শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
যুগে যুগে ভগবান কোনও এক বিশেষ কারণকে উপলক্ষ্য করে কোনও মাধ্যমের দ্বারা তাঁর ঐশী নির্দেশ মানবের কল্যাণে প্রেরণ করে থাকেন। ওই মাধ্যমকে অবতার, আচার্য, মহাপুরুষ, গুরু সাধক যে নামেই অবিহিত করা হোক না কেন। ভগবানের উক্তি—‘অবজানন্তি মূঢ়া মানুষিং তনুমাশ্রিতম পরম ভাবমজানন্তো মম ভূত মহেশ্বরম’। তাঁর উক্তি—আমি স্বয়ং না জানালে বা না ধরা দিলে বা না বললে কেউই আমাকে দর্শন করতে বা আমার কথা শ্রবণ করতে বা আমার আদেশ নির্দেশ অবগত হতে পারে না। যুগে যুগে কত সাধক মহাপুরুষ অবতারগণকে অবলম্বন করেই আমার ভক্ত কল্যাণের বাণীর প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধন ত্যাগ তিতিক্ষা শ্রদ্ধা ভক্তির বিচ্ছুরণে বিবেক বৈরাগ্যের তীব্রতায় জগৎ জেনেছে নিরাকার আমিকে। দেখেছে নিরাকারের সাকার রূপকে। আমি সাড়া দিয়ে থাকি যুগসন্ধিক্ষণে। আমি যে ভক্তির ডোরে বাঁধা। ভক্ত হৃদয়ে যে কত আর্তি জাগে তা জেনে আমি বিচলিত হই। নিরাকার আমি তখন সাকার হওয়ার তাগিদ অনুভব করি। আমার ভক্তই কেবল বলে, ঠাকুর তুমি আছো, আছো আমার হৃদয়গুহায়। কত ধ্রুব কত প্রহ্লাদ কত রামপ্রসাদ কত বামাক্ষ্যাপা অঝোরে কাঁদে আমার তরে। তখন আর স্থির থাকতে না পেরে আবির্ভূত হই। তখন ভক্তকুল ছুটে আসে আমাকে স্পর্শ করতে। এ যুগও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই আমি এবার আসি ভক্তযুগলের গৃহে, নাম তাদের বিষ্ণুচরণ ও সারদা। ধাম তাদের বাজিতপুর। আমি আসি বিনোদ সাধু নামে। এরূপ শরীর হয় আমার শিব শরীর। শিশুকাল থেকে সদা তাই শিব শরীরধারী শিবভাবে আত্মভাবে সমাহিত থাকে বিনোদ। শিব শরীরধারী বিনোদ কথা বলতে থাকে গুনে গুনে, কেবল প্রয়োজনে। বিনোদ বলতেন অতি কথা বাজে কথা বলায়। শিব পূজা ইন্দ্রিয় সংযম, বাক সংযম, দৃষ্টি সংযম, আহার সংযম সত্য রক্ষাই আদর্শ মানব জীবনের চাবিকাঠি। এ চাবি দিয়েই জীবনের এক স্তর থেকে স্তরান্তরে এগিয়ে যাওয়া। শরীর রক্ষায় তিনি যোগ যাগ ব্যায়াম চর্চা কঠোরভাবে পালন করে অন্যদের সেভাবে থাকতে পরামর্শ দিতেন। বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস কালে আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কখনও উৎসাহী বিদ্যার্থীদের আত্মজীবন ও শরীর গঠনের আলোচনায় একটু সময় দিতেন। অতঃপর গুরু গ্রহণের বাতাবরণ তৈরি করেন স্বীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মধ্যে এতদ্ বিষয়ে প্রেরণা সঞ্চারের মাধ্যমে। এক দিকে শিক্ষক মহোদয়ের অন্তরে স্বীয় আদর্শমুখী করার উদ্যোগ, অন্য দিকে স্বীয় গুরু গ্রহণের উদ্যোগ আয়োজনের দায়িত্ব অর্পণ করা। সঙ্গে সমাজে সেবার বাতাবরণ তৈরি করা। সেবার প্রথম প্রয়াস শুরু হয় শিক্ষার প্রসারে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এই সেবাভাবের প্রচারে জনসাধারণ তাঁর ভাবে দ্রুত আকর্ষিত হতে থাকেন। তিনি হয়ে উঠলেন একজন দরদি অতি আপনজন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবার গুরু গম্ভীরানন্দজির সংস্পর্শে পৌঁছে গেলেন। কারণ গুরু ব্যতীত শিক্ষা অসম্পূর্ণ। গুরুই পারেন শিষ্যের অন্তরে জ্ঞানাগ্নি জ্বালাতে। আবার গুরু অপেক্ষায় থাকেন চিহ্নিত শিষ্যের অপেক্ষায়। তাই গুরু চিহ্নিত সন্তানকে পেয়েই স্বীয় যোগআধার এক-এক করে অর্পণ করতে থাকেন শিষ্যের হৃদয়ে। এ সময় চলে ব্রহ্মচর্য্য জীবন। কালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পর্যায়ক্রমে অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্ন্যাসীগুরু স্বামী গোবিন্দানন্দজির থেকে সন্ন্যাস নিয়ে হলেন তিনি স্বামী প্রণবানন্দ। এবার চলে কঠোর যোগযাগ, যার দ্বারা অভিষ্ট পথে চলা শুরু। এবার সমাজের তীর্থস্থানগুলির সংস্কার সাধনে তৎপর হলেন স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ। কারণ তীর্থস্থানই হল মানবের ধর্ম ও সদাচারে যুক্ত করার স্থান। তাই গয়াধামকে দিয়েই এ সংস্কারের তরী ভাসিয়ে দিলেন। এ তরি অতি দ্রুত পৌঁছল একে একে কাশীধাম, প্রয়াগধাম, পুরীধাম, হরিদ্বার, বৃন্দাবনধাম, নবদ্বীপ। কুরুক্ষেত্র থেকে সংস্কারের দিক ও গতি পরিবর্তন করলেন। নব নব ভাবে, নব চেতনায় এ সংস্কার প্রক্রিয়া ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। আজ তা ভারতের প্রাদেশিক গণ্ডি অতিক্রম করে চারদিকে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, রামেশ্বরম, কন্যাকুমারী, তারাপীঠ, দ্বারকা, কেদার, বদ্রী, গঙ্গাসাগর, ব্যাঙ্গালোর অতিক্রম করে তা অদূর কেন্দ্রসমূহের প্রতি ধাবমান। এই সব আশ্রমে বছরে একবার সব শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে নানা দেব-দেবীর পূজা উৎসবের আয়োজন হয়। স্থানে স্থানে মানবের মহামিলনের উদ্দেশে মানবজীবনে ধর্মভিত্তিক নৈতিক আদর্শমূলক আলোচনাসভাকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। উৎসবে উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের আয়োজন করা হয়, সেইসঙ্গে মানব প্রাণে ধর্মসাধনার বীজ বপন করা হতে থাকে। এভাবে তিনি মানবের মধ্যে মহাজাগরণ, মহাসমন্বয়, মহামিলনের সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক ভক্তদের ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার আয়োজন ও তারমাধ্যমে মহামুক্তির পথে পরিচালিত করতে থাকেন। তাই তিনি বারবার বলছেন, ‘মানুষ চাই, প্রকৃত মানুষ চাই’।
আজ বহু মানুষ বিপথগামী, তারা যেন ভোগ লালসায় সতত ডুবে যাচ্ছে। কে কী করবে তা বুঝতে পারছে না, কারণ সে তো তার নিজস্ব সত্তাকে ভুলতে বসেছে। কেন সে পৃথিবীতে এসেছে, কী করতে এসেছে, কত দিন এই ধরাধামে থাকবে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল দাও দাও আর ভাবছে বুঝি আমিই চারকাল থাকব ও এই ভাবে ভোগ-সমুদ্রে ভেসে বেড়াব। তা হয় না, এই পথ থেকে মুক্তি দেবার জন্য স্বামী প্রণবানন্দ মানুষের মধ্যে মহাজাগরণ চেয়েছেন, চেয়েছেন মানুষ নিজেকে জানুক, তার নিজের আত্মসত্তার জাগরণ ঘটুক। তবে সে প্রকৃত মানুষ হবে। তাহলে এই মানবজাতির মধ্যে মারামারি, হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ দূরীভূত হবে। সে প্রকৃত শান্তি ও সুস্থিতি লাভ করবে।
আজ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা যুগাবতার স্বামী প্রবণানন্দজি মহারাজের আবির্ভাব তিথি। তাই তাঁর এই পুণ্য আবির্ভাব তিথিতে স্মরণ করি মহান আচার্যের মহান বাণী ‘এ যুগ মহাজাগরণের যুগ, এ যুগ মহাসমন্বয়ের যুগ, এ যুগ মহামিলনের যুগ, এ যুগ মহামুক্তির যুগ।’ তিনি মহাসমন্বয় চেয়েছেন, কেবল অনেক কিছু দিলেই কিছু হবে না। দেশ নেতারা তো প্রচুর দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। কিন্তু কী হল? কেন এই জগৎবাসীর এত অবক্ষয় অধঃপতন। তা দেখলে দুঃখ-কষ্ট হয়। তাই আজ স্বামী প্রণবানন্দজির মহাজাগরণ চাই। মানুষের অন্তরসত্তার মহাজাগরণ ঘটলে সে প্রকৃত মানুষ হবে। তখন সে তার আত্মিক মানবসত্তাকে বুঝবে এবং সে প্রকৃত অমৃত তত্ত্ব লাভ করবে।
মাঘী পূর্ণিমার পুণ্য আবির্ভাব তিথিতে তাঁর শ্রীচরণে প্রার্থনা করি—হে আচার্য, হে জগৎ গুরু তোমার আশীর্বাদে জগতের সমস্ত ধনী, নির্ধন, জ্ঞানী, মূর্খ, হীন, দরিদ্র, শিক্ষক, ছাত্র, দেশনেতা, স্বামী-স্ত্রী সকলে যেন এই প্রকৃত তত্ত্ব জেনে শান্তি ও সুস্থিতি লাভ করতে পারে।