শাহরা দেখাতে চাইছেন তাঁদের লক্ষ্য দুর্নীতি মুক্ত ভারত গঠন। অর্থাৎ মোদি, অমিত শাহের বিরুদ্ধে রাফাল ইস্যু সক্রিয় থাকলে তাঁদের ভাবমূর্তির ওপর দুর্নীতির কালো মেঘ ঢেকে থাকবে। অন্যদিকে সিবিআই তদন্তে বেশি সরব হলে মোদি, অমিত শাহ তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির তির সহজেই বিরোধী শিবিরের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন।
পাশাপাশি সমস্ত বিরোধী দল মিলে কেবল নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করলে মোদি সহজেই ২০১৯-এর নির্বাচনে নায়ক হয়ে উঠতে পারবেন। ইতিমধ্যে তাকে সরানোই বিরোধীদের একমাত্র কাজ—এই বক্তব্য তিনি একের পর এক জনসভায় প্রচার করে ভোটারদের মন জিততে চাইছেন। তিনি চাইছেন লড়াইটা ‘মোদি বনাম সমস্ত বিরোধী পক্ষ’ এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে। লড়াই ‘মোদি বনাম সকল পক্ষ’ এই ভাবনায় আটকে গেলে মোদি কিন্তু কিছুটা বাড়তি সুবিধায় থাকবেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একইভাবে ‘মমতা বনাম সমস্ত বিরোধী পক্ষ’ এই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই ভাবনাকে সামনে রেখে মমতা ঘোষণা করেছিলেন তিনি ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী। সেদিন রাজ্যের বিরোধীরা মমতার বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে প্রচার চালিয়ে যে ভুল করেছিলেন, মোদির বিরুদ্ধে একই ভুল করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারবে তো বিজেপি’র বিরুদ্ধে থাকা দলগুলি?