শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
আজকের দিনে ভারতে জনসংখ্যা একশো ত্রিশ কোটির বেশি। আদমশুমারির হিসেবে প্রতি পাঁচজনে প্রায় দুজন আঠারো বছরের নীচে, অর্থাৎ হিসেব মোটামুটি পঞ্চাশ কোটির। সোজাসাপটা সংখ্যা বলছে এবারের বাজেটে শিশুদের জন্যে ধরা হয়েছে নব্বই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। সহজে ভাগ করার জন্যে একে এক লক্ষ কোটিই ধরা যাক। সেক্ষেত্রে আঠারোর নীচে প্রতিটি নাগরিকের জন্যে সারা বছরের বরাদ্দ দু’হাজার টাকা, দিনে ছ’টাকার সামান্য কম। এটা অবশ্য বড্ড গোদা পরিসংখ্যান। সরকার সেই জায়গায় অন্যরকম কিছু যুক্তি পেশ করতে পারে। সংসারের আয়ের একটা অংশ তো অবশ্যই শিশুদের পেছনে খরচ হয়, সুতরাং সেই হিসেবে হয়তো শিশুরা আর একটু বেশি দুধেভাতে থাকবে। অঙ্কে অঙ্ক বাড়ে, তবে বরাদ্দ বাড়ে না। তাই শিশুদের হাতেখড়ি দেওয়ার জন্যে যদি মহাকাশবিজ্ঞানের অঙ্ক কষে ভালোমন্দ বুঝতে হয় তাহলে ব্যাপক মুশকিল।
সহজ জনগাণিতিক জ্ঞানের মাপকাঠিতে এই বরাদ্দ গত বছরের থেকে বেড়েছে মাত্র ০.০১%
এবং পৌঁছেছে ৩.২৫% এ। এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে ২০০৩-৪ এর বাজেটে এই বরাদ্দ ছিল মাত্র ২.২%, যা ইউপিএ রাজত্বের মাঝপথে ২০০৭-৮ আর্থিক বছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৯৩% এ। শেষ চার বছরের বিজেপি শাসনে এই পরিসংখ্যান ৩.২৬%, ৩.৩২%, ৩.৩২% এবং ৩.২৪%। অন্তর্জালের কল্যাণে আর কোন বিপ্লব না ঘটুক, তথ্য বিপ্লব ঘটে গেছে অবশ্যই। সেজন্যেই খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যায় গত কয়েক বছরের সঙ্গে এ বছরের অন্তর্বর্তী বাজেটের তুলনা।
শিশুদের বাজেট বিশ্লেষণের আগে আরও দু-একটি তথ্য মনে করিয়ে দেওয়া যাক। আমাদের দেশে মোটামুটি ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বলে ধরা হয়, ইংরেজিতে যাকে বলে চাইল্ড। সংবিধানের ২১ এর ‘ক’ ধারা বলে যে ছয় থেকে চোদ্দ বছর বয়েসের শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক। শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত বাবা মায়ের শিশুদের ধরে গুণভাগে অনেকটা বাড়িয়ে কমিয়ে দিনে দৈনিক ছ টাকাকে ছয় ছক্কা ছত্রিশ টাকা করলেও কীভাবে সেই অর্থে একটি শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য কিছু ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা যায় সে প্রশ্নে ঢুকে নিজেদের আর বেশি অপ্রস্তুত না করাই ভালো। সবটুকু অবশ্য খারাপ বলা যাবে না। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় ৯৭.২% শিশু স্কুলে নাম লিখিয়েছে। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম স্কুলে না যাওয়া শিশুর সংখ্যা তিন শতাংশের নীচে নামল। তবে এতে আত্মশ্লাঘার খুব কারণ নেই। শিক্ষার মানের সমীক্ষা কিন্তু অন্যরকমের খবর আনছে। দশ-এগারো বছরের বাচ্চারা, অর্থাৎ যারা মোটামুটি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে, তাদের অঙ্কের জ্ঞান এই মুহূর্তে বেশ গোলমেলে। ২০১৮ সালের হিসেব জানাচ্ছে তাদের মধ্যে মাত্র আঠাশ শতাংশ বাচ্চা ভালোভাবে ভাগ করতে পারে। দশ বছর আগে এই শতাংশ ছিল অনেক বেশি, প্রায় সাঁইত্রিশ।
অঙ্কের কচকচিতে আর বেশি না গিয়ে এটা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে শিশুদের মোট বাজেটে শিক্ষার জন্যে বরাদ্দ কমছে বছর বছর। জনগণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিশুশিক্ষার বরাদ্দ কমলে শিশুদের শিক্ষার মান যে কমে এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কারণ তা নাহলে ভবিষ্যতের কোনও সরকার হয়তো ‘পেটে খিদে থাকলে পড়াশোনা ভালো হয়’ গোছের নীতিবাক্য শুনিয়ে তার পিছনে কিছু তথ্যরাশি পেশ করার সুযোগ খুঁজত।
এবারের অন্তর্বর্তী বাজেটে কৃষকদের জন্যে অনেক ভেবেছে সরকার, ভেবেছে শ্রমিকদের কথাও। বাজেট বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে মেহনতি মানুষের জন্যে বিকল্প অর্থমন্ত্রীর হাহাকার। কথায় কথায় মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী দেশের পিছিয়ে থাকা অংশের জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায়। ভোটের আগে কত তাড়াতাড়ি চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে সেই উদ্দেশ্যে ভারতে ইন্টারনেটের তারগুলো কোদাল চালিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে। এমন গতিতে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে কৃষকপ্রতি প্রথম কিস্তির ডিজিটাল ক্যাশ ছিটকে বেরচ্ছে যে পরমাণুবিজ্ঞানে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে ইলেকট্রনের গতিবেগ নিয়ে। দুঃখী চাষির কথা ভাবতে গিয়ে মোদি সরকার না পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়ে যায়! দুহাজার টাকায় কতোগুলো মৌলিক বৈদ্যুতিন কণা সেই নিয়ে ঐকিক নিয়মে গবেষণা চলছে অর্থমন্ত্রকে। এমনিতেই কৃষকদের যে কোনও লম্বা মিছিলের শেষে মঞ্চে উপবিষ্ট থাকেন রাহুল গান্ধী। তার ওপর প্রিয়াঙ্কা যোগ দিয়েছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। হিন্দি বলয়ে বিজেপির ভোটের ভাগ কমছে। এইসময় আর কৃষকদের ভোট অন্যদিকে ভেসে যেতে দেওয়া যায় না। তাইতো সামনের বছরের (২০১৯-২০) অন্তর্বর্তী বাজেটের গল্পে গোঁজামিল দিয়ে বর্তমান আর্থিক বছরের (২০১৮-১৯) বরাদ্দ থেকেই টাকা সরিয়ে রাখা হয়েছে কৃষকদের চোখের জল মোছানোর জন্যে। শ্রমিকদের জন্যে অবশ্য হাতে হাতে টাকা নেই, বরং সেখানে ভবিষ্যতে পেনশনের হাতছানি।
তাহলে শিশুদের জন্যে নতুন ভাবনা নেই কেন? তার কারণ একেবারে পরিষ্কার। একশো ত্রিশ কোটির দেশে আশি কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার, বাকি পঞ্চাশ কোটি বয়সে ছোট। যার ভোট নেই তার জন্যে লোকসভা নির্বাচনের মাস তিনেক আগে ভাবার সময় থাকে না শাসকদলের। সেই জন্যেই বাজেট বক্তৃতায় শিশুদের কথা খুঁজতে গেলে দূরবিন প্রয়োজন। তবে চশমা ছাড়াই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এবারের বাজেটের বিশালাকার অক্ষরের ভীষণ চমক ‘ভিশন ২০৩০’। আজ থেকে এগারো বছর পর দেশ ঠিক কোথায় পৌঁছবে তার চালচিত্র। দশ ট্রিলিয়ন (একের পর তেরোটা শূন্য) ডলারের অর্থনীতি বোঝাতে আলোচনা করা হয়েছে দশটি মূল বিষয়ের। পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে উন্নত পরিকাঠামোর কথা আছে, আছে সবার ডিজিটাল ইন্ডিয়া। আছে ভারতকে পরিচ্ছন্ন এবং দূষণমুক্ত করার কথা। শিল্পায়নের জন্যে আছে “মেক ইন ইন্ডিয়া”। এটা অবশ্যই ভবিষ্যতে রাখতে হবে, কারণ গত ছাপ্পান্ন মাসে ভারত ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ই রয়ে গেছে। ভোটমুখী ভবিষ্যতের চটজলদি রচনা লিখতে গিয়ে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর গল্পও আছে বড় করে। কোথাও কিন্তু আজকের শিশুদের কথা নেই। বাজেট প্রস্তুতকারক সংস্থা বেমালুম ভুলে গেছে যে ২০৩০ এর যুবকদের একটা বড় অংশকেই আজকের শিশুদের বাদ দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানের সাত থেকে সতেরো ২০৩০ সালে আঠারো থেকে আঠাশ হবে। তখন তারাও ভোট দেবে। আজকের দিনে তাদের দেখতে না পাওয়াকেই বলে ‘দূরদৃষ্টিতে ছানি’।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত