হাতরাস-উন্নাও-বলরামপুর-লখিমপুর ... যোগীরাজ্যে ধর্ষণ ও খুন যেন মানচিত্রে আলাদা করে জায়গা করে নিয়েছে। নারী নির্যাতনের মৃগয়াক্ষেত্র এই রাজ্যে ধর্ষণ ও খুনের সাক্ষী হিসাবে একটার পর একটা জায়গায় নাম উঠে আসছে টাইম-টেবিলে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৈশাচিক অত্যাচারের শিকার নিম্নবর্গ, দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েরা। অত্যাচারীর ভূমিকায় কখনও শাসকদলের মদতপুষ্ট উচ্চবর্ণের দুষ্কৃতীরা অথবা অন্য কেউ। কয়েকবছর আগে উন্নাওয়ে ১৯ বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল বিজেপিরই এক বিধায়কের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তোলপাড় হয় সংসদ থেকে গোটা দেশ। শেষপর্যন্ত চাপে পড়ে সেই বিধায়ককে গ্রেপ্তার করে প্রশাসন। কিন্তু বিজেপির পোস্টারবয় যোগীর উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সেই উন্নাও ফের খবরের শিরোনামে উঠে আসে এবছর। এক দলিত নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। উপর্যুপরি ধর্ষণের পর তাকে যাতে কেউ চিনতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়। কোনও সভ্য দেশে বা সমাজে এমন ঘটনা কল্পনারও অতীত। এখানেই শেষ নয়, ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে দেহটি রেললাইনের ধারে ফেলে রাখা হয়। বিজেপির ডবল ইঞ্জিনের ‘সুশাসনে’র ধ্বজাধারী এই রাজত্বে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া ঘটনাটি ঘটে হাতরাসে ২০২০ সালে। সে-বছর ১৪ সেপ্টেম্বর এক দলিত কন্যা উচ্চবর্ণের চারজনের ভয়াবহ লালসার শিকার হয়। গণধর্ষিতা ওই কন্যা মৃত্যুর সঙ্গে ১১ দিন লড়াই করে শেষপর্যন্ত হার মানে। এখানেই শেষ নয়, তার মরদেহ রাতের অন্ধকারে পরিবারকে না জানিয়ে পুড়িয়ে দেয় যোগীর পুলিস। আবার যোগী রাজ্যেরই আর একটি জায়গা বলরামপুরের ধর্ষিতা মেয়েটি যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় পুলিসের কাছে আকুতি জানিয়েছিল, ‘আমি মরতে চাই না’। শেষপর্যন্ত অবশ্য ২২ বছরের ওই দলিত তরুণীকে মরতেই হয়। ফের এমন জঘন্যতম নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল যোগীরাজ্য লখিমপুর খেরিতে। এবার লালসার শিকার এক নয়, নাবালিকা দুই বোন। শুধু গণধর্ষণ নয়, শ্বাসরোধ করে হত্যার পর নিথর দুটি দেহ গাছে ঝুলিয়ে দেয় ধর্ষকরা। গা শিউরে ওঠার মতো এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৪-তে উত্তরপ্রদেশেরই বদায়ুঁতে দুই তুতো বোনকে নৃশংসভাবে এভাবেই ধর্ষণ ও খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একের পর এক ঘটনাই প্রমাণ দিচ্ছে যোগীরাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই। এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাঠগড়ায় যোগীর পুলিস প্রশাসনের গাফিলতি ও অসংবেদনশীল ভূমিকা। তাই ধিক্কার জানালেও কম হয়।
আসলে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে উত্তরপ্রদেশ। এই লখিমপুর খেরিতেই গতবছর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিসের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কৃষকদের গাড়ির নীচে পিষে মারার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। সেই এলাকাই ফের খবরের শিরোনামে। সেখানে আতঙ্ক বাড়িয়ে দুই দলিত নাবালিকার উপর ন্যক্কারজনক পৈশাচিক ঘটনা ঘটল। এমনকী, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসার আগেই ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টাও করলেন যোগীর পুলিসেরই এক ‘দায়িত্বশীল’ অফিসার! তড়িঘড়ি তিনি কী বললেন? বললেন, ওদের গলায় নিজেদেরই ওড়নার ফাঁস ছিল। এখানেই শেষ নয়। নাবালিকারা স্বেচ্ছায় মোটরবাইকে উঠেছিল কি না বা ধর্ষকরা তাদের পূর্বপরিচিত কি না এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ টেনে বিতর্ক উস্কে দেওয়ার চেষ্টাও হল! প্রশ্ন হল, দলিত দুই বোন স্বেচ্ছায় মোটরবাইকে উঠুক বা না উঠুক, এটি অপহরণের ঘটনা হোক বা না হোক, অভিযুক্ত ধর্ষকরা তাদের পূর্বপরিচিত হোক বা না হোক তাতে কি ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার গুরুত্ব এতটুকু কমে? এমন জঘন্যতম ঘটনায় যারা জড়িত তাদের যত দ্রুত সম্ভব দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা বা নৃশংস এই ঘটনার গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা হলে তা হবে আরও একটি মারাত্মক অপরাধ।
ঘটনার পর সত্যিই কি নড়েচড়ে বসবে যোগী প্রশাসন? প্রশ্নটা উঠছে। কারণ গোটা দেশে নারী নির্যাতনের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। আর ডবল ইঞ্জিনের ‘সুশাসন’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপি নেতৃত্ব যতই বড়াই করুন না কেন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টো চিত্র। কারণ দেশবাসী দেখেছে, সম্প্রতি গুজরাতে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তির পর সেখানে এই বিজেপিই তাদের সংবর্ধনার মাধ্যমে দিয়েছে বীরের সম্মান! তাই যারা ধর্ষকদের আড়াল করার চেষ্টা করে বা সম্মান দেয় তাদের কাছে মহিলাদের সুরক্ষা আশা করাই বৃথা। নিঃসন্দেহে লখিমপুরের এই মর্মান্তিক ঘটনা উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ফের বেআব্রু করল। উত্তরপ্রদেশে একের পর এক এধরনের খুনের ঘটনা অপরাধীদের দমনে যোগী প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। ঘটনাগুলি প্রমাণ করছে, যোগীরাজ্যে দুষ্কৃতীরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সেখানে মহিলারা আদৌ সুরক্ষিত নয়।