সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন হল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সংস্থাটি তার সংক্ষিপ্ত নাম সিবিআই-তেই একসময় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। দেশবাসীর ধারণা ছিল, যে-কোনও বড় ধরনের দুর্নীতি এবং অপরাধের শিকড় পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, এমনই শক্তিমান ও দক্ষ তারা। আর সিবিআই কোনও অপরাধীকে ছোঁয়া মানেই তার নিস্তার নেই। ‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’ শুধু সময়ের অপেক্ষা। এজন্য কোনও রাজ্য বা নগর পুলিস প্রশাসনের উপর আস্থা হারালেই মানুষ সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে। রাজ্য সরকার তাতে আপত্তি জানালে সিবিআই তদন্তের দাবি আদায়ে মানুষ শীর্ষ আদালত পর্যন্ত মামলাও লড়েছে। সিবিআই সম্পর্কে এটাই ছিল বেশিরভাগ মানুষের মনোভাব, সংস্থাটির প্রতি সমাজের শ্রদ্ধা। অনেক দিন হল, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি সেই মর্যাদা হারিয়েছে। তার প্রতি বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, শ্রদ্ধা আর আগের মতো নেই। সাংবিধানিক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা পীড়িত, বিচলিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে আদালতকেও। একাধিক হাইকোর্ট এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টও সিবিআই সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মন্তব্যটি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট, সবার আগে। ২০১৩ সালের মে। সরকারে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কয়লা খনির ব্লক বণ্টন মামলায় দুর্নীতির তদন্ত করেছিল সিবিআই। কিন্তু এই ফেডারেল এজেন্সির কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের গন্ধ পায় কোর্ট। তার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত সিবিআই সম্পর্কে দুটি তকমা দিয়েছিল—‘কেজড প্যারট’ এবং ‘ইটস মাস্টার্স ভয়েস’! বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘খাঁচাবন্দি তোতা’ আর ‘মনিবের কণ্ঠস্বর’! কোনও সন্দেহ নেই, এত বড় একটি স্বশাসিত তদন্তকারী সংস্থার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পক্ষে বিচার বিভাগের সবচেয়ে উঁচু আসনের এই পর্যবেক্ষণ যথেষ্ঠ।
এর জন্য দায়ী কে? এক ও একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার বা কেন্দ্রের শাসক গোষ্ঠী। সোজা কথায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার আসনই সিবিআই নামক একটি অতি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা জানি, সুপ্রিম কোর্টের সেদিনের ভূমিকায় সবচেয়ে উল্লসিত হয়েছিল বিজেপি, ভারতের প্রধান বিরোধী দল। একবছর বাদে গদি গেল উল্টে। ক্ষমতার অধীশ্বর হলেন বিজেপির কাণ্ডারী নরেন্দ্র মোদি। দেশবাসীর আশা ছিল, সিবিআইয়ের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে বিশেষ যত্নবান হবেন তিনি। কারণ, বিজেপি বরাবর ‘নীতির রাজনীতি’-র বুলি আউড়ে এসেছে। কিন্তু বাস্তবটা যে কঠিন। ভারতের রাজনীতি সাধারণভাবে কায়েমি স্বার্থের দাস, তারই অঙ্গুলি হেলনে নড়েচড়ে। বিজেপি নিজেকে ওই বৃত্তের বাইরে রাখার আগ্রহ দেখায়নি কোনওদিন, কোনওভাবেই। বরং দলীয় স্বার্থ, কখনও ব্যক্তিস্বার্থই বড় হয়েছে তাদের কাছে। ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্রই বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সির কাজে হস্তক্ষেপ করেছে বিজেপি। তার ভিতরে সিবিআই, ইডির নাম উল্লেখ করতে হয় বিশেষভাবে। এছাড়া সিএজি, নির্বাচন কমিশন এবং বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা তারা করেছে বলে রাজনৈতিক মহল থেকে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে।
অন্য একটি মামলার পর্যবেক্ষণে মাদ্রাজ হাইকোর্টও ২৯ মার্চ সিবিআই সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিল। মাদ্রাজ হাইকোর্টেরই মাদুরাই বেঞ্চ মঙ্গলবার ফের আর একদফা ভর্ৎসনা করেছে কেন্দ্রকে। চিটফান্ড দুর্নীতির তদন্ত সিবিআইকে দিয়ে করানোর দাবিতে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানি গ্রহণের সময় সিবিআই সম্পর্কেই তার বিরূপ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণে সিবিআইয়ের অদক্ষতা, পরিকাঠামোর দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের মতো অনৈতিক দিকগুলি স্পষ্ট হয়েছে। কোর্ট চায় এই মুহূর্তে সিবিআইয়ের আমূল সংস্কার। তার জন্য ১২ দফা নির্দেশিকা জারি করেছে। সংস্কারে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে সংস্থার স্বাধীনতার উপর। কোর্ট চায় সিবিআই সংসদ ছাড়া আর কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না, যেমনটা স্বাধীন সিএজি এবং নির্বাচন কমিশন। সিবিআইয়ের সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো আধুনিক করে তুলতে হবে। সরকারি সচিবের সমতুল ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে সিবিআই প্রধানের হাতে। সিবিআইয়ের জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ করারও প্রস্তাব দিয়েছে হাইকোর্ট। কেন্দ্রের কাছে সিবিআইকে ছ’সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রের প্রতি কোর্টের আদেশ—প্রস্তাব গ্রহণের তিনমাসের মধ্যেই ওই সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করতে। কোর্টের মন্তব্যও খুব তাৎপর্যপূর্ণ, ‘এই আদেশ খাঁচাবন্দি তোতাকে (সিবিআই) মুক্ত করার একটি চেষ্টা।’ বিচার বিভাগের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। মোদি সরকারের উচিত, আদালতের আদেশ শিরোধার্য করে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা। অন্যথায় সিবিআইয়ের গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে যাবে। নীতি নৈতিকতা ভঙ্গ করার এই রোগের সংক্রমণে দুর্বল হতে থাকবে বাকি স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থাগুলিও। রাজনীতির আসন যেন বিস্মৃত না-হয় যে এসবই হল ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল।