যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
কিন্তু এই সুযোগটি তাঁর ছিল না। তাঁর ঠাকুমাকে সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করার পর একদিন সেন্ট কলম্বাস স্কুল থেকে তাঁকে ও জেসাস অ্যান্ড মেরি স্কুল থেকে তাঁর বোনকে দিল্লির সফদরজং রোডের একটি বাংলোয় সেই যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারপর গোটা কৈশোর হয়ে তারুণ্যে প্রবেশ করার পর্বটি একপ্রকার বন্দি জীবন কেটেছে। তাই সহজেই মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা, ইচ্ছে করলেই বন্ধুদের জন্মদিনে অথবা বিয়েবাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি সম্ভব ছিল না। স্পেশাল সিকিউরিটি গ্রুপের উপর নির্ভর করত এই ভাইবোনের সামাজিক জীবন। সাত বছরের মধ্যে একইভাবে তাঁদের বাবাকেও হত্যা করা হয়। তাঁকে আর দেশেই রাখলেন না ভীতসন্ত্রস্ত মা ও বোন। তিনি চলে গেলেন আমেরিকায়। অতএব তাঁর এই দেশটাকে জানা হল না সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টায়।
২০০৪ সালে রাজনৈতিক করিডরে প্রাথমিকভাবে অনিচ্ছাসহকারে সেই যে হাঁটা শুরু করলেন রাহুল গান্ধী, সেই হাঁটা আজও চলছে। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক সাফল্য আসবে কি না সেই উত্তর ভবিষ্যতের কালের গর্ভে নিহিত আছে। কিন্তু সম্ভবত ভারতের সবথেকে কঠিন রাজনৈতিক লড়াইটা তিনি করছেন। একদিকে আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদির মতো প্রবল শক্তিশালী, ক্যারিশম্যাটিক, জনপ্রিয় ও দলের উপর একচ্ছত্র প্রভাবসম্পন্ন নেতানেত্রী। তাঁরা এক ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জমায়েত করেন। তাঁরা হাজারো সমালোচনা ও আক্রমণ সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে নিজেদের ভোটার ও সমর্থকদের কাছে সমানভাবে আরাধ্য হয়ে থাকছেন ভোটের পর পর ভোটে। অন্যদিকে আছেন তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, এম কে স্ট্যালিন, নবীন পট্টনায়ক, জগনমোহন রেড্ডির মতো পৈতৃক রাজনৈতিক পরিচয়ের উচ্চতম পে-ডিগ্রি সম্পন্ন মানুষ এবং তাঁদের একান্ত নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক। তাঁরা প্রত্যেকেই সেই উত্তরাধিকারকে সম্মান দিয়ে তারপর নিজেদের নেতৃত্ব ক্ষমতার মাধ্যমে স্থাপন করতে পেরেছেন। এ এক চরম সফলতা। এছাড়াও আছেন প্রাদেশিক আবেগকে পুঁজি করে ভোটারদের নয়নের মণি হয়ে ওঠা কে চন্দ্রশেখর রাও। ভারতের রাজনীতি আবর্তিত এই তিন ফর্মুলায়।
এই মডেলগুলি থেকে সম্পূর্ণ অনেক দূরের এক নির্জন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী। এই নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে যে, তাঁর না আছে প্রবল জনপ্রিয়তা, না আছে দলে একচ্ছত্র প্রভাব খাটানোর ব্যক্তিত্ব। এমনকী তিনি যে সর্বদা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তাও নয়। এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দলটির ইতিহাস এতই উচ্চমার্গের যে, সেই উত্তরাধিকার বহন করাও এক সাংঘাতিক বড় দায়িত্ব ও মানসিক চাপ। একইভাবে তাঁর পদবিটির ওজন ও ঐতিহ্য সমানভাবে পর্বতপ্রতিম। ঐতিহাসিকভাবে তাঁর দল সবথেকে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর ঠাকুমা দলকে একদা লোকসভা নির্বাচনে ৩৫২টি আসন, তাঁর বাবা চারশোর বেশি আসন এনে দেওয়ার ইতিহাস রচনা করেছেন। আর তাঁর আমলে সেই দল কখনও ৪৪, কখনও ৫২ পেয়েছে।
যাঁর বিরুদ্ধে তাঁকে জাতীয় স্তরে লড়াই করতে হচ্ছে, সেই নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা, বাগ্মিতা, তাৎক্ষণিক হাততালিবান্ধব স্লোগান দেওয়া অথবা চটকদারি আকর্ষণীয় ইমেজের ধারেকাছে তিনি নেই। ঠিক এটাই রাহুল গান্ধীর লড়াইটাকে প্রবল আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অর্থাৎ তাঁর পুঁজি প্রায় শূন্য। নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক নেই, একক জনপ্রিয়তা নেই, একচ্ছত্র প্রভাব নেই, দলে শৃঙ্খলা নেই, নিবেদিতপ্রাণ টিম নেই, যখন তখন যে সে যেকোনও সময় বিজেপির প্রলোভনে পা দিয়ে দলত্যাগ করে চলে যাচ্ছে।
রাহুল গান্ধীর মতো এই কঠিন লড়াইটা আর কেউ লড়ছেন না। কেন তাঁর এই লড়াইটা আকর্ষণীয়? কারণ, তিনি মাঠ ছেড়ে পালাচ্ছেন না। তিনি বারংবার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছেন। বারংবার অপমানিত হচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে প্রচুর হাসিতামাশা হয়। কিন্তু সব সহ্য করে এই শতাব্দীপ্রাচীন দলকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আরও ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়েই যাচ্ছেন। বহু রাজনৈতিক ভ্রান্তি করে, বহু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে, বহুবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে অবশেষে ২০২২ সালে রাহুল গান্ধী সম্ভবত শেষ বাজিটি খেলতে নেমেছেন তাঁর দলের অস্তিত্ব রক্ষায়। দুটি কর্মসূচি। দুটিই চমকপ্রদ। প্রথমত গান্ধী পরিবারের পক্ষ থেকে আর কেউ সভাপতি সভানেত্রী হবেন না কংগ্রেসের। গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কেউ হোক। এটাই অনড় ঘোষণা। আগামী ১৯ অক্টোবরই জানা হয়ে যাবে যে, কে হচ্ছেন পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতি। সিদ্ধান্তটির অভিঘাত বিশেষ করে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির কাছে অনেক বেশি। গান্ধী পরিবারের কেউ যদি সভাপতি পদেই না থাকেন, অর্থাৎ সরাসরি দলের চালিকাশক্তি না হন, তাহলে বিজেপির আাক্রমণের মূল অস্ত্রটিই অনেকটা ভোঁতা হয়ে যাবে। কারণ নরেন্দ্র মোদি অথবা বিজেপির যে কোনও নিচুতলার কর্মী, সকলের টার্গেট গান্ধী পরিবার। কিন্তু যদি অন্য কেউ সভাপতি হন, তাহলে আক্রমণের অভিমুখ এবার স্থির করতে হবে বিজেপিকে।
আর দ্বিতীয় বিস্ময়কর যে কাজটি তিনি হাতে নিয়েছেন, সেটা একপ্রকার বেনজির। কন্যাকুমারী থেকে শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত তিনি হাঁটা শুরু করেছেন। অর্থাৎ এই গোটা পথ তিনি হেঁটে হেঁটে পার করবেন। অবিশ্বাস্য এক কর্মসূচি। কারণ, রথযাত্রা নয়। পদযাত্রা। রাহুল গান্ধী যে পরিবার ও জীবন থেকে উঠে এসেছেন, সেখানে আরাম বিলাস ও সুরক্ষিত এক যাপনই স্বাভাবিক। কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি অথবা ঘটনায় কয়েকদিন একটানা শারীরিক পরিশ্রম করাই হয়। নির্বাচনের সময় সকল নেতা-নেত্রীই তা করেন। কিন্তু কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর হেঁটে চলা এক আশ্চর্য কর্মসূচি। তাও আবার আমাদের সকলের চোখের আড়ালে। ভারতকে চেনার, ভারতকে জোড়ার যাত্রা। অর্থাৎ তাঁর নিজের কথায়, এখন ভারতে বিদ্বেষ ও বিভাজন এতটাই ছড়িয়েছে, তিনি তাঁর বিপরীত পথে হেঁটে ভারতের মূল আত্মার সন্ধান করছেন। রাহুল গান্ধীর এই কর্মসূচি আদৌ কতটা সফল হবে অথবা নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলবে কি না, সেটা সময় বলবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, তিনি চেষ্টা করছেন একটি হেরে যাওয়া লড়াইয়ের ময়দানে আবার প্রাণপণে ফিরতে। আর সেই ফেরার পথটি শর্টকার্ট করতে চাইছেন না। বরং কঠিন। শারীরিক কৃচ্ছ্রসাধন তো বটেই, পাশাপাশি একটি এক্সপেরিমেন্টও। অর্থাৎ এই ধরনের রাজনীতি আদৌ ২০২২ সালে গ্রহণযোগ্য কি না কিংবা সাফল্য পায় কি না এটারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে।
সুতরাং বিস্ময়কর এক পদযাত্রা এবং অগান্ধী এক সভাপতি। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক কেরিয়ারের মোক্ষম দুটি অন্তিম বাজি। তিনি কি পারবেন ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে? পরিবার পারেনি, পদযাত্রা কি পারবে কংগ্রেসের জমি পুনরুদ্ধার করতে?