শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
নরেন্দ্র মোদি যতই পাকিস্তানকে হুংকার দিন ইন্দিরা গান্ধীর ওই রেকর্ড স্পর্শ করা অত্যন্ত কঠিন। অবশেষে লোকসভা ভোটের আগে একটা বড়সড় সুযোগ এসেছে। তাঁকে এমন কিছু করতেই হবে যাতে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার ইতিহাসে তাঁর নামও থেকে যায়। ঠিক সেই কারণেই তাঁর দল ও কট্টর সংঘ পরিবার প্রবলভাবে চাপ দিচ্ছে কিছু একটা করার। পুলওয়ামার আক্রমণের পর প্রধানমন্ত্রী নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সভা সমাবেশে ঘোষণা করছেন, যে ভারত চুপ করে বসে থাকবে না। মুখের মতো জবাব দেওয়া হবে। সুতরাং সময়ের অপেক্ষা। নরেন্দ্র মোদি যে আজ নয় কাল কিছু একটা জবাব দেবেনই সেটা নিয়ে সংশয় নেই। সেটি সার্জিকাল স্ট্রাইক? নাকি প্রত্যক্ষ যুদ্ধ? তার উত্তর যথাসময়েই পাওয়া যাবে। কিন্তু মোদির উপর একদিকে যেমন দেশবাসীর প্রবল চাপ রয়েছে একটা কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের, তেমনই আবার বিরোধী দলগুলিকে লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে সম্পূর্ণ ইস্যুশূন্য করে দিতেও এটাই বিরাট সুযোগ এসেছে মোদির কাছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিরোধীরা আচমকাই যথেষ্ট স্তিমিত হয়ে পড়েছে পুলওয়ামার ঘটনার পর। সেটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কারণ এরকম একটি সময়ে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লড়াইকে পিছনের সারিতে সরিয়ে রেখে দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে গোটা দেশ একজোট—এই বার্তা দেওয়াই পরিণতমনস্কতা। কিন্তু বিরোধীদের কাছে অন্যতম প্রধান সঙ্কট হল রাত পোহালেই লোকসভা ভোট। এখন যদি হঠাৎ হাত থেকে তীব্র মোদি বিরোধিতার অস্ত্রগুলি নরম হয়ে যায়, তাহলে ভোটের প্রচারে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে মোদিকে? ফলে তাদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো।
বিগত মাসগুলিতে লক্ষ্য করা গিয়েছে অবশ্যই মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমা অনেক কমে গিয়েছে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধেও মানুষের ক্ষোভবিক্ষোভের প্রতিফলন পাওয়া গিয়েছে বিধানসভা ভোট ও বিভিন্ন উপনির্বাচনগুলিতে। ফলে যথেষ্ট ব্যাকফুটেই দেখা গিয়েছে বিজেপিকে। কিন্তু আচমকা পুলওয়ামার জঙ্গি আক্রমণের পর গোটা দেশেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এসেছে এক প্রবল ক্রোধ। আর পাকিস্তানের প্রতি তীব্র আক্রমণাত্মক মনোভাব। ‘শত্রু দেশকে উচিত শিক্ষা দেবে আমার দেশ’ এই প্রবল দেশপ্রেমের আকাঙ্ক্ষার জোয়ারে অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবেই পরোক্ষে সেইসব মনোভাব কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রী থেকে সেনাপ্রধান সকলের মুখেই হুংকার, হুঁশিয়ারি শুনতে চাইছে ওইসব ক্রুদ্ধ মন। আর সেটাই হচ্ছে। সরকার এবং দেশবাসী একসুরে পাকিস্তানকে তোপ দাগছে। ঠিক এরকমই এক মুহূর্তে বিরোধী দলগুলি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে যে এখন সরকারকে রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করা আদৌ কতটা সুপ্রযুক্ত। তাই তুলনামূলকভাবে রাফাল কিংবা কৃষক অথবা কর্মসংস্থান ইত্যাদি ইস্যুতে সরাসরি নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। কারণ আক্রমণ করলেই আশংকা করা হচ্ছে যে পাল্টা সরকারপক্ষ বলতেই পারে বিরোধীরা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের ঐক্যবদ্ধ চেহারা দেখাতেও অপারগ। সাধারণ মানুষও এই সময় সরকারকে একইভাবে আক্রমণ করাকে কী চোখে দেখবে সেটা নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্ত বিরোধীরা। তাই সবদিক থেকেই একটা অ্যাডভান্টেজ সিচুয়েশন এসেছে মোদির কাছে। সরকারের কাছে। এবং অবশ্যই বিজেপির কাছে। কারণ এভাবে চললে লোকসভা ভোটে যথেষ্ট এগিয়ে থাকা যাবে। আর বিরোধীদের কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে মোদিকে কীভাবে আক্রমণ করা হবে সেই ইস্যু স্থির করা। যে মোমেন্টাম নিয়ে গোটা মোদি বিরোধিতা চলছিল সেটা যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছে এই যুদ্ধ যুদ্ধ আবহে। সুতরাং আপাতত বিরোধীদের কাছে রাজনৈতিক কুশলতার একটি চরম পরীক্ষা উপস্থিত যে এমনভাবে মোদি ও বিজেপিকে আক্রমণ করতে হবে, যাতে তাদের গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা দেওয়া না যায়, আবার তাদের আক্রমণগুলিও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছয়। এই ব্যালান্স করাই অত্যন্ত কঠিন আপাতত। কারণ দেশপ্রেমের আবেগের সামনে সাময়িক সব বিরুদ্ধ যুক্তিই অপ্রতুল হয়ে যায়। সেই সুবিধাটা বিজেপি পেয়ে যেতে পারে। সেই সুযোগও তারা অবশ্যই পুরোদস্তুর নিচ্ছে।
বিরোধীদের যেমন কিছুটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছেন মোদি, তেমন তাঁরও টেনশন কিছু কম নয়। কারণ এই প্রবল প্রত্যাশার চাপ তাঁকে সামলাতে হবে। পাকিস্তান বিরোধিতাকে উত্তুঙ্গ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পর নিছক অর্থনৈতিকভাবে কিছু কঠোব ব্যবস্থা গ্রহণ, কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা, গোটা বিশ্ব পাকিস্তানের নিন্দা করছে, ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া, পাকিস্তানি শিল্পীদের বয়কট...শুধু এসব করে এই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা কিন্তু পূরণ হবে না। সকলেই ধরে নিয়েছে উরি সেনা শিবিরে হামলার পর যে নরেন্দ্র মোদি ওরকম একটি সার্জিকাল স্ট্রাইক করেছেন, এবার তার থেকে দ্বিগুণ কিছু হবে! আর লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে জনমতকে নিজের পাশে রাখতেও ব্যবস্থা গ্রহণের চাপ তাঁর উপর স্বাভাবিকভাবেই বেশি। সুতরাং মোদি অবশ্যই একটা এসপার ওসপার করবেন। এটা তাঁর নিজেকে প্রমাণ করারও একটা সময়। সেই সুযোগ তিনি ছাড়বেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেটা কী? যুদ্ধ? সেক্ষেত্রেও হয়তো নরেন্দ্র মোদির উপর চাপ আছে। কারণ সরাসরি একবার যুদ্ধ হলে অথবা পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে সত্যিই আন্তর্জাতিক মহলের কটা দেশ ভারতের পাশে থাকবে সেটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমেরিকা মুখে অনেক মিত্রতার বার্তা দেয়। তাদের আসল স্বার্থ হল এই ১৩০ কোটির দেশের এই আকর্ষণীয় কর্পোরেট বাজারটিকে ধরে রাখা। অথচ তারা কোনওদিন আজ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারতের পাশে থাকেনি। আবার চীন সরাসরি পাকিস্তানকে সহায়তা করতে পারে। রাশিয়া কী অবস্থান নেবে এখন? সেটাও চিন্তা। ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে তকমা দিয়ে রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তান কোনও সুযোগ পেয়ে যাবে না তো? একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাই এসব সমীকরণও মাথায় রাখতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে। সাধারণ মানুষের ক্রোধ তিনি উপলব্ধি করেন। লোকসভা ভোটের বাধ্যবাধকতাও তিনি অবগত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটা নিয়ে সংশয় নেই। কোনও সন্দেহ নেই হয়তো সেই চিন্তাভাবনাই চলছে প্রস্তুতির পাশাপাশি। বস্তুত সরকার বনাম বিরোধীদের মধ্যে একটি নতুন রণকৌশল নির্মাণের প্রতিযোগিতাও চলছে আমাদের অলক্ষ্যে। বিরোধীদের ভাবতে হবে এবার তারা কীভাবে ঠেকাবেন মোদিহাওয়াকে। আর বিজেপিকে ভাবতে হচ্ছে ঠিক কীভাবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করা যায়। কারণ যুদ্ধ হোক না হোক সামনেই লোকসভা ভোট। সেই লড়াই জিততে মরিয়া উভয় পক্ষ।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাগ অবশ্যই প্রকাশ করব। তবে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার আর সামাজিক আলাপচারিতায় আজকাল যে হাইপার দেশপ্রেমের নামে একপ্রকার গৃহযুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে সেটা কিন্তু আদতে পাকিস্তানেরই কাম্য। কাশ্মীরবাসীদের যদি আমরা বয়কট করি, তাঁদের হেনস্তা করি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মারধর করে কাশ্মীরে পাঠিয়ে দিই, সেটা দেখে কিন্তু সবথেকে বেশি খুশি হবে পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান তো ঠিক এটাই চাইছে যে ভারতবাসী নিজেরাই কাশ্মীরকে ‘অন্য দেশ’ বানিয়ে দিক। তাহলে পাকিস্তানের এত বছরের কাজটা সহজ হয়ে যাবে। কাশ্মীরে যারা ভারতপন্থী, ভারতকে নিজের দেশ ভেবেই থাকেন, ব্যবসা করেন, তারাও বাকি ভারতের এই কাশ্মীর বিরোধিতায় হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এভাবে গোটা কাশ্মীরই যদি ভারতবিরোধী হয়ে যায় সেটায় কার লাভ? পাকিস্তানের। কাশ্মীরকে ভারত বয়কট করছে এরকম ভাবনা পাকিস্তানকে উল্লসিত করবে।
ঠিক সেরকমই যুদ্ধ যুদ্ধ আবহে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু মুসলিম হানাহানির উস্কানি দিলেও কিন্তু আদতে সবথেকে বেশি লাভ পাকিস্তানের। কারণ পাকিস্তান সর্বদাই আনন্দ পাবে যদি তারা দেখে ভারতে গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা হচ্ছে। সোজা কথায় অস্থিরতা চলছে। কিন্তু পাকিস্তান যদি দেখে এরকম চরম টেনশনের সময়ও ভারতে হিন্দু মুসলিম বেশ একসাথে শান্তিতেই থাকছে, ম্যাচিওরিটি দেখাচ্ছে, পাকিস্তানের শত চেষ্টাতেও কোনও হিংসা ছড়াচ্ছে না, তাহলে সেটাই বরং পাকিস্তানি শাসক ও জঙ্গি সংগঠনগুলিকে চরম হতাশ করবে। তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। তারা ভাববে ভারতকে বাইরে থেকে আক্রমণ করেও ভাঙা যাচ্ছে না, আবার ভিতর থেকে প্ররোচনা দিয়েও গৃহযুদ্ধ বাধানো যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, ভারতবাসীকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়াও কিন্তু পাকিস্তানের এক প্রকার প্রক্সি ওয়ার।
তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধনীতি নিয়ে ভাবতে দিন। মোদি সরকার যা করবে নিশ্চয়ই সবদিক বিবেচনাব করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা অপেক্ষা করি। কিন্তু তার পাশাপাশি আসুন আমরা বরং সামাজিক কূটনীতিতে সবার আগে পাকিস্তানের প্ল্যানকে হারিয়ে দিই। দেশবাসী হিসেবে একজোট থেকে। যতই হেট মেসেজ, ফেক নিউজ মোবাইলে আসুক। আমরা ফরওয়ার্ড করব না! ফাঁদে পা দেব না। পাকিস্তান বুঝে যাক ভারত শুধুমাত্র অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জিডিপি আর গণতন্ত্রেই তাদের থেকে শক্তিশালী এমন নয়, ভারত অনেক বেশি ম্যাচিওরড আর বুদ্ধিমানও! সেটাও হবে পাকিস্তানের বৃহৎ মানসিক পরাজয়!