মেয়েটির বয়স ২৫। অবিবাহিত। পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় যৌনসম্পর্কে মিলিত হয়েছিলেন তিনি। তারপর দেখতে দেখতে ২৩ সপ্তাহ ৫ দিন অতিক্রান্ত। মাতৃগর্ভে জন্ম হয়েছে এক ভ্রূণের। গর্ভেই তাকে এতদিন লালনপালন করেন সেই মেয়ে। কিন্তু বেঁকে বসে তাঁর পুরুষসঙ্গী। অন্তঃসত্ত্বাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে আগন্তুক। গরিব পরিবার। বাবা কৃষক। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় মেয়েটি। অর্থকষ্টে জর্জরিত পরিবারে আগত ভবিষ্যৎ-কে লালন-পালন করার মতো সামর্থ্য নেই তাঁর। অসহায় মেয়েটি এক বুক কান্না চেপে গর্ভপাতের অধিকার চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করেন। আদালত তাঁকে জানায়, সম্মতিক্রমে যৌন মিলনের কারণে গর্ভধারণের বিষয়টি মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি (২০০৩) আইনের আওতায় পড়ে না। কিন্তু ভেঙে না পড়ে মেয়েটি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। ২১ জুলাই অন্তর্বর্তী নির্দেশে সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। সেই মামলারই চূড়ান্ত রায় বেরল বৃহস্পতিবার। ‘বিশ্ব নিরাপদ গর্ভপাত দিবস’-এর দিন দেশের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিল, গর্ভপাত নিয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে আইন কোনও ফারাক করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট মনে করছে, গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্রই একজন নারীর স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই কোনও নারীকে অবাঞ্ছিত গর্ভ পূর্ণ সময়ের জন্য বহন করতে হলে তা হবে তার সম্মানহানির সমান। শীর্ষ আদালতের এই রায়ে মধ্যযুগীয় ভাবনাচিন্তার অবসান ঘটিয়ে নারীর অধিকারই স্বীকৃত হল। মান্যতা পেল যে গর্ভসংক্রান্ত অধিকারের সিদ্ধান্তটি একান্তভাবেই মহিলাদের নিজস্ব। তার সঙ্গে বৈবাহিক অবস্থার সম্পর্ক নেই। নারীর নিজের শরীরের উপর তার অধিকার সার্বভৌম ও প্রশ্নাতীত। তাই অবিবাহিত মহিলাদেরও গর্ভাবস্থার ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত নিরাপদে, আইনসম্মতভাবে গর্ভপাতের অধিকার থাকছে, ঠিক যে অধিকার রয়েছে একজন বিবাহিত মহিলার। একথা জানিয়ে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। সন্দেহ নেই, নারীদের অধিকারের প্রশ্নে এ এক যুগান্তকারী রায়দান। নারী যে গর্ভধারণের যন্ত্রমাত্র নয়, তাঁর নিজের শরীরের উপর কেবলমাত্র তারই অধিকার, এই ঐতিহাসিক রায়ে সেটাই নির্ধারিত হল। আদালতের এই উদার প্রগতিশীল অবস্থান ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রতি মহিলাদের আস্থা আরও বাড়িয়ে তুলল। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারী পুরুষ সমানাধিকারের কথা সোচ্চারে বলা হলেও বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী স্বাধীনতা নিষ্পেষিত পদদলিত হচ্ছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের এমন অবস্থান শুধু অত্যন্ত বাস্তবোচিতই নয়, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরিই ছিল।
মাত্র মাস তিনেক আগের কথা। দুনিয়ার সবচেয়ে উদার ও আধুনিক রাষ্ট্র বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দেয় সে দেশের শীর্ষ আদালত। অথচ পাঁচ দশক আগে ১৯৭৩ সালে ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলায় গর্ভপাতকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছিল ওই দেশেরই আদালত। পাঁচদশক পর সেই গর্ভপাতের বৈধতাকে বাতিল করেছে তারা। কিন্তু ভারতের শীর্ষ আদালত কার্যত সেই রায়ের উল্টোপথে হেঁটে গর্ভপাতের বৈধতা নিয়ে ভিন্ন কথা শোনাল। এই প্রেক্ষাপটে এদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাইলফলক তৈরি করল।
আমাদের দেশের সংবিধানে সবক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে নারীর সমানাধিকারের কথা বলা আছে। সেই মোতাবেক আইনও আছে। কিন্তু সংবিধান, আইনের কথা আর বাস্তবের ফারাক স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও আশমান জমিন। এ দেশ এখনও পুরুষতান্ত্রিক। এই দেশের সমাজে এখনও নারী স্বাধীনতার বিষয়টিকে বহু ক্ষেত্রেই পুরুষের ইচ্ছা স্বার্থ মর্জিমতো ব্যবহার করা হয়। দেশের বহু মেয়ে এখনও যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পরিবারেও উপযুক্ত গুরুত্ব ও মর্যাদা পায় না। দেশের সরকার আত্মনির্ভরশীল ভারত গঠনের কথা বললেও অশিক্ষা, কুসংস্কার অপুষ্টিতে ভোগা বহু নিম্নমধ্যবিত্ত গরিব ঘরের মেয়ে আজও মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার। তবু এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো যেন শীর্ষ আদালতের রায় নারী স্বাধীনতা ও তার অধিকারের চাবুক হয়ে আছড়ে পড়েছে সমাজের বুকে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস ও তার জেরে মাতৃজঠরে ভ্রূণের আবির্ভাব, তারপর পুরুষের দায়িত্ব অস্বীকার, গর্ভধারিণীর আতান্তরে পড়ার ঘটনা এখন সমাজে যেন নিত্য নৈমিত্তিক। এই সুযোগে বেড়ে চলেছে বেআইনি গর্ভপাত কেন্দ্রের অসাধু ব্যবসা। সেখানে থাকে জীবনহানির আশঙ্কাও। তাই বলা যায়, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণজনিত মহিলাদের সমস্যা, লোকলজ্জা ও মানসিক ট্রমা কাটানো জন্য এমন একটি বাস্তবোচিত রায়ের প্রয়োজন ছিলই। তাই আদালতে ২৫ বছরের ওই তরুণীর নজির সৃষ্টিকারী লড়াই এবং শেষমেষ যুদ্ধজয় হয়তো-বা দেশের বহু মহিলার ঘরেবাইরে অবস্থানের ছবিটাই বদলে দিতে পারে। সামাজিক উদারতার পক্ষে এমন রায় ঘুচিয়ে দিতে পারে বিবাহিত-অবিবাহিতের ফারাকটুকুও।