পুজো মানে বৃষ্টি ধোয়া শরৎ নীলাকাশ/ পুজো মানে শিউলি ফুলের গন্ধে ভরা বাতাস/ পুজো মানে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা/ পুজো মানে দিঘির বুকে কাশ ফুলেদের মেলা/ পুজো মানে শিশির ভেজা শিউলি ফুলের দল/ পুজো মানে ঢাকের তালে তাক ধিনা ধিন বল... পুজো মানে দুঃখ ভুলে হারিয়ে পাওয়া সুখ/ পুজো মানে আনন্দেতে ভরবে সবার বুক/ পুজো মানে বিভেদ ভুলে ধর্ম যে যার যার/ পুজো মানে একত্রিত উৎসব যে সব্বার। এক কবির কল্পনায় শারদোৎসবের এই ছবি গঙ্গা-পদ্মা-আরব সাগরের সীমানা ছাড়িয়ে টেমস নদীর তীরে আছড়ে পড়েছে। শাস্ত্র মতে দেবীর বোধন হয়েছে ষষ্ঠীতে। কিন্তু বাঙালি আর কবে পুরোপুরি শাস্ত্র মেনে চলেছে! আশ্বিনের শারদ প্রাতে মহালয়ার পুণ্যলগ্ন থেকেই উৎসবপ্রিয় বাঙালি রাজপথের দখল নিয়েছে। গত দু’বছর উৎসবের প্রাণখোলা আনন্দে যেন বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল ছোট অথচ ভয়াল ভাইরাস করোনা। তার দাপাদাপিতে বিধিনিষেধের প্রাচীর তুলতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন। সাজপোশাক ও প্রসাধনে মাস্ক ও স্যানিটাইজারকে সম্বল করে প্রতিমা দর্শন করতে হয়েছিল। দর্শনার্থীদের হাতে হাত ধরাধরি করে দলবদ্ধ হয়ে ঠাকুর দেখা নয়, বরং একের সঙ্গে অপরের শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছিল প্রতিমা দর্শন। সেই দমবন্ধ পরিস্থিতি এবার নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। উপরন্তু বাঙালির দুর্গাপুজো এবার ইউনেস্কোর শিরোপা পেয়েছে। তার আতিশয্যে একমাস আগে গত পয়লা সেপ্টেম্বর মহানগরীর রাজপথ দেখেছিল শারদোৎসবের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সেই রেশ ধরেই এবার যেন বাড়তি উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা। আকাশবার্তা দিয়ে হাওয়া অফিস জানিয়েছে ষষ্ঠী থেকে দশমী কলকাতা সহ রাজ্যে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে অবশ্য বয়েই গেছে, বরং মহালয়ার দিন থেকেই যেন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর জনপ্লাবন দেখা গিয়েছিল মণ্ডপে মণ্ডপে। উৎসবের এই চড়া সুর বেঁধে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোথাও নিজে উপস্থিত থেকে, কোথাও ভার্চুয়াল মাধ্যমে রেকর্ড সংখ্যক পুজোর উদ্বোধন করেছেন তিনি। সর্বধর্ম সমন্বয়ের এই উৎসব যেন তাঁর উদ্যোগে বাড়তি মাত্রা পেয়েছে।
শুধু তাই নয়, গত কয়েক মাস নানা ইস্যুতে বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলির যে আকচা-আকচি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল বাংলার মানুষ, মর্তে মৃন্ময়ীর আগমনে তা যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গিয়েছে। রাজনীতিকরাও ভিন্ন মুডে। লড়াইকে আপাতত দূরে সরিয়ে রেখে সর্বত্র সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের বার্তা দেখা যাচ্ছে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা জায়গায়। দেখা যাচ্ছে মণ্ডপে মণ্ডপে কোলাহল, নতুন পোশাকের পাটভাঙা শব্দ, সেলফির হুড়োহুড়ি। আরও দেখা যাচ্ছে রাত পেরিয়ে কাকভোর পর্যন্ত ক্লান্তিহীন শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার অদম্য জেদ, শারদীয় পত্রিকার গন্ধ, অন্দরমহল থেকে রেস্তরাঁয় কব্জি ডুবিয়ে আহারের চিরাচরিত ছবি। আনন্দ আর উন্মাদনা হাতে হাত ধরে চলেছে।
তবে এটাই গোটা বাংলার ছবি নয়। আলোর শেষে অন্ধকারও উঁকি মারে। কবির কথায়, এক দুর্গা রিকশা চালায় কুচবিহারের হাটে/এক দুর্গা একশো দিনের কাজে মাটি কাটে/ এক দুর্গা রাস্তা বানায় পিচ ও পাথর ঢাকে/ এক দুর্গা রোজ চুনোমাছ ধরছে বিলে-খালে/ এক দুর্গা খিদেয় কাঁদে, পায়নি খেতে আজ/ সবাই জানি এদের কারো হয় না কোনও পুজো/এরা তো মা তোমার মতো নয়কো দশভুজো/ সব দুর্গার চোখে-মুখেই ফুটবে হাসি কবে? মা গো, তোমার পুজো সেদিন সত্যি সফল হবে। মায়ের কৃপায় তাদের মুখে হাসি ফুটুক। এ তো আমাদেরই প্রার্থনা। আনন্দে মাততে গিয়ে এদের কথাও আমরা যেন ভুলে না যাই। সকলের জন্য শারদ শুভেচ্ছা রইল। পুজোয় আনন্দ করুন, সুস্থ থাকুন। সকলে ভালো থাকবেন।