যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
আশ্বিন প্রাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী রেডিওতে বাজতেই ধরণীর অন্তর ও বহিঃআকাশ বদলের সঙ্গে তাল রেখেই বাঙালি মন আবারও তাই পুজোমুখী। বিশ্বের দরবারে দুর্গাপুজোর অনন্য স্বীকৃতি এবারের উৎসবকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই উৎসাহ থেকেই জাতপাত ভুলে বর্ধমানের পুজো সফল করতে ছুটছেন মহম্মদ ইসমাইল। অন্ডালে একই ভূমিকায় মহম্মদ ফিয়াজ। ওদের ধর্ম যাই হোক, নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই এই পুজোয়। নিঃসন্দেহে এক বিরল দৃশ্য। এই একটা উপলক্ষ, যার জন্য দেওয়াল লিখতে হয় না, মাইকে সকাল বিকেল গর্জন করতে হয় না। বিজ্ঞাপন দিতে হয় না। ‘ব্রিগেড চলুন’ পোস্টার সাঁটাতে হয় না। স্ট্রিট কর্নার করতে হয় না। পাঁজি, নির্ঘণ্ট কোনও কিছুর খোঁজ না রাখলেও আপনাআপনি মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই পেঁজা তুলোর মতো উড়ে যায় এক মণ্ডপ থেকে অন্যত্র একান্ত প্রিয়জনের হাত ধরে। কেমন যেন একটা মন হারানো সুর কড়া নাড়ে দরজায়। সবার অজান্তেই ‘মা আসছেন’, এই অমোঘ ধ্বনি পৌঁছে যায় ধনীর সাতমহলা থেকে কুঁড়েঘরের ভগ্ন দালানের চুনসুরকি খসা কড়ি-বরগায়, টালির চালে। এঁদোগলি থেকে রাজপথের সর্বত্র। ম্যাজিকের মতো আপামর বাঙালির এই চারদিনের বদলে যাওয়া জীবন চর্চায় ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, তৃণমূল, বিজেপি, বাম কোনও বিভেদই কাজে আসে না। খামতি ঢাকতে রাজনৈতিক দলগুলো জনসংযোগে ঝাঁপায় বটে, তাতে যেন কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই মানুষের। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার—এই আপ্তবাক্যটির মর্মার্থ আর কোনও সময় এমন জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে না দৈনন্দিন যাপনে। এই ক’দিন কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া আমাদের একটাই পরিচয়—বাঙালি। সেই আবহমান সংস্কৃতির এমন উচ্চকিত উদযাপন আর কোথায় মেলে? কেউ জানলে সন্ধান দেবেন। সেইসঙ্গে রাজনীতির ওস্তাদ কারবারিদের কাছে প্রশ্ন, তাঁরাও তো চেষ্টা করলেই মানুষকে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত করার বদলে একই বৃন্তে ঠাঁই করে দেওয়ার প্রয়াসে ব্রতী হতে পারেন? কিন্তু তা করেন না কেন? রাজনীতির সুখ কি শুধু ভাঙনেই? বোধ আর অনুভবকে ভোঁতা করে মানুষে মানুষে সুদীর্ঘ প্রাচীর তুলে দেওয়ায়!
যত দিন যাচ্ছে পুজো ততই এগিয়ে আসছে। চার নয়, দশদিনের উৎসবে পরিণত হচ্ছে। আমাদের ছোটবেলায়ও ষষ্ঠীর আগে বড় একটা ঠাকুর দেখার চল ছিল না। আস্তে আস্তে তার ব্যাপ্তি বাড়ছে। গতবারও তৃতীয়া-চতুর্থীর আগে ফুটপাত লাগোয়া বাঁশের বেড়ার ঘেরাটোপে মানুষকে বড় একটা হাঁটতে দেখিনি। আর এবার মহালয়া কিংবা তারও আগে থেকেই ঠাকুর দেখার ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ ঠাকুর কুমোরটুলি থেকে মণ্ডপে চলে গিয়েছে মহালয়ার মধ্যেই। কোথাও থিম তো কোথাও আবার সাবেকিয়ানার জয়গান, সর্বত্রই আয়োজন সম্পূর্ণ। মহালয়া থেকেই সব দুঃখ, পরাজয়, ব্যর্থতা, না-পাওয়া ভুলে মানুষ হেঁটে চলেছেন—দেবীদর্শনে, না নিজেকে এই আনন্দোৎসবের অকৃত্রিম যাত্রায় শামিল করতে। সেই ভিড়ে ধর্ম সম্প্রদায় কোনওদিন প্রাচীর হয়ে ওঠেনি। দেওয়াল তুলে দেয়নি কোনও রাজনৈতিক রং। একই কারণে, এই রবিবার থেকে একটা সপ্তাহ যাবতীয় চর্চা আর আড্ডাতেও পুজো ছাড়া আর কিছুই ঠাঁই পায় না বঙ্গজদের সুসজ্জিত ড্রইংরুম থেকে আটপৌরে চায়ের দোকানে। মা যতক্ষণ মর্তে, রাজনীতির কূটকচালি নেতাদের জারিজুরি, ভোলবদল, ডিগবাজি সব ব্রাত্য!
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় উত্তর কলকাতার টালাপার্কে দেখেছি, দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কেমন একই লাইনে সারিবদ্ধভাবে এগচ্ছেন প্রত্যয়ের সঙ্গে মায়ের ভুবনভোলানো মুখ চাক্ষুষ করতে। একই ছবি পার্কসার্কাসেও। শ্রীভূমি, একডালিয়া, চালতাবাগান, সুরুচি সঙ্ঘ, কলেজস্ট্রিট, চেতলা অগ্রণী সর্বত্র। শুধু বদলে যায় স্থান-কাল, আঙ্গিক আর সাজ। আসলে সবটাই যেন একই ক্যানভাসের অংশ। সব ভুলে কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে চেটেপুটে নিতে চায় এই আনন্দযজ্ঞের ভাগটুকু। কোনও রাজনৈতিক সভা নয়। নানা ছুতোয় বিক্ষোভ দেখানোর দু’শো ফিরিস্তিও নয়, স্রেফ একটা পুজো কত কাছে নিয়ে আসতে পারে সব রং, সব আয় ও ধর্মের মানুষকে। আমাদের নেতানেত্রীরা যখন ক্রমাগত বিভাজনের তাস খেলেন, মানুষে মানুষে দূরত্ব রচনা করে ভোট কুড়নোর খেলায় মত্ত হয়ে ওঠেন, কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে জিতে যায় বাঙালির এই উৎসব। এই মিলনমেলা ছাপিয়ে যায় স্বার্থান্বেষীদের চক্রান্ত থেকে যাবতীয় ব্যক্তিগত দুঃখ আর চোখের জলের নির্মম আর্তিকেও।
করোনায় মারা গিয়েছে বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছেলে অনির্বাণ। সেই কুড়ি সালের আগস্ট থেকে ও বাড়িতে আলোটা কেমন ম্লান। একুশের শ্রাবণে ভালো পাত্র দেখে ঘটা করে বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তুষার ভট্টাচার্য। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব পাঠ চুকিয়ে মেয়ে ফিরে এসেছে বাপের ঘরে। অনন্তবাবু অনেক কষ্ট করে সারাজীবনের সঞ্চয় ভাঙিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। কিন্তু বিদেশে চাকরি পেয়ে ছেলে ওখানেই বিয়ে করে সেটল করেছে। আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে মনে রাখেনি। অনন্তবাবু ও তাঁর স্ত্রী এখন নিঃসহায়। কোনওক্রমে ডালভাতটুকু জুটে যায়। ওষুধের খরচেও বেজায় টান। পোস্ট অফিসের ওই ক’টা টাকায় আর কী হয়! এই সব হাজারো ক্ষয় আর সব হারানো সর্বনাশের গল্প থেকে একটুকু আলোর ছোঁয়া আর স্বস্তি দিতেই যেন আবির্ভাব হয় তাঁর। বিশ্বজননীর। সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষ থেকে উত্তরে চা বাগানের শীর্ণ শ্রমিক সবার রক্তেই একটু জীবন খেলে যায়। বাংলার সীমা ছাড়িয়ে সব দেশে সব কালে সর্বজনীন তাঁর আবেদন। এই গ্রহে যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই।
মহাসপ্তমীর এই পুণ্য মুহূর্তে কামনা একটাই, এই আলো আর উৎসবের বন্যায় ভেসে যাক যাবতীয় দুঃখ আর না-পাওয়ার অন্ধকার। অমৃত ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ুক প্রত্যেকের জীবনে। পুজো সবার ভালো কাটুক, শান্তিতে কাটুক। দেবীর মুখের দীপ্তি আর আলো যাবতীয় অন্ধকার ঢেকে দিয়ে নতুন ভোর নিয়ে আসুক মর্তলোকে।