হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
উত্তর মেলেনি ৩০০ কোটি ডলারের কী হবে। শেষ ২০ বছরে এই বিপুল অর্থ ‘বন্ধু’ দেশ আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেছে নয়াদিল্লি। ভারত সরকারের ওয়েবসাইটেই রয়েছে, আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের স্তম্ভ সংসদ ভবন তৈরি করে দিয়েছিল নয়াদিল্লি। খরচ হয়েছিল ৯৭০ কোটি টাকা। সেই সংসদ ভবনে একটি ব্লক রয়েছে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির নামে। সেই ঘরে, সেই ভবনেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবান। রাস্তা, পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে হেরাট প্রদেশে সালমা জলাধার, চাবাহার বন্দর, এসবও তৈরি হয়েছে ভারতীয় অর্থ সাহায্যে। শুধু তাই নয়, ভারত সরকার আফগানিস্তানকে ২০০টি মিনিবাস, ৪০০ বাস, ১০৫ সরকারি গাড়ি, ২৮৫টি সেনার গাড়ি, পাঁচটি শহরে ১০টি অ্যাম্বুলেন্স, তিনটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান উপহার হিসেবে দিয়েছিল। তৈরি করে দিয়েছিল জরঞ্জ-দেলারাম সড়ক, যাতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫ কোটি ডলার। এই রাস্তাই এখন আফগানিস্তানের মূল যোগাযোগের মাধ্যম। ২০ বছরের এই বন্ধুত্বে কি এবার ইতি পড়বে? ভারতের করদাতাদের অর্থে নিজেদের আখের গোছাবে তালিবান?
এমন বহু প্রশ্নের উত্তর না মিললেও আফগানিস্তানে তালিবান উত্থানের ঘটনাকে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে কতটা ব্যবহার করা যায়, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। কীভাবে? ‘তালিবান জুজু’ দেখিয়ে নয়া প্রচার কৌশলে নেমে পড়েছে বিজেপির আইটি সেল। কোভিড, পেগাসাস, কৃষি আইন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে কেন্দ্র যখন কোণঠাসা, তখন আফগানভূমে তালিবান হানা যেন নিস্তার পাওয়ার পথ খুঁজে দিয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীর তালিবান ভীতিকে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতারা বলা শুরু করেছেন, ‘মোদির মতো শক্তিশালী নেতা না থাকলে ভারতের অবস্থাও ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের মতোই হবে।’ এমনকী দেশের বেহাল আর্থিক অবস্থা, বা পেট্রল-ডিজেলের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘তালিবান জুজু’। পেট্রলের দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ভোপাল এবং বিহারের দুই বিজেপি নেতা তো প্রকাশ্যেই আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার নিদান দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিজেপির আইটি সেল বোঝাতে চেষ্টা করছে, আজ আফগানিস্তান যে সন্ত্রাস সমস্যায় বিপর্যস্ত, সেটা শুধু ভুল নীতি, আর যোগ্য নেতার অভাবে। এবং মোদি না থাকলে ভারতেও সেই পরিস্থিতিই সৃষ্টি হতে পারে।
অথচ, যে কথাটি অনালোচিত থেকে গিয়েছে, তা হল, দেশের বিদেশনীতিকে শক্তিশালী করার থেকেও ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বছরের পর বছর নরেন্দ্র মোদিকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। মনে করুন মোদি জমানার সেই প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা। প্রধানমন্ত্রী সেদিন যাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন সার্ক সদস্যদেশের নেতা। সেই নিমন্ত্রণের অন্তর্নিহিত বার্তাটি ছিল তাঁর বিদেশনীতির নির্যাস: প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার। মোদি জমানা যত এগিয়েছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সেই সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বার্তাও ফিকে হয়েছে।
তাকিয়ে দেখুন মানচিত্রের দিকে। একসময় যে নেপাল ছিল ভারতের পরম সুহৃদ, আজ সে ফিরেও তাকায় না। বেজিং যত কাছে এসেছে, কাঠমান্ডুর সঙ্গে দিল্লির দূরত্ব তত বেড়েছে। শ্রীলঙ্কা আরও কাছে টানতে শুরু করেছে চীনকে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ দুলে চলেছে পেন্ডুলামের মতো। সীমান্তবর্তী ডোকালাম বিবাদের পর চীনের প্রভাবও অস্বীকার করতে পারছে না ভুটান। ইমরান খানের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তো সকলের জানা। বাকি ছিল আফগানিস্তান। এই সে দিনও ভারতের চোখে যে দেশ ছিল প্রকৃত বিশ্বস্ত বন্ধু, তালিবান উত্থানের পর তাও আজ অতীত। আর সব সম্পর্ক ভাঙনে আড়কাঠি হয়ে উঠেছে বেজিং। ড্রাগনের ছায়ায় সঙ্কটে ভারতের প্রতিবেশী নীতি। চীনের নজর এখন— ভারতীয় উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার, সীমা সম্প্রসারণ ও কূটনৈতিক লড়াই।
বিশ্বনেতা হওয়ার তাড়নায় মোদি সমকালীন নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। তেলা মাথায় তেল দিয়েছেন। ভাবটা এমন, দেশের বিদেশনীতির চালকের আসনে প্রধানমন্ত্রী নিজেই। ওবামাকে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে নিজের হাতে চা করে খাইয়েছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের সঙ্গে আমেদাবাদের সবরমতির কিনারে দোলনায় দুলেছেন। তামিলনাড়ুর মামাল্লাপুরম মন্দির ভ্রমণের সময় গাইডের ভূমিকা নিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নাম ধরে ‘মাই ফ্রেন্ড’ বলেছেন। টেক্সাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বঘোষিত ‘নির্বাচনী এজেন্ট’ হিসেবে ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান দিয়েছেন। আমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের বুকে জড়িয়ে ধরার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক নৈকট্য প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন। তাতে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ব্র্যান্ড মোদি’ ভাবমূর্তি তৈরি হলেও, প্রতিবেশী দেশগুলির মন জয় করতে পারেননি।
মোদির মার্কিন প্রীতি যত প্রকাশ্যে এসেছে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে চেনা ছকে তত বিস্তারবাদের আস্ফালন বাড়াতে শুরু করেছে চীন। যেমন হয়েছে আফ্রিকায়। মার্কিন ও ইউরোপীয় আধিপত্যে থাবা বসাতে গত দু’দশক ধরে আফ্রিকার অনেকগুলি দেশে বিপুল বিনিয়োগ করেছে চীন। সমুদ্রবন্দর, পরিকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল নির্মাণ। শুরুটা সব ক্ষেত্রেই বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দিয়ে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা অনেক ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয়েছে সেই প্রকল্পগুলির মালিকানা দখলে। কারণ সেই টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা দেশগুলির থাকেনি। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকার অনেক দেশে চীনের আধিপত্য আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। একইভাবে বহু দেশেই একাধিক প্রজেক্টে অর্থ বিনিয়োগ করে চীন সেদেশের আবেগ কিনে নিয়েছে। যার প্রবল শিকার নেপাল। গত কয়েক বছরে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা, ভারত-বিরোধিতার সুর চড়েছে সেখানে। শ্রীলঙ্কার কথাই ধরুন। হাম্বানতোতায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীন বন্ধুত্বমূলক শর্তে হাত উপুড় করে টাকা দিয়েছিল। অনিবার্য ফল— সেই টাকা পরিশোধ করা শ্রীলঙ্কার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেই মৃতপ্রায় আস্ত বন্দর ঘিরে পনেরো হাজার একর জমি আজ চীনের দখলে, ভারত থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে।
বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) প্রকল্পে বাংলাদেশে পরিকাঠামো গড়তে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে চীন। পাকিস্তানের পরেই যা সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিরাট অঞ্চলের নিকটতম সমুদ্রবন্দর হল চট্টগ্রাম। তাই কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণে চীনের বিশেষ আগ্রহ। চট্টগ্রামের আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০টি চীনা কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৩০ কোটি ডলারের যে বিনিয়োগ এসেছে, সেটি চীনের ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপের। যারা চীনের ইয়াবাং গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। ইয়াবাং ১০০ একর জমিতে বস্ত্র শিল্পের রাসায়নিক, ওষুধের কাঁচামাল ও অন্যান্য রাসায়নিক উৎপাদন করবে। চীনের বাজারেও বাংলাদেশ ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র কথা। পরিকল্পনা নিয়ে হাজির একটি চীনা কোম্পানি। আর তা বাস্তবায়নের দাবি করছে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। কী আছে সেই প্রোজেক্টে? ইউরোপীয়ান শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলির মতো পাকা ক্যানেল হবে তিস্তা। তার দু’পাশে বিশাল বিশাল ভবন, গোছানো ছিমছাম আবাদি জমি। তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্র ডিমলা থেকে চিলমারি পর্যন্ত হুবহু ইউরোপের যেকোনও রাজধানী শহর। বলা হচ্ছে, তিস্তার জল আসবে তিস্তা খনন করেই। ভূগর্ভের জল এসে ভরাট করবে তিস্তাপাড়ের জীবনরেখাকে। এর প্রস্তাবিত ব্যয় আট হাজার কোটি টাকা দেবে বেজিং। চীনের এই প্রভাবের কারণে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক আজ এক সন্ধিক্ষণে। তাই উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেক মোড়-পরিবর্তন ঘটছে, শুরু হয়েছে সম্পর্কের ভাঙাগড়া।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের দখল হাতে নিয়েই তালিবানের ফতোয়া, ভারতের সঙ্গে আপাতত কোনও ব্যবসা-বাণিজ্য বা লেনদেন হবে না। আফগানিস্তানে ভারত রপ্তানি করে চিনি, চা, কফি, পোশাক, ওষুধ, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, চেরি ফল, তরমুজ প্রভৃতি। শুধু চলতি বছরেই প্রায় ৮৩৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী আফগানিস্তানকে বিক্রি করেছে ভারত। দু’দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে এদেশের ব্যবসায়ীরাই। সেই বাজার ধরতে ওত পেতে রয়েছে চীন। বেজিং এখন আর নিজেদের শক্তি দেখাতে রাখঢাক রাখছে না। তারা তাকিয়ে আফগানিস্তানের বিপুল খনিজ সম্পদের দিকেও। ইতিমধ্যে তালিবানের মুখপাত্র সুহেল শাহিন জানিয়ে দিয়েছেন, আফগানিস্তানের উন্নতি সাধনে চীন বড়সড় ভূমিকা নিতে পারে।
এখন প্রশ্ন একটাই, আফগানভূমিতে বেজিংকে রুখতে কী কৌশল নেবে ভারত? দেশের বিদেশনীতি নিয়ে মোদিজি এখনও নীরব। যা আমাদের ভাবাচ্ছে বইকি!