শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
ঘটনা ২: অ্যান্ড্রু সিয়েৎসমা। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে হর্টিকালচারের ছাত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি একটি ছবি পোস্ট করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘ভূতুড়ে আপেল’। কেন ভূতুড়ে? আপেলটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ... যেন বরফের তৈরি। এপার ওপার ভেদ করে সব দেখা যাচ্ছে। এমনও হয় নাকি? কিন্তু সেটাই হয়েছে। হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দেওয়া বৃষ্টিটা থামা মাত্র আশপাশের সবকিছু মুহূর্তে বরফে ঢেকে গিয়েছিল। সাহস করে বাইরে এসেছিলেন অ্যান্ড্রু। আপেল গাছটাকে একটু ঝাঁকিয়েছিলেন। তখনই বেশিরভাগ আপেল ডাল থেকে সোজা মাটিতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে কয়েকটির ভিতরটা খানিক পচে নরম হয়ে ছিল, তারা ভাঙেনি। শুধু জমে থাকা বরফের খোলস ছেড়ে স্বচ্ছ আপেল বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। ‘ভূতুড়ে’...।
ঘটনা ৩: শহরটার নাম সিডার র্যাপিডস। মার্কিন মুলুকের আইওয়া রাজ্যের মধ্যে কোথাও একটা। কলকাতা থেকে সেখানে চাকরিসূত্রে গিয়েছেন অরিন্দম। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ঠান্ডার দাপট শুরু হয়েছে। আর ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে চারদিক ধবধবে সাদা। বাড়ির সামনে দেড় ফুট বরফের আস্তরণ। স্ত্রী-পুত্র সমেত গৃহবন্দি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বুঝে সাত-আটদিনের মতো বাজার করে রেখেছিলেন। চারদিন কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে দিন দুয়েক বাইরের তাপমাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল মাইনাস ৩৪ ডিগ্রিতে। পরিস্থিতি এমন যে, ঘরের হিটার সিস্টেমও ধুঁকছে। ভিতরের তাপমাত্রা নেমে এসেছে ৭ ডিগ্রিতে। আবার টানা অনেকক্ষণ হিটার চালিয়েও রাখা যায় না... শরীরের জল শুকিয়ে যেতে থাকে। অপেক্ষা এখন শুধু তাপমাত্রায় যোগচিহ্ন দেখার। আর তারও আগে... একবার বাজার করার সুযোগ চাই।
ঘটনা ৪: খুব সাধারণ শিলাবৃষ্টি নয়! বরফ সদৃশ যে টুকরোগুলো মাধ্যাকর্ষণের টানে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল, তাদের আকৃতিও একটু বড়র দিকেই। দিল্লি-নয়ডার বাসিন্দারা অনেকেই আবার ভেবেছিলেন তুষারপাত হচ্ছে নাকি! বাস্তবটা তেমন কিছু না হলেও সব থেমে যাওয়ার পর রাস্তা দেখে হঠাৎ তুষার বলে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিউবের আকৃতির টুকরোগুলো এক হাত ভর্তি করে তুলেছিলেন অনেকেই। মাথায় পড়লে আহত হওয়ার মতোই। জলবায়ু বদলাচ্ছে...।
মনে হতেই পারে শিকাগো বা কটন শহরের ঠান্ডার সঙ্গে দিল্লির শিলাবৃষ্টির কী সম্পর্ক? আসলে শুধু শিলাবৃষ্টি নয়, শীতের দাপটটাই একে অপরের সঙ্গে দূরের কোনও সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে। ২০০৪ সালে হলিউডে একটা ছবি মুক্তি পেয়েছিল—ডে আফটার টুমরো। তাতে দেখা গিয়েছিল, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে সেমিনার হচ্ছে দিল্লিতে। ঠিক সেই সময় রাজধানীর রাজপথে তুষারপাত। যা আমরা এখনও হয়তো ভাবতে পারি না। বিশ্ব উষ্ণায়ন কীভাবে আমাদের আইস এজ বা তুষার যুগের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, সেই থিওরির উপর ভিত্তি করেই বানানো হয়েছিল সিনেমাটি। আজ যখন আচমকাই উত্তর গোলার্ধের একটা বড় অংশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা মাইনাসের অনেক নীচে নেমে যাচ্ছে, চর্চাটাও বাড়ছে—আমরা কি তাহলে তুষার যুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি?
তুষার যুগ বলতে এখানে যা কল্পনা করা হচ্ছে... মানে, বরফে ঢাকা চারদিক, আচমকা ঠান্ডায় সবকিছু জমিয়ে দেওয়া, ফ্রস্ট বাইট হয়ে মৃত্যু... তেমন কিছু এখনই হবে বলে বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত দেননি। যে তীব্র ঠান্ডার প্রভাবটা উত্তর গোলার্ধ, বিশেষত কানাডা এবং আমেরিকার একটা অংশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেটির কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে পোলার ভর্টেক্সকে। এখন প্রশ্ন হল, কী এই পোলার ভর্টেক্স? সোজা কথায় এ হল একটি নিম্নচাপ বিশিষ্ট ক্ষেত্র, যার ব্যাস হাজার কিলোমিটারের মতো হয়। বিরাট ঘূর্ণি, বা বড়সড় সাইক্লোনের মতো বললেও খুব ভুল হয় না। পৃথিবীতে দু’টি পোলার ভর্টেক্স কার্যকর। একটি উত্তর মেরুতে, আর অন্যটি দক্ষিণে। উত্তর মেরুতে পোলার ভর্টেক্স ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরে, আর দক্ষিণ মেরুতে ঘড়ির কাঁটার দিকে। কিন্তু দুই মেরুকেই পূর্ব দিকে অভিমুখ করে প্রদক্ষিণ করে পোলার ভর্টেক্স। এর অবস্থানটা হয় বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের অংশ থেকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার পর্যন্ত। পোলার ভর্টেক্সকে ঘিরে থাকে জেট স্ট্রিম। অত্যন্ত দ্রুতগতির বায়ুপ্রবাহের ক্ষেত্র। মেরু অঞ্চলে এই ধরনের বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ সবথেকে বেশি হয়। ঘণ্টায় প্রায় ১০০ মাইল। মেরুপ্রদেশের একটা সীমানা বরাবর পোলার জেট স্ট্রিমের ক্ষেত্র কার্যকর।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এই ধরনের বায়ুপ্রবাহের তীব্রতা নিত্যদিন একটু একটু করে বাড়ছে। আর পাশাপাশি অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলে দিচ্ছে সুমেরু সাগরে জমে থাকা বরফের চাদরকে। উত্তর মেরুর পোলার ভর্টেক্স যত শক্তিশালী হয়, ততই সে সুমেরুর তীব্র ঠান্ডাকে জেট স্ট্রিমের সীমানা পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে আসতে বাধা দেয়। এবং তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে। শীতকালে মেরু অঞ্চল অন্ধকার থাকে। এর কারণ হল পৃথিবীর সামান্য হেলে থাকা অবস্থান। সূর্যের আলো তখন আর মেরু অঞ্চলে পৌঁছয় না। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিন হাউস গ্যাসের দৌলতে পৃথিবীর অন্যান্য অংশ গরম হলেও ততধিক ঠান্ডা থাকে এই এলাকা। এর মাঝেই যদি বায়ুমণ্ডল স্বাভাবিকের থেকে বেশি গরম হয়ে যায়, তখনই কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ে পোলার ভর্টেক্স। আর দু’টি বা তিনটিতে ভেঙে যায়। তখন অলিখিত সেই সীমানা পেরিয়ে তীব্র ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর গোলার্ধে। যেমনটা এবার হয়েছে।
এবার স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার হঠাৎই স্বাভাবিকের থেকে বেশি উষ্ণ হয়ে গিয়েছে। ফলে গতিপথ এলোমেলো হয়েছে পোলার ভর্টেক্সের। যে ঠান্ডাটা আর্কটিক সার্কলের মধ্যে আটকে থাকে, তাকে সে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে মার্কিন ভূখণ্ডে। যদিও দেশের সর্বত্র নয়! উত্তরভাগে যখন এখানে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা অনুভব হচ্ছে, তখন ফ্লোরিডার কিছু অংশে বেশ গরম। অর্থাৎ তাপমাত্রা তার ব্যালান্স হারাচ্ছে। যার জন্য দায়ী?
পরিবেশ দূষণ। যার থেকে জলবায়ু পরিবর্তন।
প্রতি দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে .২ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ছে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা যতই বাড়বে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকবে পৃথিবীর হিমশীতল মেরু অঞ্চলের পরিধি। প্রভাব পড়বে জেট স্ট্রিমের উপর। এই বায়ুপ্রবাহ আরও উষ্ণ হবে। আর তখনই ঠান্ডাকে সুমেরু বলয়ের মধ্যে আর আটকে রাখা যাবে না।
এই পোলার ভর্টেক্সের প্রভাব কি ভারতেও পড়েছে? এবার উত্তর ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ঠান্ডার জন্য আবহাওয়াবিদরা কিছুটা হলেও পোলার ভর্টেক্সকে দায়ী করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোলার ভর্টেক্স দুর্বল হয়ে ঠান্ডাটাকে আমেরিকা ও ইউরোপের উত্তরভাগে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। আর তার ধাক্কায় দক্ষিণের দিকে চলে এসেছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। এমনিতে বছরে চার থেকে ছ’টি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ভারতীয় উপমহাদেশে এসে ধাক্কা খায়। চলতি বছর সেই সংখ্যাটা সাত। যার জন্য শীতের প্রকোপ বেড়েছে ভারতে। মূলত হিমালয় এবং তার সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে। জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে অসময়েও ব্যাপক তুষারপাত হয়েছে। আর যে সময়ে ঠান্ডার তীব্রতা কমে যাওয়ার কথা, সেই সময়টা পার হয়ে গেলেও শীত পিছু হটেনি।
চরমপন্থী আবহাওয়া...। পৃথিবী এখন মোটামুটি সেই পথেই হাঁটছে। প্রচণ্ড গরম, আর নিদারুণ ঠান্ডা। পোলার ভর্টেক্সের দরুণ এই গ্রহের নতুন নতুন জায়গায় আচমকা ঠান্ডা বাড়ছে। এই প্রবণতা আরও ছড়াবে বলেই আশঙ্কা করছেন বৈজ্ঞানিকরা। এর পাশাপাশি উদ্বেগের আরও কারণ রয়েছে। কারণ, বায়ুমণ্ডলে বাড়তে থাকা গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়ছে। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। সমুদ্রে ভাসমান বরফ বা হিমবাহ যত কমবে, ততই সূর্যের বিকিরণ ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হারাতে থাকবে পৃথিবী।
কারণ, বিকিরণ এবং অতিবেগুনি রশ্মি মহাকাশে ফিরিয়ে দেওয়া বা শুষে নেওয়ার কাজটা মেরু সাগরে ভাসমান বরফের স্তর রীতিমতো দায়িত্ব নিয়ে করে থাকে। এই সব মিলিয়ে একদিকে যেমন শিকাগো, মিশিগানের তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নীচে নেমে যাচ্ছে, পাশাপাশি নরওয়ে, উত্তর ফ্লোরিডার গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। এ এক অদ্ভূত বৈপরীত্য।
আমরা গবেষণা করছি, উদ্বিগ্ন হচ্ছি বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে। আবার এই গ্রহেরই নানা অংশে ঠান্ডায়
জমে প্রাণও দিচ্ছি। সবটাই আচমকা। আশাতীত। পরিবেশ দূষণ এবং উষ্ণায়ন মানব জাতিকে এক আজব সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে। চমক কিন্তু আরও বাকি...।