যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
হাউস অব লর্ডসের আজীবন সদস্য ওয়েন লিখেছেন অনেক বইও। রাষ্ট্রক্ষমতার উৎকট অনাচার নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘ইন সিকনেস অ্যান্ড ইন পাওয়ার’। বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের মনোজগৎ রাষ্ট্রচিন্তায় কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনায় কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা। তিনি এমন শাসকদের খোঁজ দিয়েছেন, যাঁদের কাছে রাজনীতি সত্য, বাকি সব কিছু মিথ্যে। মূল্যহীন। নিজেকে ছাড়া বাকিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও ওইসব শাসকের মনোজগতে অহংবোধ। এতেই তাঁরা আনন্দ উপভোগ করেন। ক্ষমতার চোরাবালিতে সমস্ত গ্লানিবোধ ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নিমজ্জিত হয়।
ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মনোজগতের এই আচরণকে লর্ড ডেভিড ওয়েন বলেছেন ‘হাবরিস সিনড্রোম’। শুধু ক্ষমতায় থাকলেই এই সিনড্রোম দেখা দেয়। হাবরিস সিনড্রোমকে তিনি বিশেষায়িত করে বলেছেন, ‘এই রোগ বাস্তবতার সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়া বেপরোয়া ও অস্থির প্রবণতা। যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে অযোগ্য বলেই প্রমাণিত করে।’ তিনি দেখিয়েছেন ‘হাবরিস সিনড্রোম’ যেসব রাষ্ট্রনেতার রয়েছে তাঁরা বেশি আত্মবিশ্বাসে ভোগেন। নিজেকে জনগণের ঊর্দ্ধে মনে করেন। এসব কারণে অনেক সময় হাবরিস সিনড্রোমে আক্রান্ত ক্ষমতাবানরা রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠেন। তাঁরা শুধু চান লজ্জাহীন স্তাবকতার প্রদর্শনী...।
ইতিহাস জানায়, হিটলার ক্ষমতাবান হওয়ার পর নিজেকে কখনও স্থির রাখতে পারেননি। তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেছিলেন। তাঁর এই চরিত্রের উপর গবেষণা করার জন্য ১৯৪৩ সালে ইউএস অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস এবং সিআইএ-র প্রসিকিউটর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানী হেনরি মুরের উপর। মনোবিজ্ঞানী হেনরি মুর হিটলার সম্পর্কে ২২৯ পাতার রিপোর্ট তৈরি করেন। হার্ভার্টের এই প্রফেসরের মতে, হিটলার প্রতিশোধ নিতে নিতে ‘সিজোফ্রেনিয়ার’ মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অতিমাত্রায় উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। এই কারণে তিনি নিজে যা ভালো মনে করতেন তাই-ই করতেন। কাউকে তোয়াক্কা করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের সময়ে হিটলারের জাত্যভিমানের কারণেই কয়েক লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা একই কারণে।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাই ধরুন। আমেরিকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে উগ্র ও দক্ষিণপন্থী এই নেতা ‘আমরা-ওরা’ বলে গোটা দেশ, বিশ্বকে বিভাজিত করে ফেলেছিলেন। শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদকে উস্কে দিয়েছেন। সংখ্যালঘু অভিবাসীদের দমন-পীড়নের হুমকি দিয়েছেন। খামখেয়ালি এই নেতাও সব কিছুই তাঁর ইচ্ছে মতোই করতেন এবং কারও কাছে কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করতেন না। কাউকে তোয়াক্কাও করতেন না। সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলাই ছিল তাঁর অভ্যাস। শোনা যায়, তাঁর নার্সিসিজম, ডিল্যুশন বা বিভ্রান্তি রয়েছে। এ ছাড়া আছে প্যারানইয়া এবং অল্প পরিমাণে সিজোফ্রেনিয়া। ইয়েলে এক কনফারেন্সে এমনই দাবি করেছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তার গ্রাটনার। বলেছিলেন, মনের অসুখের জন্যই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকার যোগ্যতা নেই। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হোক।
লর্ড ডেভিড ওয়েন বলছেন, হাবরিস সিনড্রোমে ভোগা নেতারা প্রথমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এলেও, ক্ষমতা থেকে আর সরতে চান না। তারা আজীবন ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে চান। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একনায়ক হিটলারও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও ২০২০ সালে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ক্ষমতা না ছাড়ার চক্রান্ত করেছিলেন। তাতে মার্কিন গণতন্ত্রের চেহারায় কালো কালি লেগে গিয়েছে। একইসঙ্গে আমেরিকার রাজনীতিতে ক্ষমতা না ছাড়ার একটি নিকৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। যা আমেরিকায় অকল্পনীয়। যদিও উন্নয়নশীল দেশে এমন সংস্কৃতির উদাহরণ কাঁড়ি কাঁড়ি। ক্ষমতার মোহ শাসকদলকে এতটাই আবিষ্ট করে ফেলে যে, তারা একবার ক্ষমতায় যেতে পারলেই, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ভাবতে শুরু করে। ক্ষমতার পালাবদল মানেই অশান্তি, রক্ত ঝরিয়ে আন্দোলন।
জানি না, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা এমন ভয়ঙ্কর রোগে ভোগেন কি না!
তবে তাঁদের দল ও সরকার আজ যে নির্দিষ্ট মতে, পথে ও রঙে গোটা দেশকে পরিবর্তন করতে চাইছে—তা বহুত্বের ইতিহাস মুছে একরঙা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইতিহাস। তাঁদের আমলেই প্রকৃত ইতিহাসের নামে অসত্য, অর্ধসত্য এবং বিকৃত কাহিনি গলাধঃকরণ করানোর সুবন্দোবস্ত হয়েছে। মোগল শাসক ও ইসলামি শাসনকে অস্বীকার করা, ইতিহাসের বাস্তব মুছে ফেলে হিন্দু রাজা-শাসনকর্তাদের বিজয়ী বলে দাগিয়ে দেওয়া আসলে তাঁদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরই শিক্ষামুখ। আজ তা প্রকাশ্য ও নির্লজ্জভাবে আগ্রাসী, কারণ বিজেপি সরকারের হাতে ‘ক্ষমতা’ আছে, ক্ষমতা আগ্রাসনকে সহজ করে দেয়। ইতিহাস শুধু শাসক, রাজা, সম্রাটদের নয়, সাধারণ মানুষেরও। একটি দেশের ইতিহাস হল সেই দেশের জাতীয় স্মৃতি। কারও যদি স্মৃতি লোপ পায়, তাতে তাঁর জীবনে যেমন বিপদ নেমে আসে, একই ভাবে কোনও দেশের জাতীয় স্মৃতি বা ইতিহাস যদি ভ্রান্ত হয়, তা হলে সেই জাতিরও সমূহ বিপদ। দুর্ভাগ্য, মোদির ভারত সেই বিপজ্জনক পথেই পা বাড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব পরিসরই রাজনীতির, সব সুযোগই বিভাজনের।
এই আগ্রাসনই দেশজুড়ে স্থান-নাম বদলের তাণ্ডবে মাতে। মসজিদের মাটির নীচে শিবলিঙ্গ খোঁজে। বিজেপির আইটি সেলের অক্লান্ত পরিশ্রমে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দেওয়া হয় ছোট-বড় অজস্র মিথ্যার বিষ। যার প্রতিটিরই অভীষ্ট ভারতের বহুত্বকে আক্রমণ করা। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার মাত্রা বৃদ্ধি। প্রতিবাদ করলেই, তাকে হিন্দুবিদ্বেষী ও দেশদ্রোহী বলে দাগায়। মহম্মদ জুবেরের মতো ঠাঁই হয় জেল। শুধুমাত্র সত্যের পক্ষে থাকার জন্যই যদি রাষ্ট্রক্ষমতা কোনও নাগরিককে কঠোরভাবে দমন করতে চায়, তাতে একনায়কতন্ত্রের পদধ্বনি প্রকট হয়। একে কি ‘হাবরিস সিনড্রোম’ বলা যায়?
৮৪ বছরের বৃদ্ধ লর্ড ডেভিড ওয়েন আমাদের নেতাদের খোঁজ রাখেন কি না জানি না। রাখলে, নিশ্চিত খোঁজ পেতেন ভয়ঙ্কর ক্ষমতার আস্ফালনের নজির। যেখানে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়ে শাসকদল ক্ষমতার অহংবোধে ধরাকে সরাজ্ঞান করেন। মাটিতে মিশে যায় মনোজগতের ন্যায়বোধ। যেভাবে বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের লুকিয়ে রেখে অভ্যুত্থানের মতো সরকার-বদল ঘটানোর চেষ্টা চলে, তা দেখে একুশ শতকের অভ্যস্ত চোখও অসুস্থ বোধ করে। আসলে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল নিজেকে আয়নায় দেখতে শুরু করছে প্রায় অপরাজেয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মতো!
নিরন্তর শক্তিপ্রদর্শন, অকারণ হিংস্রতা এবং ভীতিপ্রদর্শনের এই সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জমিকে ক্রমশ গ্রাস করছে। সাধারণ মানুষের নাগরিক সত্তাকে সঙ্কীর্ণ করে আনছে কোনও এক দলীয় সমর্থকের পরিচয়ে। কে বোঝাবে, ভয় দেখিয়ে চৌকিদারের শাসন চলে, গণতন্ত্রের শাসন নয়। মতের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাধানের দক্ষতা যে রাজনীতিতে অপরিহার্য, বিরুদ্ধ মতকে সম্মান করা, বিরোধীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে রাজনীতিকদের পেশাদারিত্বের পরিচয়, সেই বোধ আজ সর্বস্তরে প্রবল ক্ষয়িষ্ণু। গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র ‘ভোটযুদ্ধ’— একটা যুদ্ধ শেষ হলেই ফের চলে প্রস্তুতি।
বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা একটি কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন দেশবাসীকে— সংবিধান যা-ই বলুক, দেশের উচ্চ আদালতগুলি সংবিধানের সেই সত্য রক্ষায় যত গুরুত্বই দিক— শেষ পর্যন্ত সেই আদর্শগুলি কিছু মুদ্রিত শব্দমাত্র। একনায়কতন্ত্র এভাবেই নিজের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। আশঙ্কা হয়, সংবিধানকে তাঁরা ভারতের আত্মা হিসাবে গ্রহণ করেননি। বরং, সদ্য স্বাধীন দেশে উদারবাদী রাজনৈতিক যুগপুরুষরা যে গৈরিক সঙ্কীর্ণতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এক নতুন ভারত রচনা করতে চেয়েছিলেন, বর্তমান শাসকরা সংবিধানকে সম্ভবত গৈরিক রাজনীতির সেই পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে দেখেন। ফলে, সেই সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা, তার আদর্শ থেকে চ্যুত হওয়ার লজ্জা, কোনওটিই তাঁদের নেই। তাঁদের দাপটের সামনে বহুত্ববাদী ভারতের আদর্শ অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতাও ‘হাবরিস সিনড্র্রোম’ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
লর্ড ডেভিড ওয়েন মনে করাচ্ছেন, হাবরিস সিনড্রোমে ভোগা ক্ষমতাধর শাসকদের লজ্জা-শরম বলতে কিছুই থাকে না। জনগণের কোনও সমালোচনাতেই তাঁরা কর্ণপাত করেন না। এমনকী সমালোচনার প্রধানমাধ্যম সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের দমন করতেও দ্বিধা করেন না। একইভাবে শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংসের শেষ সীমানায় পৌঁছে দেওয়া হয়। আর ক্ষমতাধররা রাষ্ট্রময় ছড়িয়ে দিতে চান তাঁদের গালগল্প...।
এই রোগের একমাত্র প্রতিষেধক কী? লর্ড ওয়েন মনে করেন, হাবরিস সিনড্রোমে আক্রান্ত শাসকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া জনগণেরই দায়িত্ব। যত দ্রুত সম্ভব!